শ্বশুরবাড়ির ইফতারি এবং লোভাতুর আকাঙ্ক্ষা!
রমজান আত্মশুদ্ধি সংযম পাপাচার থেকে মুক্ত হয়ে আগত দিনগুলো সুন্দরভাবে যাপনের পথ বাতলে দেয়। এই মাসে দান সদকা সৎকাজের ফজিলত অন্যান্য সময়ের চেয়ে অনেক গুণ বেশি। রমজানে পাপাচার মুক্ত থাকার কথা বলা হয়। অথচ এই রমজানেই মেয়ে বাড়িতে পাঠানো ইফতার সংস্কৃতিকে ঘিরে বাংলাদেশের উত্তর পূর্বাঞ্চলে অযাচিত অশান্তি এবং জীবনহানির মতো নানা ঘটনা ঘটে থাকে।
এই দৈন্যতা, হীন মানসিকতা কীসের ইঙ্গিত বহন করে? মুসলমান সমাজে কি এই রেওয়াজ চলমান থাকতে পারে? এই অঞ্চলে আবহমানকাল থেকে নানা সংস্কৃতি সামাজিক রীতি প্রথা কৃষ্টি সংস্কারসহ এমন কিছু চালু আছে যা বাংলাদেশের অন্যান্য জনপদ থেকে সম্পূর্ণ আলাদা।
এসব প্রথা কতটা গৌরবের এবং ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা বহন করলেও এমন সব প্রথাও এই সমাজে চলমান যা মানব সমাজের বৈকল্যতা এবং কূপমণ্ডূকতাকেই ইঙ্গিত করে। এমনই এক রেওয়াজ মেয়ের বাড়িতে প্রতি রমজানে ইফতার পাঠানো। যা মাঝে মাঝে বিষাদ এবং কষ্টের আবহ তৈরি করে।
আরও পড়ুন >>> ওয়াজে কী বলা হয়
সিলেট অঞ্চলে রমজান মাস আসার বেশ কিছুদিন আগ থেকেই মেয়ের বাড়ির লোকজনের মাথায় চিন্তা থাকে কীভাবে ইফতারি পাঠানো হবে। রমজানে কয়েক দফা ইফতারি পাঠানোর রীতিও এই সমাজে দেখা যায়।
রমজানের শুরুতে প্রথম দফা, বিশের আগে ঢাকঢোল পিটিয়ে বড় আয়োজনে ছেলেপক্ষের আত্মীয়স্বজন পাড়াপড়শি সমেত এলাহি কাণ্ড ঘটিয়ে মেয়ের বাবার পকেটে খালি করে বিবেকহীন বাসনা চরিতার্থ করা হয় এবং রমজানের শেষ দিকে ইফতারিসহ নতুন জামা কাপড় পাঠিয়ে এর যবনিকাপাত করা হয়। এক অসুস্থ প্রতিযোগিতা ও সামাজিক ব্যাধি। সমাজের বিত্তবানদের ক্ষেত্রে এসব রেওয়াজ পালনে সঙ্গতির সাথে বিলাসিতা থাকলে ও অসহায় বিধবা এবং কন্যাদায়গ্রস্ত পিতারা নীরবে-নিভৃতে চোখের পানি ফেলে।
অনেক অভিভাবক ঋণ করে হলে ও মেয়ে ভালো থাকুক এবং সে যেন অপমানিত বোধ না করে এই তাড়না থেকে ও ইফতারি পাঠাতে বাধ্য হয়। প্রয়োজনে আত্মীয় স্বজনদের কাছ থেকে চাঁদা তুলে হলে ও বহুপদের বহু ঢংয়ের ইফতারির পসরা সাজিয়ে মেয়ের বাড়িতে পাঠায়। যাতে হালিম নানা পদের ফলমূল আজওয়া মরিয়ম খেজুরের উপস্থিতি ঘটিয়ে এর শ্রীবৃদ্ধি করা হয়। এই জুলুম কী আমাদের শিক্ষা দেয়? তাকওয়া ও সংযমের মাসে এসব কী করছি?
আরও পড়ুন >>> উৎসবের সর্বজনীন অর্থনীতি
রমজানে রোজাদারদের ইফতার করানোর সুন্নত এবং এর অনেক ফজিলত আছে। রোজাদারকে ইফতার করালে রোজার সম পরিমাণ নেকি ও পাওয়া যায়। যা খেজুর খোরমা এমনকি পানি দ্বারাও হতে পারে এবং এসবের দৃষ্টান্তও আমাদের সমাজে আছে। তর্কের খাতিরে যদি ধরে নেই সওয়াবের আশায় মেয়েপক্ষ ছেলের বাড়িতে প্রতি রমজানে ইফতার পাঠিয়ে থাকে তাহলে সঙ্গতভাবেই প্রশ্ন জাগে ছেলেপক্ষ ও তো সওয়াবের আশায় এবং নেশায় মেয়ের বাবার বাড়িতে প্রতিবছর ইফতার পাঠাতে পারতো। কিন্তু এসবের রেওয়াজ কি আমাদের চোখে পড়ে? এখানটায় অসঙ্গতি এবং বিপত্তি। অথচ মহানবী (সাঃ) বিদায় হজের ভাষণে পরিষ্কারভাবে বলেছেন, কোনো মুসলমানের কাছ থেকে দেওয়া জিনিস ততক্ষণ পর্যন্ত গৃহীত হবে না যতক্ষণ না স্বেচ্ছায় বা মুক্তমনে তা করে থাকে। ঋণ এবং চাঁদা তুলে মেয়ের বাড়িতে ইফতারের সামাজিকতার উপস্থিত থাকলে ও আর যাই হোক স্বেচ্ছায় ও সাগ্রহে একাধিকবার পাঠানোর মানসিকতা থাকার কথা নয়।
ইফতারির এই অপসংস্কৃতি ইসলাম কি সমর্থন করে? যদি ইসলাম সমর্থন করে থাকে তাহলে দেশে বিদেশে কোথাও কি এই প্রথা চালু আছে? এবং এর একমাত্র উত্তর হলো না। তাহলে প্রশ্ন জাগতে পারে শ্বশুরবাড়ির হাড়ি থেকে ইফতারি দিয়ে জামাই পক্ষ মজমা করার রসদ কীভাবে পায়? এই প্রথা কে চালু করলো?
আরও পড়ুন >>> রাজনৈতিক সম্প্রীতির দেশ!
ইফতার রোজাদারদের জন্য পরম আবেগ এবং ভালবাসার উপস্থিতি। এসবে যেমন তৃপ্তি আনন্দ দেয় পাশাপাশি প্রভুর আশীর্বাদ লাভের মওকা ও তৈরি হয়। তা পুণ্যের কাজ। এসবে কি বাধ্য করা যায়?
রমজানের আগমনে প্রতিবারই যেন মেয়ের বাবার অসহায় চাহনি এবং ঋণগ্রস্ত হয়ে সারাবছর দায় টানার প্রবণতা থাকে। তা থেকে মুক্ত হতেই হবে। সময় এসেছে এবং প্রতিটি পরিবারকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে রমজানে মেয়েপক্ষের ইফতারিকে না বলার। এক্ষেত্রে ছেলেপক্ষ যদি মানবিক নৈতিক সহনশীল এবং উদার হয়ে তা গ্রহণ থেকে বিরত থাকে তাহলেই কেবল এই প্রথার বিলোপ হবে।
ড. মোহাম্মদ আলী ওয়াক্কাস সোহেল ।। অধ্যাপক, সমাজকর্ম বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়