চতুর্থ শিল্পবিপ্লব ও স্মার্ট বাংলাদেশ
সভ্যতার ইতিহাসে একেকটি শিল্পবিপ্লব মানুষের জীবনকে নতুন নতুন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। বর্তমানে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব সমাগত। আগামীর বাংলাদেশকে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সাথে সম্পৃক্ত করার জন্য ইতিমধ্যে শেখ হাসিনার নেতৃত্বের আওয়ামী লীগ সরকার ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ বিনির্মাণের অঙ্গীকার করেছে।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্ন ছিল ক্ষুধা ও দুর্নীতিমুক্ত, সুখী-সমৃদ্ধ ‘সোনার বাংলা’ নির্মাণের। সেই লক্ষ্যে তিনি উচ্চশিক্ষাকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তিনি গবেষণা ও মুক্তবুদ্ধি চর্চার সূতিকাগার করে গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন প্রদান করেছিলেন।
মহান মুক্তিযুদ্ধে ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও এদেশীয় দোসরদের হাতে নিহত বুদ্ধিজীবীদের যে শূন্যতা তৈরি হয়েছিল, বঙ্গবন্ধু দেশ স্বাধীনের পর তা পূরণ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু স্বাধীনতা বিরোধীচক্রের ক্রমাগত ষড়যন্ত্রে এবং তাকে সপরিবারে নৃশংস হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে জাতির পিতার সেই স্বপ্ন অল্পদিনেই ভেঙে যায়। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর বাংলাদেশ পুনরায় অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়।
আরও পড়ুন
১৯৮১ সালে বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনা দেশে ফিরে পিতার স্বপ্ন বাস্তবায়নে রাজপথে লড়াই-সংগ্রাম শুরু করেন। ১৯৯৬ সালে দীর্ঘ একুশ বছর পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে জাতির পিতার অসমাপ্ত স্বপ্ন বাস্তবায়নে রূপরেখা প্রণয়ন করে। ১৯৯৬ থেকে ২০০১ পর্যন্ত সময়কালে দেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনে শেখ হাসিনা সরকার ব্যাপক উদ্যোগ ও পরিকল্পনা গ্রহণ করে।
২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ৩০০ আসনের মধ্যে ২৩০টি আসনে জয়লাভ করে সরকার গঠন করে। শপথ গ্রহণ করার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রথমেই দীর্ঘমেয়াদে বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে ব্যাপক পরিকল্পনা গ্রহণ করেন।
প্রথমেই তিনি কলকারখানা ও শিল্প-বাণিজ্য প্রসারে বিদ্যুৎ খাতে গুরুত্ব প্রধান করেন। ফলে জোট সরকারের সময়ে প্রায় বন্ধ হতে যাওয়া কলকারখানা সচল হয় বিদ্যুতের উৎপাদন বৃদ্ধিতে; ব্যবসা-বাণিজ্য প্রাণ ফিরে পায়। এই সময় বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে চলার জন্য ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ নির্মাণের রূপরেখা প্রণয়ন করা হয়।
দশম ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পুনরায় বিজয়ী হয়ে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ নির্মাণের অঙ্গীকার বাস্তবায়ন করে সরকারি সেবাগুলো সহজ এবং দ্রুততর করেছে, যা তাদের দক্ষতা এবং উৎপাদনশীলতা বাড়াতে সাহায্য করেছে এবং ধারাবাহিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে সহায়ক হিসেবে কাজ করেছে।
বর্তমানে বিভিন্ন সেক্টরে ডিজিটালাইজেশনের সুবিধা পাচ্ছে জনগণ; এর ফলে যাতায়াত খরচ-শ্রম হ্রাস সম্ভব হয়েছে। যার ফলে দেশে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ছে এবং নতুন কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হচ্ছে।
আরও পড়ুন
বিপুল জনসমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় এসেই শেখ হাসিনা সরকার যোগাযোগ খাতে অভূতপূর্ব উদ্যোগ গ্রহণ করে। এর একটি মাইলফলক, পদ্মাসেতু নির্মাণে বিশ্বব্যাংকের সরে যাওয়ার পরও নিজস্ব অর্থায়নে এটি নির্মাণ। সরকারের দৃঢ় সাহসে পদ্মাসেতু নির্মাণের ফলে দক্ষিণবঙ্গের ১২টি জেলা সরাসরি উপকৃত হয়।
