জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশের রাজনীতি কোন পথে?

জুলাই গণঅভ্যুত্থানের অভিঘাতে বদলে যাওয়া বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা এখনো পুরোপুরি স্থিত কোনো ছকে ফিরে আসেনি। একদিকে রাজপথের উত্তাপ, গণমানুষের প্রত্যাশা, ক্ষমতার পুনর্বিন্যাস এবং রাষ্ট্রীয় কাঠামোর ভেতরে সংস্কারের তীব্র আকাঙ্ক্ষা—অন্যদিকে অনিশ্চয়তা, ভয়, প্রতিহিংসা ও সহিংসতার আশঙ্কা। এই জটিল ও বহুমাত্রিক রাজনৈতিক পরিস্থিতির মধ্য দিয়েই দেশ এগোচ্ছে একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড়ের দিকে—আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন। নির্বাচন কমিশনের তফসিল ঘোষণার মাধ্যমে আপাতদৃষ্টিতে একটি রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার বার্তা পাওয়া যাচ্ছে। বহুদিন ধরে অনিশ্চয়তায় থাকা সাধারণ মানুষ, রাজনৈতিক কর্মী এবং আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকরা এই ঘোষণাকে দেখছেন একটি স্বস্তির নিশ্বাস হিসেবে। মনে করা হচ্ছিল, হয়তো দীর্ঘ ফ্যাসিবাদী শাসন ও অস্থিরতার পর দেশ আবার গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মূল ধারায় ফিরতে শুরু করেছে। কিন্তু ঠিক এমনই এক সংবেদনশীল মুহূর্তে ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান হাদির ওপর সশস্ত্র সন্ত্রাসী হামলা সেই আশার আলোকে হঠাৎ করেই আঘাত করেছে।
হাদির ওপর এই হামলা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে দেখার সুযোগ নেই। এটি জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পরবর্তী রাজনৈতিক বাস্তবতার এক ভয়ংকর প্রতিফলন। যে আন্দোলনটি শুরু হয়েছিল গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং রাষ্ট্রীয় জবাবদিহিতার দাবিতে, সেই আন্দোলনের একজন অগ্রভাগের কণ্ঠকে গুলি করে থামিয়ে দেওয়ার চেষ্টা যেন একটি স্পষ্ট বার্তা বহন করে—পরিবর্তনের পথ এখনো মসৃণ নয় বরং তা কণ্টকাকীর্ণ এবং বিপজ্জনক। গুলিবিদ্ধ হয়ে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে থাকা হাদির হাসপাতালের শয্যা কেবল একজন ব্যক্তির যন্ত্রণার প্রতীক নয়; তা যেন পুরো দেশের রাজনৈতিক বিবেকের ওপর পড়ে থাকা এক রক্তাক্ত প্রশ্নচিহ্ন।
জুলাই গণঅভ্যুত্থান ছিল সাম্প্রতিক ইতিহাসের এক ব্যতিক্রমী অধ্যায়। এটি কোনো একক দলের আন্দোলন ছিল না, ছিল বিভিন্ন শ্রেণি-পেশা, মত ও প্রজন্মের মানুষের সম্মিলিত প্রতিবাদ। রাজপথে নেমেছিল শিক্ষার্থী, শ্রমিক, পেশাজীবী, সাংস্কৃতিক কর্মী, এমনকি দীর্ঘদিন রাজনীতি থেকে দূরে থাকা সাধারণ নাগরিকও। হাদির মতো মুখপাত্ররা স্পষ্ট ভাষায় কথা বলেছিলেন ক্ষমতার অপব্যবহার, দমন-পীড়ন এবং রাজনৈতিক অচলাবস্থার বিরুদ্ধে। তার কণ্ঠে ছিল তীব্রতা, কিন্তু একই সঙ্গে ছিল যুক্তি ও মানবিক আবেদন। এই কারণেই তিনি হয়ে উঠেছিলেন অনেকের কাছে আশার প্রতীক, আবার অনেকের কাছে অস্বস্তির নাম।
আসন্ন নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর রাজনৈতিক মাঠে যে আপাত শান্তির আবহ তৈরি হয়েছে, তা অত্যন্ত ভঙ্গুর। বড় রাজনৈতিক দলগুলো হিসাব-নিকাশে ব্যস্ত, জোট গঠনের গুঞ্জন, প্রার্থী বাছাই, কৌশল নির্ধারণ—সব মিলিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গন এক ধরনের নীরব উত্তেজনায় ভরপুর। এই সময়ে সহিংস কোনো ঘটনার আশঙ্কা বটে, কিন্তু ইনকিলাব মঞ্চের একজন মুখপাত্রের ওপর সরাসরি সশস্ত্র হামলা পরিস্থিতিকে এক ধাক্কায় অন্য মাত্রায় নিয়ে গেছে। এটি শুধু একটি রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনা নয়, বরং নির্বাচনী পরিবেশ, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং নাগরিক নিরাপত্তা নিয়ে গভীর প্রশ্ন তুলে দিয়েছে।
হামলার পরপরই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে আতঙ্ক ও ক্ষোভ। অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন—যদি জুলাই গণঅভ্যুত্থানের একজন পরিচিত মুখ এভাবে প্রকাশ্যে হামলার শিকার হন, তবে সাধারণ কর্মী বা সাধারণ নাগরিকের নিরাপত্তা কোথায়? আবার কেউ কেউ একে দেখছেন একটি পরিকল্পিত রাজনৈতিক বার্তা হিসেবে, যেখানে ভয়ের মাধ্যমে কণ্ঠ রোধ করার চেষ্টা চলছে। হাসপাতালে জীবন-মৃত্যুর সঙ্গে লড়তে থাকা হাদির অবস্থা যেন সেই ভয় ও অনিশ্চয়তাকে আরও ঘনীভূত করেছে।
এই হামলা প্রমাণ করে যে, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে যে ক্ষমতার পরিবর্তন এসেছে, তা এখনো পুরোপুরি মেনে নিতে পারেনি কিছু শক্তি। নির্বাচন সামনে রেখে তারা হয়তো নতুন করে নিজেদের অবস্থান শক্ত করতে চাইছে এবং সেই পথে বাধা হিসেবে যারা দাঁড়াচ্ছে, তাদের ভয় দেখানো বা সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে। এই বিশ্লেষণ সত্য হোক বা না হোক, একটি বিষয় অস্বীকার করার উপায় নেই—এই হামলা দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে গভীর উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা সৃষ্টি করেছে।
সরকারি মহল থেকে নিন্দা জানানো হয়েছে, দ্রুত তদন্তের আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সাধারণ মানুষের মনে প্রশ্ন—এই আশ্বাস কতটা কার্যকর হবে? অতীত অভিজ্ঞতা খুব আশাব্যঞ্জক নয়। বহু রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনায় তদন্ত ঝুলে গেছে, দোষীরা ধরা পড়েনি বা ধরা পড়লেও বিচার হয়নি। ফলে হাদির ওপর হামলার ঘটনায় কেবল নিন্দা আর আশ্বাসে সন্তুষ্ট হতে রাজি নয় নাগরিক সমাজ। তারা চাইছে দৃশ্যমান ও বিশ্বাসযোগ্য পদক্ষেপ, যাতে প্রমাণ হয় রাষ্ট্র সত্যিই নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চায়।
এই ঘটনার প্রভাব পড়ছে নির্বাচনী রাজনীতিতেও। অনেক রাজনৈতিক কর্মী এখন প্রকাশ্যে প্রচারে নামতে ভয় পাচ্ছেন। সভা-সমাবেশে অংশগ্রহণ নিয়ে দ্বিধা তৈরি হয়েছে। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময় যে সাহসিকতা ও ঐক্য দেখা গিয়েছিল, তা যেন আবারও পরীক্ষার মুখে। প্রশ্ন উঠছে—এই নির্বাচন কি সত্যিই একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও সহিংসতামুক্ত পরিবেশে অনুষ্ঠিত হবে? নাকি ভয়ের রাজনীতিই আবারও প্রাধান্য পাবে?
