রুচির দুর্ভিক্ষ!
মানুষ সামাজিক জীব। সমাজে বসবাসের সুবাদেই পারস্পরিক হৃদ্যতা, আন্তরিকতা, ভালোবাসা, শালীনতা, নম্রতা, শুদ্ধাচার, যৌক্তিক আচরণ এসব প্রপঞ্চ ধারণ করে সামনের দিকে এগিয়ে যায়। এসব যেন মানুষের সৌন্দর্য। যার ছোঁয়ায় মানুষের বাহ্যিক এবং মনোজাগতিকতায় স্বস্তি এবং পরিপূর্ণতার সুবাতাস বহমান থাকে।
তাবৎ দুনিয়ায় এমন কোনো জাতি দেশ রাষ্ট্র পাওয়া যাবে না যেখানটায় এসবের চর্চার ঘাটতি রেখে সুখী সমৃদ্ধশালী হতে পেরেছে। ব্যক্তিত্ব বিকাশের চূড়ান্ত স্তরই হলো রুচির রাজ্যে ধনী হওয়া। যেখানটায় কৃপণতার কোনো সুযোগ নেই। যার ওপর ভর করে আগামী বিনির্মাণের সুযোগ তৈরি হয়। এসবে কোথায় যেন আমাদের ঘাটতি?
জাগতিক উন্নয়নের ঊর্ধ্বমুখী পারদের প্রবণতা সত্ত্বেও মর্যাদা এবং ভূমিকার অসামঞ্জস্যতা এসবে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় আমাদের দৌড় কোন পর্যন্ত! কেন এমন হবে?
সাম্প্রতিক সময়ে জাতীয় পত্রিকা এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে উচ্চশিক্ষার মোড়লদের স্বজনপ্রীতি বিষয়ক সর্বাধিক চর্চিত শিরোনামের আমলনামা এসবে নতুন করে ঘি ঢেলে দিয়েছে। স্বজনপ্রীতি কোনো কালেই কল্যাণ এবং স্বস্তি বয়ে আনতে পারে না। বিনিময় প্রথার এক কালে প্রচলন থাকলেও নতুন করে এসবের চর্চায় সদ্য কর্মরাজ্যে প্রবেশকৃতদের যেভাবে সামাজিক ট্রমায় ফেলা হয়েছে—তা কি চাইলেই মুছে ফেলা যাবে?
আরও পড়ুন >>> বাংলাদেশের সংস্কৃতি ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন
বরং ক্ষমতার সদ্ব্যবহার করে ভালো পাত্রস্থ করাই ছিল শুভবুদ্ধির পরিচায়ক। আর উনারা কী করলেন? এসব মানুষজন প্রতিনিয়ত বঙ্গবন্ধুর আদর্শের কথা বলে মিডিয়ায় ফেনা তোলেন। অথচ এমন বৈপরীত্য কি শোভা পায়?
বঙ্গবন্ধুর দূরদর্শিতা ছিল প্রখর। যিনি বর্তমান এবং ভবিষ্যতকে আপন আলোয় বিশ্লেষণ করতে পারতেন। এক বক্তৃতায় এসব জ্ঞান পাপীদের প্রসঙ্গে বলেন, ‘করাপ্ট পিপলকে সাহায্য করাও করাপশন। নেপোটিজম কিন্তু অ্যা টাইপ অব করাপশন। আপনারা এসব বন্ধ করুন। স্বজনপ্রীতি ছেড়ে দিলে আপনারা করাপশন বন্ধ করতে পারবেন।’ অথচ বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলায় এসবের চর্চা কী করে আজও অব্যাহত আছে? ভাবতে কষ্ট হয়। আর কত অপমানিত হলে এবং নিজের প্রজন্মকে আজীবন ট্রমায় ফেলে দিয়ে ও তৃপ্তির ঢেকুর তুলবেন?
প্রকৃতির অমোঘ নিয়মেই অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত ভোগ করতে হয়। ইতিহাস সাক্ষী, তা থেকে কেউ রেহায় পায় না। এমন কর্মে স্বীয়মহলে মুখ দেখাবেন কিভাবে? শিষ্যরাই বা কী করে শ্রদ্ধা এবং ভক্তির জায়গা ন্যূনতম পর্যায়ে জিইয়ে রাখতে পারে?
