সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তরুণেরা বেশি আসক্ত কেন?
বিশ্বায়ন এবং ডিজিটালাইজেশনের যুগে, সোশ্যাল মিডিয়া বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম আমাদের জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে। সারা বিশ্বের মানুষের সাথে সংযোগ স্থাপন এবং তথ্য আদান-প্রদান তথা সামাজিক যোগাযোগের জন্য একটি প্ল্যাটফর্ম।
করোনাকালে ও এর পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশে, বিশেষ করে শহরাঞ্চলে তরুণদের মধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রতি আসক্তি মহামারি আকারে দেখা দিয়েছে যার বিরূপ প্রভাব ক্রমবর্ধমান উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠেছে।
ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম এবং টুইটারের মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোর অত্যধিক ব্যবহার উদ্বেগ, বিষণ্নতা, একাকিত্ব এবং হীনমন্যতাসহ বিভিন্ন মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যাকে প্রকট করে তুলছে।
আরও পড়ুন : পাবজি : অনলাইন গেইমের রীতিনীতি ও অর্থনীতি
সর্বশেষ আদমশুমারির তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৬৬ মিলিয়নেরও বেশি। দ্রুত নগরায়নের ফলে শহরের জনসংখ্যাও দ্রুত বাড়ছে। আর প্রযুক্তির উন্নয়ন ও সহজ প্রাপ্যতার ফলে ক্রমবর্ধমান হারে বাড়ছে স্মার্টফোনের ব্যবহার।
বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অফ মেন্টাল হেলথ দ্বারা পরিচালিত একটি সমীক্ষা থেকে জানা যায়, শহরে বসবাসকারী বাংলাদেশিদের মধ্যে ৬২ শতাংশ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আসক্ত, যা উদ্বেগজনক।
শুধু তাই নয়, ২০২১ সালে ৫২০ জন বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া যুবকদের নিয়ে করা একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে, কোভিড-১৯-এর সময় অনেক বাংলাদেশি যুবক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আসক্ত হয়ে পড়ে, যারা বর্তমানে বিভিন্ন মানসিক স্বাস্থ্যজনিত সমস্যায় ভুগছে। অপর আরেকটি সমীক্ষায় দেখা গেছে যে ৪০ শতাংশ বাংলাদেশি শিক্ষার্থী ফেসবুকে আসক্ত। স্মার্টফোনের সহজলভ্যতা এবং সাশ্রয়ী মূল্যের ইন্টারনেট, সোশ্যাল মিডিয়ার আসক্তি বৃদ্ধিতে অবদান রাখছে বলে অভিমত প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞগণ।
খেলার মাঠ, সুস্থ সাংস্কৃতিক চর্চা এবং বিনোদনের অন্যান্য উৎসের অভাবে, বর্তমান সময়ের তরুণেরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিনোদন খোঁজে। ক্ষণে ক্ষণে নোটিফিকেশন দেখা কিংবা লাইক-কমেন্টের মাধ্যমে নিজেদের মূল্যায়ন করা এবং অন্যদের সাথে নিজেকে তুলনা করার এক বিষাক্ত চক্রে আটকে গেছে তারা, যা তাদের মানসিক স্বাস্থ্যকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করছে।
তাছাড়া, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অন্যদের জীবনের যত্ন সহকারে কিউরেট করা ছবি এবং হাইলাইটগুলোর ক্রমাগত এক্সপোজারের ফলে তাদের মধ্যে নিজের জীবনের অপূর্ণতা নিয়ে অসন্তুষ্টি তৈরি করে।
আরও পড়ুন : মুঠোফোনে আসক্তি বাড়ার কারণ কী?