আওয়ামী লীগের টানা তিন মেয়াদে সরকারে থাকার ফলে দেশের জনগণ বাংলাদেশের উন্নয়নের মহাযাত্রা অবলোকন করতে সক্ষম হয়। বিশ্বমঞ্চে বাংলাদেশ এখন ‘দক্ষিণ এশিয়ার উদীয়মান ব্যাঘ্র’ হিসেবে অভিহিত হচ্ছে। বর্তমান সরকারের সামাজিক নিরাপত্তার আওতাধীন বিভিন্ন উদ্যোগ দরিদ্রতা দূরীকরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। মুজিব জন্মশতবর্ষে নেওয়া ‘গৃহহীনদের জন্য আশ্রয়ণ প্রকল্প’ উদ্যোগ বাংলাদেশের ইতিহাসে এক বিরল দৃষ্টান্ত।
বর্তমানে বাংলাদেশ এক নতুন অভিজ্ঞার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। যদিও ইতিমধ্যে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব নিয়ে সরকার নানা উদ্যোগ নিচ্ছে। দেশের তরুণ সমাজকে এই শিল্পবিপ্লবে উদ্দীপ্ত করে দক্ষ কারিগর হিসেবে গড়ে তোলার জন্য আরও বহুমুখী পরিকল্পনা নিতে হবে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার এই যুগে অচিরে শ্রমজীবী শ্রেণি প্রথাগত পেশা বদলের হুমকিতে পড়বে। তথ্য-প্রযুক্তির প্রতিনিয়ত নিত্য-নতুন আবিষ্কার ও ব্যবহার মানুষের চিন্তাজগত দিন দিন বদলে দিচ্ছে।
চতুর্থ শিল্পবিপ্লরের যুগে সাইবার সিকিউরিটি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, রোবটিক্স, ন্যানো-বায়োটেকনোলজি, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং, বিগ ডাটা, ইলেকট্রিক গাড়ি, পঞ্চম প্রজন্মের তারবিহীন প্রযুক্তি, ত্রিমাত্রিক প্রিন্টিং, ডিজিটাল মুদ্রাব্যবস্থা, ব্লকচেইন এবং প্রাত্যহিক জীবনে উচ্চ প্রযুক্তির ব্যবহার ইতোমধ্যে উন্নত বিশ্বে শুরু হয়ে গেছে।
আগামীর স্মার্ট বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে গড়ে ওঠতে হলে বিশ্বব্যবস্থার সাথে আমাদেরও খাপ খাইয়ে নিতে হবে। তথ্য-প্রযুক্তিনির্ভর উন্নত, সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে বিশ্বের বুকে স্থান করে নেওয়ার মতো যোগ্যতা ও সক্ষমতা বাংলাদেশের রয়েছে। আশার কথা এই যে, বর্তমান সরকার ভিশন ২০২১ পূরণে সফলতা দেখিয়েছে।
একটি উন্নত, সমৃদ্ধ ও উদ্ভাবনী দেশের মর্যাদা লাভের জন্য ভিশন ২০৩০, ভিশন ২০৪১, ভিশন ২০৭১ এবং ডেল্টা প্ল্যান ২১০০ ইত্যাদি লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে এই সরকার কাজ করছে। এইসব লক্ষ্যমাত্রা পূরণের জন্য মানবিক, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জ্ঞান সম্পন্ন নাগরিকের প্রয়োজন সবচেয়ে অধিক।
আরও পড়ুন
২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত এবং স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে বর্তমান সরকার চারটি মৌলিক ভিত্তি ঠিক করেছে। যেমন—(১) স্মার্ট সিটিজেন, (২) স্মার্ট ইকোনমি, (৩) স্মার্ট গভর্নমেন্ট এবং (৪) স্মার্ট সোসাইটি।
এই উদ্দেশ্য পূরণ করতে হলে কিছু চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে বৈকি! প্রথমেই গুরুত্ব দিতে হবে গবেষণায়। উন্নত বিশ্ব তাদের উদ্ভাবনী মেধা ও গবেষণাকে কাজে লাগিয়ে অর্থনৈতিকভাবে বিপুল লাভবান হচ্ছে—যার অন্যতম উদাহরণ কোভিড-১৯ এর টিকা আবিষ্কার।
তারা তথ্য-প্রযুক্তির বিভিন্ন সেবা রপ্তানির মাধ্যমেও বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আহরণ করছে। ফলে বর্তমানে অন্যান্য অগ্রসরমান উন্নত এবং দ্রুত উন্নয়নশীল দেশগুলোও গবেষণায় ঝুঁকছে এবং তারা মোট জিডিপির ১ থেকে ৩ শতাংশের বেশি এবং ব্যয় করছে। তাই বাংলাদেশে বসে থাকার বিন্দুমাত্র সময় নেই। আমাদের গবেষণায় বাজেট বরাদ্দ বৃদ্ধি করতে হবে।
পরিশেষে, দেশীয় ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও বাঙালিত্ব ধরে না রাখলে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের ফল বাংলাদেশের কোনো কাজে আসবে না। ৩০ লাখ শহীদ ও দুই লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রমে পাওয়া আমাদের স্বাধীনতা। আমাদের তরুণ প্রজন্মকে বাঙলা ও বাঙালিত্বকে ভুলে গেলে চলবে না।
প্রযুক্তির ভোক্তা হলো মানুষ—চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের যুগে স্বতন্ত্র জাতি হিসেবে নিজেদের পরিচয় ধরে রাখতে হলে দেশীয় কৃষ্টি-কালচারকে ভুলে গেলে চলবে না। বাংলাদেশের উন্নয়নের গতিপথ ঠিক রাখতে বাংলাদেশকে ধারণ করে এমন সরকার আবার ক্ষমতায় আসা দরকার। অন্যথায় দেশ আবার পেছনের দিকে যেতে পারে। এই বিষয়ে সকলেকে সজাগ থাকতে হবে।
ড. শেখ মাশরিক হাসান ।। সহযোগী অধ্যাপক, ফিন্যান্স বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়