সামাজিক অসঙ্গতি অনিয়ম মিথ্যাচার যেন আমাদের হৃদয়ে পোক্ত আসন গেড়ে ফেলেছে। সাম্প্রতিক সময়ে দেখা যায় প্রথিতযশা পণ্ডিতেরা শিক্ষার্থীদের নিয়ে হীন খেলায় মেতে উঠেছেন। যদিও পাঠ্যক্রমে নকল অসঙ্গতি ভুল তথ্য বিষয়ে কর্তা ব্যক্তিরা সহাস্যে দিব্যি বলে বেড়াচ্ছেন এসব পরীক্ষামূলক সংস্করণ যা পরিমার্জন ও সংশোধনের যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে।
আরও পড়ুন >>> সত্যেন সেন : মেহনতি মানুষের মুক্তিসংগ্রামের তূর্যবাদক
এমন দায়সারা গোছের বিবৃতি জনমনে নানা প্রশ্নের সৃষ্টি করছে। সপ্তম শ্রেণির Science Exercise Book বইয়ের অংশ বিশেষ ইন্টারনেট থেকে হুবহু কপি করা হয়েছে। যা স্পষ্টত চৌর্যবৃত্তি। টারশিয়ারি পর্যায়ের পণ্ডিতেরা এসব করে শাস্তির আওতায় এসেছেন বলে জানা নেই। অবক্ষয়ের দৈন্যতা কোথায় গিয়ে পৌঁছেছে? প্রজন্মের কাছে আমরা কী বার্তা দিচ্ছি? একবারও কি ভেবেছি?
গণমাধ্যমে জানলাম হবিগঞ্জ জেলার মাধবপুরের ভারপ্রাপ্ত প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত হয়েছেন। এই ধরনের কাজ সবসময় নিন্দনীয়। প্রশ্ন হলো এলাকাবাসীর মানববন্ধন সুধীমহলের পর্যালোচনা বলে দেয় ডাল মে কুচ কালা হ্যায়—কেন এমন করল? এসব ঘাটলে কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে আসার সম্ভাবনা আছে। অথচ তার পক্ষেই সতীর্থদের আস্ফালন।
একবারও কি ভেবেছেন আমরা যা করছি তা ভেবে চিন্তে করছি? বিবেক বলতে কি কিছু নেই? সত্যকে সত্য বলার সাহস যেন হারিয়ে ফেলছি? এসবে নিজের পিঠ বাঁচানোই যেন প্রধান দায়িত্ব। এখানটায় অবশ্য বঙ্গবন্ধুর উক্তিই যথেষ্ট শক্তিশালী। ‘আমার কৃষক দুর্নীতি করে না, আমার মজদুর দুর্নীতি করে না, দুর্নীতি করে আমাদের শিক্ষিত সমাজ’—প্রেক্ষাপট এবং কার্যকারণই বলে দেবে এমন হওয়ার হেতু কী?
হালে সামাজিক মাধ্যমে শালীনতার অপমৃত্যু দেখে শিহরিত হই। যেখানটায় বিশ্ববিদ্যালয়ের পণ্ডিত ব্যক্তি ভিউ বাড়ানোর খায়েশে টিকটিকারদের সাথে নেচে গেয়ে মর্যাদা এবং ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ করে—সেখানে আর কী বাকি থাকে? অন্যত্র দেখা যায় ক্রেজের সাথে রোল মডেলদের এমন ভঙ্গিমার ছবি যা পারিবারিক অশান্তিরও রসদ হতে পারে—অথচ অবলীলায় এসব অনুশীলন করছি।
মূল্যবোধ, শালীনতা সভ্যতা আজ পশুকেও হার মানাচ্ছে। আগামী প্রজন্ম যাদের অনুসরণ করবে তাদের দৈন্যদশায় আমরা কতটুকু আশাবাদী হতে পারি? একই ছাদের বাসিন্দা হয়েও পরস্পরের মাঝে মানসিক দূরত্ব যেন যোজন যোজন। পরিবার যেন এখন আর সবসময় কাছের নয়। তথ্যপ্রযুক্তির রোবটিক ব্যাপ্তি আমাদের নতুন সম্পর্কের দিগন্ত খুলে দিয়েছে। কত অপরিচিত মানুষ আপন হয়ে যাচ্ছে। যেখানটায় শালীনতা ভদ্রতা এসব প্রপঞ্চ প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। এসব কেন হচ্ছে?
দৃষ্টিভঙ্গি কোথায় গিয়ে ঠেকেছে। একবারও কি ভেবেছি? মসজিদ নির্মাণ এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যানবাহন দান করা জন্যই কি গ্যাসের মিটার রিডার হয়ে দুর্নীতির শীর্ষ খেতাবপ্রাপ্ত হয়েছিলেন? এসব ব্যক্তিরাই দানবীরের তকমায় ভূষিত। যা কি না কেবল হাসির খোরাক জোগায়।
আরও পড়ুন >>> সাংস্কৃতিক অগ্রযাত্রা : চেতনা জাগুক মনে
বিলাস বহুল ফ্ল্যাটে কারা থাকে? ঈদ-পার্বণে দুবাই সিঙ্গাপুরে কারা শপিং করে? ছোট বাবুদের ভ্যন্তরীণ পথে বিমান ভ্রমণের বাতিক কী ইঙ্গিত বহন করে? আয়-ব্যয়ের ফারাকই বলে এসব কীভাবে সম্ভব?
আগামী প্রজন্ম নিয়েও চলছে নানামুখী খেলা। নানা পদের শিক্ষা মাধ্যম। সিলেবাসের বৈপরীত্য। সমন্বয়হীনতা এবং জবাবদিহিতার ফাঁকফোকর গলিয়ে ব্যাঙের ছাতার ন্যায় প্রতিনিয়ত এসবের ব্যাপ্তি বাড়ছে। অভিভাবকেরাও দিশেহারা হয়ে এসবের পেছনে ছুটছে।
কোথায় গেলে দেখা পাবে প্রজন্মের ভবিষ্যতের আলোকচ্ছটা। ভালো মানুষের চেয়ে ভালো নম্বরধারী প্রজন্মই যেন বড্ড প্রয়োজন। জিপিএই যেন ভবিষ্যৎ প্রজন্মের টিকে থাকার একমাত্র মানদণ্ড। যার কারণে গোপনে প্রশ্নপত্র কিনে সন্তানের হাতে বাবা তুলে দিতে দ্বিধা করছেন না। যা সত্যিই সেলুকাস! হাল আমলে বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতে বসে চাকরির প্রস্তুতি চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় আমাদের হীনমন্যতা এবং দীনতা।
তাবৎ দুনিয়ার কোনো লাইব্রেরিতে এমন দৃশ্যের দেখা মিলবে না, যা এদেশে হচ্ছে। বেঁচে থাকার এবং মর্যাদা পাওয়ার আরও অনেক মাধ্যম আছে। সব কাজের মূল্যায়নের অসঙ্গতিই কি এসব লক্ষণ বাঁচিয়ে রাখছে?
শিক্ষিত সমাজ বড়ই আজব প্রজাতি। এরা সত্য কথা বলতে চায় না। নিজের ক্ষতি হোক এবং সহকর্মী কষ্ট পেতে পারে অথবা রোষানলে পড়ার আশঙ্কায় এসবে গা বাঁচিয়ে চলে। আপসকামীতাই হলো এদের প্রধান শক্তি। চাটুকারিতায়ও এরা সিদ্ধহস্ত। বিবেকহীনতা দ্বিচারিতা চোগলখোরিতে খুব মজা পায়। লোভের কাছে সব জলাঞ্জলি দিতে বিবেক বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় না। অতএব এদেরকে পাকড়াও করবেন কীভাবে? যেখানটায় রুচিবোধের বেশ আকাল!
আরও পড়ুন >>> তোমাদের যা বলার ছিল, বলছে কি তা বাংলাদেশ?
নানা সূচকে এগিয়ে যাচ্ছে দেশ। আন্তর্জাতিক এক গবেষণায় উঠে এসেছে ২০৩২ সালে এদেশ বিশ্বের বড় ২৫টি অর্থনীতির দেশের একটি হওয়ার সম্ভাবনা উজ্জ্বল। আশা করা যাচ্ছে ২০৩৩ সালে আমাদের দেশের পেছনে থাকবে মালয়েশিয়া সিঙ্গাপুর ভিয়েতনাম আফ্রিকার মতো দেশ।
এমন সম্ভাবনার সুফল ষোলআনা নেওয়ার জন্য প্রয়োজন সোনার মানুষ। যেখানটাই প্রবল ঘাটতি। নৈতিকতার চর্চা মূল্যবোধের লালন সর্বস্তরে জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণ কাজের মর্যাদার মাধ্যমেই মনোজাগতিক প্রশান্তির পথ সুগম করা সম্ভব। নেতিবাচক প্রপঞ্চকে যদি না বলতে পারি তবেই সুখী সমৃদ্ধ আগামীর সম্ভাবনা দেখতে পাবো। বিশ্বাস এবং আশা বর্তমান প্রজন্ম বেশ সজাগ এবং মেধাবী। তাদের হাতেই রুচির খরার প্রবণতা নিম্নমুখী হবে এবং সুদিন ফিরে আসবে।
ড. মোহাম্মদ আলী ওয়াক্কাস সোহেল ।। অধ্যাপক, সমাজকর্ম বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়