মেডিকেল ইন্টারনেট রিসার্চ জার্নালে প্রকাশিত গবেষণায় দেখা গিয়েছে, বাংলাদেশি যুবকদের মধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আসক্তি, উদ্বেগ এবং বিষণ্নতার লক্ষণগুলোর মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য সম্পর্ক পরিলক্ষিত হয়েছে। গবেষণায় দেখা যায় যে, ঘন ঘন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারীদের মধ্যে ৬৪শতাংশ একাকিত্ব, ৩৮ শতাংশ বিষণ্নতা, ৬৩ শতাংশ উদ্বেগ এবং ৭৫ শতাংশ ঘুমের ব্যাঘাতজনিত সমস্যায় আক্রান্ত।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের একটি উদ্বেগজনক দিক হলো এডিটিং ও ফিল্টারের ব্যবহারের মাধ্যমে অবাস্তব সৌন্দর্য প্রদর্শনের ঝোঁক। এই ধরনের ছবি এবং ভিডিও দেখার ফলে তরুণ-তরুণীরা নিজেদের শারীরিক গঠন এবং চেহারা নিয়ে হীনমন্যতায় ভোগে।
বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অফ হেলথ সায়েন্সেস দ্বারা পরিচালিত একটি সমীক্ষায় শহরে বসবাসকারী বাংলাদেশিদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আসক্তি, শারীরিক গঠন ও চেহারা নিয়ে নেতিবাচক ধারণার মধ্যে সরাসরি যোগসূত্র পাওয়া গেছে। একটি বিশাল ভার্চুয়াল নেটওয়ার্কের সাথে সংযুক্ত থাকা সত্ত্বেও, সোশ্যাল মিডিয়া আসক্তি প্রায়শই একাকিত্ব এবং বিচ্ছিন্নতার অনুভূতি বাড়ায়।
অনলাইনে অত্যধিক সময় ব্যয় করার ফলে বাস্তব জীবনের সামাজিক সম্পর্ক এবং বন্ধনগুলো ধীরে ধীরে শিথিল হতে থাকে, যার ফলে তরুণেরা অর্থপূর্ণ সম্পর্ক, যোগাযোগের অভাববোধ করে এবং আশেপাশের জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এই ঘটনাগুলো বাংলাদেশের শহরে এলাকায় বিশেষভাবে পরিলক্ষিত হয়েছে, যেখানে দ্রুত নগরায়ন সামাজিক কাঠামোকে ব্যহত করছে।
এছাড়া সাম্প্রতিক বছরগুলোয়, স্বল্পদৈর্ঘ্যের ভিডিও ক্লিপ এবং রিলের জনপ্রিয়তা তরুণদের কর্মক্ষমতা এবং মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে। যেহেতু এই ছোট ভিডিওগুলো আসক্তি-সৃষ্টিকারী, তাই তরুণেরা প্রায়শই গুরুত্বপূর্ণ কাজে মনঃসংযোগ করতে পারে না।
আরও পড়ুন : সাইবার বুলিংয়ের শিকার শিশু থেকে তারকা : সমাধান কোথায়?
এই ভিডিওগুলো ক্রমাগত উদ্দীপনার আসক্তি বাড়িয়ে দেওয়ার কারণে, যুব সমাজ দীর্ঘক্ষণ কাজে মনোনিবেশ করা বা চিন্তাভাবনা করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। ফলস্বরূপ, লেখাপড়া এবং কাজের প্রতি তাদের আগ্রহ হ্রাস পায়, অগ্রগতি এবং দক্ষতা বাধাগ্রস্ত হয়।
শহরে বসবাসরত বাংলাদেশি যুবকদের মধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রতি আসক্তি হ্রাস করার জন্য একটি বহুমুখী পদ্ধতির প্রয়োজন, যা ব্যক্তি এবং সমাজ উভয় থেকে আসক্তি হ্রাস করবে।
প্রথমত, ডিজিটাল স্বাক্ষরতা প্রচার এবং দায়িত্বশীল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার একটি অগ্রাধিকার হওয়া উচিত। অত্যধিক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারের সম্ভাব্য ঝুঁকি সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে এবং স্বাস্থ্যসম্মতভাবে অনলাইন অভ্যাস শেখানোর জন্য শিক্ষামূলক প্রচারাভিযান চালানো যেতে পারে।
বিকল্প অফলাইন ক্রিয়াকলাপ তৈরি করা এবং একটি অংশগ্রহণমূলক পরিবেশ তৈরি করা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে মনোযোগ সরাতে সাহায্য করতে পারে। খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, স্বেচ্ছাসেবামূলক কাজ এবং অন্যান্য আকর্ষক ক্রিয়াকলাপগুলোয় অংশগ্রহণ উৎসাহিত করার মাধ্যমে ভার্চুয়াল জগতের উপর নির্ভরতা হ্রাস করা যেতে পারে।
আরও পড়ুন : সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস কীভাবে ছড়ায়?
এছাড়া পিতামাতা, শিক্ষক এবং নীতিনির্ধারকদের অবশ্যই সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারের সীমা নির্ধারণ এবং উপদেশ পালনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে। স্কুল, কলেজে সোশ্যাল মিডিয়ার নিরাপদ ব্যবহারের জন্য নির্দেশিকা তৈরি করা, অভিভাবকদের জন্য তাদের বাচ্চাদের অনলাইন কার্যকলাপের উপর নজরদারি করার জন্য কর্মশালার আয়োজন করা এবং পাঠ্যক্রমে ডিজিটাল সুস্থতা বিষয়ক শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে।
এক্ষেত্রে, মোবাইল ফোন এবং অন্যান্য প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো একসাথে এসব প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে কাজ করতে হবে। সর্বোপরি, সোশ্যাল মিডিয়া আসক্তির এই সমস্যার গুরুত্ব অনুধাবন করে ব্যক্তি, পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং নীতিনির্ধারকদের সুস্থ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যাবহারের অভ্যাস করতে হবে।
সেই সাথে মানসিক স্বাস্থ্যকে অগ্রাধিকার দিতে একসঙ্গে কাজ করা অপরিহার্য। অনলাইন ও বাস্তব জীবনের একটি ভারসাম্য গড়ে তোলার মাধ্যমে বাংলাদেশের নগর এলাকার মানসিক স্বাস্থ্যের উপর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম আসক্তির বিরূপ প্রভাব কমানো যেতে পারে।
ডা. মো. শামীম হায়দার তালুকদার (সিইও) ও ফাতিমা তুজ যাহরা (গবেষণা সহকারী) ।। এমিনেন্স এসোসিয়েটস ফর সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট