বাংলাদেশের চন্দ্রবিজয় : স্বপ্ন নাকি সত্যি?
৭ অক্টোবর ২০২৩, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর টার্মিনাল-৩ এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘আশেপাশের দেশ চাঁদে চলে যায়, আমরা কেন পিছিয়ে থাকব? ভবিষ্যতে বাংলাদেশ চাঁদেও যাবে।’ বর্তমান বাস্তবতায় প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যে আশাবাদী হওয়ার মতো মানুষ আমাদের দেশে হয়তো খুব বেশি পাওয়া যাবে না। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্য অত্যন্ত সাহসী এবং তাৎপর্যপূর্ণ।
আমাদের দেশে চাঁদকে নিয়ে যে পরিমাণ কবিতা আর গান রচিত হয়েছে তার সমকক্ষ অন্য কোনো দেশের সাহিত্যে রচিত হয়েছে কি না তা নিয়ে গবেষণা হতে পারে। তবে ঈদের সময় ‘জাতীয় চাঁদ দেখা কমিটি’র চাঁদ দেখার ঘোষণা ছাড়া অন্য কোনো সময়ে চাঁদের ব্যাপারে আমাদের আগ্রহ ছিল খুবই সীমিত। কিন্তু, সাম্প্রতিককালে এই পরিস্থিতির নাটকীয় পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়।
২৩ আগস্ট ২০২৩, ভারতের মহাকাশ গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইন্ডিয়ান স্পেস রিসার্চ অর্গানাইজেশন (ইসরো) তাদের মহাকাশযান চন্দ্রযান-৩-কে চাঁদের বুকে অবতরণ করাতে সক্ষম হন। নানান দিক থেকেই এটি ভারতের জন্য অনন্য এক অর্জন।
প্রথমত, ভারতের আগে কেবলমাত্র তিনটি দেশ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া এবং চীন, চাঁদে কোনো মহাকাশযান সফলভাবে অবতরণ করাতে পেরেছিল। দ্বিতীয়ত, চাঁদের দক্ষিণ মেরু অঞ্চল, যেখানে হিমায়িত পানি থাকার সম্ভাবনার কথা বিজ্ঞানীরা বহুদিন থেকে বলে আসছেন, সেই অঞ্চলে সারা বিশ্বে প্রথম দেশ হিসেবে ভারত চন্দ্রযান-৩-কে অবতরণ করাতে সক্ষম হয়।
আরও পড়ুন
শুধু তাই নয়, এই অভিযানে ভারত সম্পূর্ণ নিজস্ব প্রযুক্তি ব্যবহার করে এবং মাত্র ৬১৫ কোটি ভারতীয় রুপি খরচ হয়। একটি যুগান্তকারী সফল মহাকাশ অভিযান হিসেবে এই প্রকল্প অত্যন্ত সাশ্রয়ী। উদাহরণস্বরূপ, সাম্প্রতিককালে হলিউডের ব্যবসাসফল সিনেমা ‘বার্বি’র নির্মাণে যা খরচ হয়েছে, তার অর্ধেক লেগেছে এই মহাকাশ অভিযান পরিচালনা করতে।
সারা বিশ্বেই এই খবর আলোড়ন সৃষ্টি করে। মূলধারার সংবাদমাধ্যম থেকে শুরু করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, সবখানেই ভারতের এই অর্জনকে ফলাও করে ছাপানো হয় এবং ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ইসরো সমগ্র বিশ্বের মহাকাশ গবেষণা উৎসাহী মানুষদের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। স্বাভাবিকভাবেই সেই আলোচনার ঢেউ এসে লাগে আমাদের বঙ্গীয় ব-দ্বীপেও।
প্রাথমিকভাবে অভিনন্দন এবং প্রশংসা দিয়ে এই বিষয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোচনা শুরু হয় কিন্তু খুব শিগগিরই সেই আলোচনা মোড় নেয় ভিন্ন দিকে। হঠাৎ করেই আমরা আবিষ্কার করি যে আমাদের দেশেও একটি মহাকাশ গবেষণা সংস্থা রয়েছে যার নাম বাংলাদেশ স্পেস রিসার্চ অ্যান্ড রিমোট সেন্সিং অর্গানাইজেশন (স্পারসো)। অনতিবিলম্বে ইসরোর সাফল্যের চেয়ে স্পারসোর ব্যর্থতার আলোচনা আমাদের দেশে বেশি জনপ্রিয়তা পায়।
আলোচনার পরের ধাপে আসে স্পারসোর চেয়ারম্যান মো. আব্দুস সামাদের নাম। অনুসন্ধিৎসু জাতি খুঁজে বের করে যে আব্দুস সামাদ কোনো মহাকাশ বিজ্ঞানী নন বরং বিসিএস (প্রশাসন) পঞ্চদশ ব্যাচের একজন কর্মকর্তা। এছাড়া শিক্ষা জীবনে তিনি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কৃষি বিষয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী।
আমাদের দেশের সদ্যোজাত মহাকাশপ্রেমীরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাদের ক্ষোভের উদ্গিরণ ঘটাতে শুরু করেন এবং সরকার যখন আব্দুস সামাদকে স্পারসোর চেয়ারম্যানের পদ থেকে অব্যাহতি দিয়ে অন্য পদে পদায়িত করেন, তখন এক প্রকার চন্দ্রজয়ের অনুভূতি নিয়ে তারা ক্ষান্ত হন। ধীরে ধীরে এই বিষয়ক আলোচনা স্তিমিত হয়ে পড়ে। ঠিক এমন সময়ে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যটি তাই বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ।
কোন প্রেক্ষাপট বিবেচনায় সরকার আব্দুস সামাদকে স্পারসোর চেয়ারম্যানের পদ থেকে সরিয়ে নিয়েছেন তা স্পষ্ট নয়। তবে মহাকাশ গবেষণা মানেই মহাকাশে কৃত্রিম উপগ্রহ, চাঁদে কিংবা বিভিন্ন গ্রহ-উপগ্রহে মহাকাশযান পাঠানো নয়। আমরা যদি স্পারসোর কাঠামোর দিকে তাকাই তাহলে দেখব সেইখানে যে ১৩টি বিভাগ রয়েছে তার মধ্যে কৃষি, পানি সম্পদ, বন, ভূ-তত্ত্ব, মৎস্য, সমুদ্র বিজ্ঞান, বায়ুমণ্ডল, এগ্রো অ্যান্ড হাইড্রোমেটিওরোলোজি নামের বিভাগ রয়েছে ৮টি।
দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে এই পর্যন্ত স্পারসোর যতটুকু অবদান সেইটুকু গ্রহ-উপগ্রহে মহাকাশযান প্রেরণ করে নয় বরং মূলত মহাকাশ ও কৃত্রিম উপগ্রহ থেকে প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে কৃষি, পানি সম্পদ, বন এবং অন্যান্য ক্ষেত্রসমূহে প্রয়োগ এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ পরিবীক্ষণ ও পূর্বাভাস প্রদানের মাধ্যমেই এসেছে।
প্রকৃতপক্ষে, স্পারসোর মিশন, ভিশন ও কর্মপরিধি বিবেচনায়, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কৃষি বিষয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন আব্দুস সামাদের স্পারসোর চেয়ারম্যানের পদে পদায়নের কোনো অযোগ্যতা হিসেবে বিবেচনা করা যায় কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ রয়েছে। আর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ট্রল আর নেতিবাচক সমালোচনার যে নতুন ধারা তৈরি হয়েছে তা তুষ্ট করার অভিপ্রায়ে যদি তাকে অপসারণ করা হয়ে থাকে তবে সেইটিও সমর্থন যোগ্য নয়।
আরও পড়ুন
স্পারসো-চেয়ারম্যানের অপসারণ যদি অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনের জন্য যথেষ্ট না হয়ে থাকে তবে অর্জনের উপায় কী? সেই আলোচনায় যাওয়ার পূর্বে, ইসরো কীভাবে তাদের সফলতা অর্জন করল সেই বিষয়ে কিছুটা আলোকপাত করা যাক। ১৯৬২ সালে ভারত সরকার প্রতিষ্ঠা করে ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কমিটি ফর স্পেস রিসার্চ (ইনকোসপার)। পরবর্তীতে নাম এবং কাঠামোতে কিছু পরিবর্তন এনে ১৯৬৯ সাল থেকে তা ইসরো নামে পরিচালিত হতে থাকে।
বর্তমানে আমরা যে বিশাল এবং বিস্তৃত মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ইসরোকে চিনি, তার যাত্রা শুরু হয়েছিল খুবই ছোট পরিসরে। এমনকি, প্রথমদিকে মহাকাশযানের জন্য ব্যবহৃত জিনিসপত্র গরুর গাড়ি ও সাইকেলের সাহায্যে নিয়ে যাওয়ার কিছু স্থিরচিত্র সাম্প্রতিক সাফল্যের পর আলোচনায় এসেছে।
প্রকৃতপক্ষে ভারত সরকারের ক্রমাগত সমর্থন এবং মহাকাশ গবেষণার উচ্চাভিলাষ ভারতীয় বিজ্ঞানীদের তাদের এই কণ্টকাকীর্ণ পথ পাড়ি দিতে সাহস জুগিয়েছে। এমনকি ২০১৯ সালে ৯৭৮ কোটি রুপি খরচ করে পাঠানো চন্দ্রযান-২ যখন চাঁদে সফল অবতরণে ব্যর্থ হলো তখনো ভারত সরকার ইসরোকে চন্দ্রযান-৩ প্রকল্পের জন্য অর্থ বরাদ্দের মাধ্যমে সামনে এগিয়ে যাওয়ার বার্তা দেয় এবং ২০২৩ সালে এসে তারই সুফল লাভ করে।
সরকারের আর্থিক সমর্থনের পাশাপাশি ইসরোর রয়েছে টেকসই ও সুদূরপ্রসারী চিন্তাভাবনা। কেবলমাত্র ডজনের বেশি গবেষণা সেন্টার পরিচালনা নয়, বরং ওই সব গবেষণা সেন্টার পরিচালনার জন্য মহাকাশ বিষয়ে দক্ষ জনবল তৈরির লক্ষ্যে তারা ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব স্পেস সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি (আইআইএসটি) ও ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব রিমোট সেন্সিং (আইআইআরএস) নামে দুটি স্বায়ত্তশাসিত ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করেছে।
মহাকাশ-সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয়ে গবেষণার পাশাপাশি এসব ইনস্টিটিউট স্নাতক, স্নাতকোত্তর এমফিল ও পিএইচডি ডিগ্রি প্রদান করছে। যার ফলে মহাকাশ-গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় প্রতিভাবান প্রকৌশলী তারা নিজেদের দেশেই তৈরি করছে। এছাড়া, বিভিন্ন দেশ ও প্রতিষ্ঠানের জন্য চুক্তিতে স্যাটেলাইট তৈরি ও উৎক্ষেপণের মাধ্যমে মহাকাশ-গবেষণাকে তারা বানিজ্যিকীকরণ করেছে। যার ফলে তৈরি হয়েছে নিজস্ব অর্থ উপার্জনের পথ। এভাবেই সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা এবং নিজস্ব উদ্ভাবনী শক্তি কাজে লাগিয়ে ধীরে ধীরে আজকের অবস্থানে এসে পৌঁছেছে ইসরো।
এবার আসা যাক, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর প্রাকৃতিক দুর্যোগ-প্রবণ আমাদের এই ভূখণ্ডে আবহাওয়া পূর্বাভাস এবং মহাকাশ গবেষণার গুরুত্ব অনুধাবন করে স্বাধীনতা লাভের পরপরই ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনে স্পেস অ্যান্ড অ্যাটমোসফিয়ারিক রিসার্চ সেন্টার (এসএআরসি) এবং ১৯৭৩ সালে আর্থ রিসোর্স টেকনোলজি স্যাটেলাইট (ইআরটিএস) নামে কর্মসূচি গ্রহণ করে।
পরবর্তীতে ১৯৮০ সালে এই প্রতিষ্ঠান দুটিকে একত্রে করে স্পারসো গঠিত হয়। ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা লাভের প্রায় ১৫ বছর পর ভারত মহাকাশ কর্মসূচি গ্রহণ করলেও জাতির জনকের বিচক্ষণতায় বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভের অব্যবহিত পরেই মহাকাশ কর্মসূচি গ্রহণ করে। কিন্তু, তারপরও কেটে গিয়েছে প্রায় ৫০ বছর। তাহলে এখনো কেন মহাকাশ গবেষণায় উল্লেখযোগ্য কোনো সাফল্য পেল না বাংলাদেশ?
প্রকৃতপক্ষে, মহাকাশ গবেষণায় স্পারসোর পিছিয়ে যাওয়ার পেছনে বহুবিধ কারণ রয়েছে। ১৯৭৫ সালে জাতির জনককে সপরিবারে হত্যার মাধ্যমে সর্বক্ষেত্রে যে পশ্চাৎমুখী যাত্রা শুরু হয়েছিল, মহাকাশ গবেষণাও তার থেকে কিছু ব্যতিক্রম নয়। বড় পরিসরে মহাকাশ নিয়ে মৌলিক গবেষণা করার জন্য যে সুদূরপ্রসারী চিন্তাভাবনা প্রয়োজন ছিল বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর তা আর সম্ভব হয়নি। ফলে নিজস্ব স্যাটেলাইট কিংবা মহাকাশযান তৈরি নয় বরং মহাকাশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ব্যবহার করে জলবায়ু পরিবর্তন, কৃষি, বন, সমুদ্রবিজ্ঞান, মহাকাশ ও বায়ুমণ্ডল, পানিসম্পদ বিষয়ে গবেষণার মধ্যে সীমিত হয়ে পড়ে স্পারসোর কার্যক্রম।
মহাকাশ গবেষণা অত্যন্ত সময়সাপেক্ষ এবং ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। উদাহরণস্বরূপ, ইসরো প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ৬০ বছরে এই পর্যন্ত চেয়ারম্যানের পদের দায়িত্ব সামলেছেন কেবলমাত্র দশজন বিজ্ঞানী। অর্থাৎ গড়ে একজন চেয়ারম্যান ছয় বছর সময় পেয়েছেন তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য। পক্ষান্তরে, স্পারসো প্রতিষ্ঠার পর ৪৩ বছরে মোট চেয়ারম্যান ছিলেন ২৬ জন। অর্থাৎ, একজন চেয়ারম্যান গড়ে মাত্র দেড় বছরের কিছু বেশি সময় দায়িত্ব পালন করেছেন। স্বাভাবিকভাবেই, এত অল্প সময়ে কোনো বড় কোনো কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ বা বাস্তবায়ন সম্ভব নয়।
আরও পড়ুন
শুধু তাই নয়, কোনো মহাকাশযান তৈরি এবং উৎক্ষেপণের জন্য যে ধরনের জনবল বা অবকাঠামো দরকার তার খুব সামান্যই স্পারসো অর্জন করতে পেরেছে। উদাহরণস্বরূপ, স্পারসোর মহাকাশ পদার্থ বিজ্ঞান এবং রকেট গতিবিদ্যা বিভাগে জনবল রয়েছে কেবল মাত্র তিনজন। প্রায় একই পরিস্থিতি রকেট প্রযুক্তি উন্নয়ন বিভাগে, সেখানেও জনবল ৩ জন। অর্থাৎ পরিকল্পনা, অবকাঠামো, দক্ষতা এবং জনবল সব ক্ষেত্রেই স্পারসো অনেক পিছিয়ে রয়েছে।
তাহলে, মহাকাশ গবেষণায় আশানুরূপ সাফল্য পেতে হলে স্পারসোকে কী করতে হবে? প্রথমত, স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা তৈরি করতে হবে। দ্বিতীয়ত, মহাকাশ গবেষণার কর্মপরিধি বাড়িয়ে স্যাটেলাইট ও রকেট প্রযুক্তির উন্নয়ন নিয়ে কাজ করতে হবে এবং নিজস্ব দক্ষ জনবল তৈরি করতে হবে।
তৃতীয়ত শুধুমাত্র প্রায়োগিক নয় বরং মহাকাশ বিষয়ক মৌলিক গবেষণা বাড়াতে হবে। প্রয়োজনে বিভিন্ন দেশি ও বিদেশি সংস্থার সাথে সহযোগিতা ও জ্ঞানের আদান-প্রদান বাড়াতে হবে। এছাড়া নিজস্ব তহবিল তৈরি করতে হবে এবং সরকারের কাছ থেকে গবেষণায় অর্থ বরাদ্দ নিয়ে আসার ব্যবস্থা করতে হবে। পাশাপাশি, মহাকাশ এবং মহাকাশযান নিয়ে মৌলিক গবেষণা বাড়াতে হলে চেয়ারম্যান পদে সরকারকে একজন মহাকাশ বিজ্ঞানীকে নিয়োগ দিতে হবে এবং তাকে পর্যাপ্ত সময় দিতে হবে তার পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়নের জন্য।