হাদির ব্যক্তিগত জীবনও এই ঘটনায় নতুন করে আলোচনায় এসেছে। তার রাজনীতি ছিল বক্তব্য নির্ভর, যুক্তিনির্ভর। এমন একজন মানুষকে গুলি করার ঘটনা রাজনীতির নিষ্ঠুরতাকেই সামনে নিয়ে আসে। তার পরিবার, সহকর্মী, সমর্থক—সবাই আজ উৎকণ্ঠায় দিন কাটাচ্ছে। হাসপাতালের বাইরে ভিড় করা মানুষদের চোখে চোখে একটাই প্রশ্ন—তিনি কি বেঁচে ফিরবেন? আর যদি ফিরেও আসেন, এই রাজনীতি কি তাকে নিরাপদে কথা বলতে দেবে?
এই হামলা কেবল বর্তমান সংকট নয়, এটি ভবিষ্যতের জন্যও এক অশনিসংকেত। যদি এমন ঘটনার যথাযথ বিচার না হয়, তাহলে তা সহিংসতাকে উৎসাহিত করবে। রাজনীতিতে অংশগ্রহণের জায়গা সংকুচিত হবে, সাহসী কণ্ঠগুলো নীরব হয়ে যাবে। জুলাই গণঅভ্যুত্থান যে স্বপ্ন দেখিয়েছিল—একটি ভয়মুক্ত, ন্যায়ভিত্তিক রাজনৈতিক সংস্কৃতি—তা তখন ক্রমেই ফিকে হয়ে যাবে।
তবে একই সঙ্গে এই ঘটনা নতুন করে প্রতিবাদের ভাষাও তৈরি করতে পারে। ইতিহাস বলে, অনেক সময় সহিংসতা মানুষকে দমিয়ে রাখতে পারেনি, বরং আরও দৃঢ় করেছে। হাদির ওপর হামলার পর যেভাবে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ একাত্মতা প্রকাশ করছে, তা সেই সম্ভাবনারই ইঙ্গিত দেয়। প্রশ্ন হলো, রাষ্ট্র ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব কোন পথে হাঁটবে—ভয়ের রাজনীতিকে প্রশ্রয় দেবে, নাকি এই সংকটকে ব্যবহার করবে একটি নিরাপদ ও গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক পরিবেশ গড়ে তুলতে?
আসন্ন নির্বাচন কেবল একটি সাংবিধানিক প্রক্রিয়া নয়, এটি জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর দেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নির্ধারণের একটি পরীক্ষা। এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হলে কেবল তফসিল ঘোষণা যথেষ্ট নয়। প্রয়োজন সহিংসতার বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান, ভিন্নমতের প্রতি সহনশীলতা, এবং নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দৃঢ় অঙ্গীকার। শরীফ ওসমান হাদির রক্তাক্ত শরীর যেন সেই দায়বদ্ধতার কথাই মনে করিয়ে দিচ্ছে।
দেশ আজ এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। একদিকে নির্বাচনের সম্ভাব্য আলো, অন্যদিকে রাজনৈতিক সহিংসতার অন্ধকার। এই দুইয়ের সংঘাতে কোনটি জয়ী হবে, তা নির্ভর করবে রাষ্ট্রের সিদ্ধান্ত, প্রচলিত ও পতিত রাজনৈতিক শক্তিগুলোর আচরণ এবং নাগরিক সমাজের ভূমিকার ওপর। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের চেতনা যদি সত্যিই টিকে থাকে, তবে হাদির ওপর হামলা একটি দুঃখজনক অধ্যায় হলেও তা শেষ কথা হবে না। বরং তা হয়ে উঠতে পারে একটি নতুন জাগরণের সূচনা, যেখানে ভয় নয়, ন্যায় ও সাহসই রাজনীতির মূল ভাষা হয়ে উঠবে।
ড. খালিদুর রহমান : অধ্যাপক, পরিসংখ্যান বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়