ঘরের পাশের ইসরো হতে পারে স্পারসোর জন্য রোল মডেল। ভারতের মহাকাশ গবেষণার জনক বিক্রম সারাভাই কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়ালেখা শেষ করে ভারতে ফিরে এসে নিজস্ব ফিজিক্যাল রিসার্চ ল্যাবরেটরি তৈরি করেছিলেন। ঠিক তখন, ১৯৫৭ সালে রাশিয়া সর্বপ্রথম মহাকাশে কৃত্রিম উপগ্রহ পাঠায় যার নাম ছিল স্পুটনিক-১।
এই ঘটনা যখন সারাবিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি করে তখন সারাভাই ভারত সরকারকে মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে বোঝান এবং সেই কাজে সফলও হন। স্পুটনিক-১ যেভাবে ভারতের মহাকাশ গবেষণার ভিত্তি স্থাপনে সাহায্য করেছিল ঠিক সেইভাবেই চন্দ্রযান-৩ ভূমিকা রাখতে পারে বাংলাদেশের মহাকাশ গবেষণা নিয়ে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা তৈরি করতে।
সৌভাগ্যক্রমে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নিজে থেকেই ভবিষ্যতে চাঁদে যাওয়ার স্বপ্ন দেখিয়েছেন সুতরাং সামনে এগিয়ে যাওয়ার এই সুযোগটি স্পারসোকে ভালোভাবে কাজে লাগাতে হবে।
চন্দ্রবিজয়ের আকাঙ্ক্ষার সাথে আরও গুরুত্বপূর্ণ একটি কথা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন। তিনি বলেন, ‘আমরা দেশে দক্ষ ও স্মার্ট জনশক্তি গড়ে তুলব। অর্থাৎ, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জানেন যে নিজস্ব জনশক্তি তৈরি করতে না পারলে কেবল অর্থ বরাদ্দ দিয়ে টেকসই সাফল্য অর্জন করা সম্ভব নয়।
প্রকৃতপক্ষে, ইতিমধ্যে প্রযুক্তিগত অগ্রগতির জন্য একটি দক্ষ এবং জ্ঞানী কর্মী বাহিনী তৈরির লক্ষ্যে বর্তমান সরকার দেশের উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, গবেষণা কেন্দ্র এবং বিশেষায়িত প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতে বিনিয়োগের ওপর জোর দিয়েছে। বিভিন্ন ধরনের গবেষণায় সরকার উল্লেখযোগ্য অর্থ বরাদ্দ করেছে। এসব উদ্যোগের সুফল ইতিমধ্যে পাওয়া শুরু হয়েছে এবং অদূর ভবিষ্যতে তা আরও স্পষ্টভাবে বোঝা যাবে।
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ যখন সরকার গঠন করে তখন ক্ষুধা এবং দারিদ্র্য মুক্তিই ছিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মূল লক্ষ্য। কিন্তু, ২০০৯ সালে দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে, তিনি বাংলাদেশের নাগরিকদের জীবনযাত্রার উন্নয়নের জন্য বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর জন্য নিরলসভাবে কাজ করে চলছেন।
'ডিজিটাল বাংলাদেশ' রূপকল্প প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে তিনি শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, কৃষি এবং প্রশাসনসহ বিভিন্ন খাতে প্রযুক্তির ব্যবহার করে টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করেছেন। তার নেতৃত্বে সারা দেশে ইন্টারনেট সংযোগ এবং ডিজিটাল অবকাঠামো সম্প্রসারণে বাংলাদেশ অভাবনীয় অগ্রগতি করেছে।
পদ্মা সেতু, মেট্রো রেল, কর্ণফুলী টানেল, রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎ-কেন্দ্রসহ অসংখ্য মেগাপ্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে তিনি আমাদের স্বপ্নের সীমারেখা বাড়িয়ে দিয়েছেন বহুগুণে। ‘বাংলাদেশ ডেল্টা প্ল্যান ২১০০’ প্রণয়নের মাধ্যমে তিনি আগামী একশ বছরের জন্য পরিকল্পনা প্রস্তুত করেছেন।
আরও পড়ুন
মহাকাশ গবেষণায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর আগ্রহ কেবল মুখের কথা নয়। তিনি জানেন চতুর্থ শিল্প বিপ্লবে অংশ নিতে হলে কেবল অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি নয় জ্ঞান বিজ্ঞানেও অগ্রসর হতে হবে। তার ঐকান্তিক আগ্রহের কারণেই ২০১৮ সালে বাংলাদেশের প্রথম যোগাযোগ স্যাটেলাইট বঙ্গবন্ধু-১ এর সফল উৎক্ষেপণ সম্ভব হয় যা সংযোগ, সম্প্রচার এবং ইন্টারনেট পরিষেবার জন্য নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করেছে।
এছাড়া ১১ সেপ্টেম্বর ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁর ঢাকা সফরের সময় বঙ্গবন্ধু-২ স্যাটেলাইটের জন্য এয়ারবাস কোম্পানির সাথে চুক্তি হয়, যেটি হবে দেশের প্রথম পৃথিবী-পর্যবেক্ষণ স্যাটেলাইট। এটি তৈরি হলে দেশে আবহাওয়া, জলবায়ু পরিবর্তন, কৃষি, বন, সমুদ্রবিজ্ঞান, মহাকাশ ও বায়ুমণ্ডল, পানিসম্পদ বিষয়ে গবেষণার নতুন দ্বার উন্মোচিত হবে।
সুতরাং, প্রধানমন্ত্রী যখন বলেন ‘ভবিষ্যতে বাংলাদেশ চাঁদেও যাবে’ সেই কথাকে হালকা করে নেওয়ার সুযোগ নেই। ২০১২ সালের জুলাই মাসে মন্ত্রিসভার এক বৈঠকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন সিদ্ধান্ত নিলেন নিজেদের অর্থে পদ্মা সেতু করবে বাংলাদেশ তখন নানান প্রান্ত থেকে সমালোচনা আর উপহাসবাণী ছুটে এসেছিল। কিন্তু মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ইস্পাত কঠিন মনোবল আর যোগ্য নেতৃত্বের কারণে ঠিক দশ বছর পর ২০২২ সালের জুন মাসে পদ্মা সেতুর উদ্বোধন হয়।
২০২৩ সালে প্রধানমন্ত্রী যে স্বপ্ন দেখালেন চাঁদে যাওয়ার, সেইটি কেবল দিবাস্বপ্ন নয়। আজ না হোক কাল এই স্বপ্নও পূরণ হবে। তবে, এই স্বপ্ন পূরণ করার জন্য যে দূরদর্শী রাজনৈতিক নেতৃত্ব প্রয়োজন তেমন নেতা এই মুহূর্তে বাংলাদেশে কেবল একজনই রয়েছেন, তিনি জননেত্রী শেখ হাসিনা। কিন্তু, সেই স্বপ্ন পূরণের জন্য যে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং ধারাবাহিকতা প্রয়োজন সেটি নিশ্চিত করতে হবে এদেশের জনগণের। বর্তমানে বাংলাদেশ ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে রয়েছে, সামনের দিনে তাই এদেশের জনগণের বেছে নিতে হবে সঠিক পথটি।
ড. মো. মেহেদী হাসান ।। সহযোগী অধ্যাপক, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়