বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদের ভূমিকা

বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় কেন ছাত্র সংসদ রাখা হয়েছিল? এই প্রশ্নের উত্তর আমরা জানি। কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের পাশাপাশি আবাসিক হলগুলোয় ছাত্র সংসদের কাঠামো ছিল এবং এখনো তা বিদ্যমান। কিন্তু বাস্তবে এর প্রয়োগ আমরা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা জীবনে দেখিনি।
এসব ছাত্র সংসদ রাখার যৌক্তিক কারণ ছিল-পড়াশোনার পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের মাঝে যোগ্য নেতৃত্ব গড়ে তোলা। দেশ স্বাধীনের আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র
সংসদের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা আমরা জানি।
দেশ স্বাধীনের পরও এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের ভূমিকাও ছিল মনে রাখার মতো; বিশেষ করে স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে ডাকসুসহ অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের ভূমিকা।
আমরা একটু পেছনে ফিরে দেখতে চাই। বিশ্ববিদ্যালয়ের এসব ছাত্র সংসদ কেমন ‘নেতা-নেতৃত্ব’ জাতিকে উপহার
দিয়েছিল?
শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপহার দেওয়া উল্লেখযোগ্য ও আলোচিত কয়েকজনের কথাই বলি। সর্বশেষ ২০১৯-২০ সালে ডাকসু'র ভিপি ছিলেন নুরুল হক নুর। এখনকার আলোচিত তরুণ রাজনীতিবিদ। এর আগে ১৯৯০-৯১ সালে ভিপি-জিএস ছিলেন আমানউল্লাহ আমান ও খায়রুল কবির খোকন।
১৯৭৯-৮০ সালে ভিপি-জিএস ছিলেন মাহমুদুর রহমান মান্না ও আখতারুজ্জামান। ১৯৭২-৭৩ সালে ভিপি-জিএস ছিলেন মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম ও মাহবুব জামান।
১৯৭০-৭২ সালে ছিলেন আ স ম আবদুর রব ও আবদুল কুদ্দুস মাখন। ১৯৬৮-৭০ এ ছিলেন তোফায়েল আহমেদ ও নাজিম কামরান চৌধুরী। ১৯৬৩-৬৪ সালে ছিলেন রাশেদ খান মেনন ও মতিয়া চৌধুরী।
১৯৬২-৬৩ সালে ছিলেন শ্যামা প্রসাদ ঘোষ ও কে এম ওবায়দুর রহমান। ১৯৪৭-৪৮ সালে ছিলেন অরবিন্দ বোস ও গোলাম আযম। এ রকম আরও অনেক নাম লেখা যাবে।
আরও পড়ুন
ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে বাংলাদেশের স্বাধিকার আন্দোলন, এরপর স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী আন্দোলন অর্থাৎ বাংলাদেশের রাজনীতি-বাংলাদেশ গঠনে এসব জাতীয় নেতৃবৃন্দ অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন।
তারা ডাকসু'র প্রোডাক্ট। নব্বইয়ের স্বৈরাচারী বিরোধী আন্দোলনেও ডাকসু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কিন্তু নব্বই পরবর্তী
পর ডাকসু নির্বাচন হতে সময় নিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ২৮ বছর।
২০১৯ সালের ১১ মার্চ সর্বশেষ ডাকসু'র নির্বাচন হয়। তাও আবার উচ্চ আদালতের নির্দেশের পর। আমরা আমাদের বিবেক দিয়ে চলতে পারিনি। অন্ধবিশ্বাস-দলদাস হয়ে প্রশাসনের দায়িত্বশীল কর্তাব্যক্তিরা চোখ বন্ধ রেখে প্রশাসন চালিয়ে গেছেন। ২৮ বছরে কত যোগ্য নেতৃত্ব গড়ে তোলা যেত। বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে তারা অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারতেন।
বাংলাদেশ এখানে হেরে গেছে। আর আমাদের তথাকথিত রাজনীতিবিদরা ‘পকেট কমিটি’ দিয়ে অনুগত ছাত্র নেতৃত্ব গড়ে তুলতে চেয়েছে। এর ফলাফল হয়েছে চাঁদাবাজ-দখলবাজ-টেন্ডারবাজ এমনকি ধর্ষক নেতার জন্ম।
আমাদের সামনে সুযোগ এসেছে। চব্বিশের জুলাই-আগস্টে সফল ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে গণতন্ত্রের নামে বাংলাদেশে চেপে বসা ফ্যাসিবাদের উৎখাতের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অন্যতম দাবি ছাত্র সংসদ নির্বাচন।
ডাকসু নির্বাচনের প্রয়োজনীয় করণীয় নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ইতিমধ্যে একটি কমিটি গঠন করেছে। ছাত্র সমাজসহ পুরো জাতি তাকিয়ে আছে যোগ্য প্রশাসনের ইতিবাচক ঘোষণার দিকে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনও ইতিমধ্যে জাকসু নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করেছে।
এরই মধ্যে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ১৭ নভেম্বর ২০২৫ বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ভবনে একটি অনুষ্ঠানে ঘোষণা দিয়েছেন—এই ফেব্রুয়ারিতেই রাকসু নির্বাচনের রোড ম্যাপ ঘোষণা করবেন। তিনি অবশ্য দায়িত্ব নিয়েই অগ্রাধিকারের তালিকায় রাকসু নির্বাচনকে রেখেছিলেন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কি পারবে এ ক্ষেত্রে অগ্রপথিক হতে?
পরিশেষে বলতে চাই, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ছাত্র সংসদ নির্বাচন হলে, শিক্ষার্থীদের হাতে নেতৃত্ব গেলে; বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় বিরাজমান অনেক সমস্যার সমাধান সহজ হয়ে যাবে। অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা এড়ানো সম্ভব হবে।
আর ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ কুয়েটে যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের ঘটনা ঘটল, তা হয়তো ঘটত না। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ছাত্র সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে; তথাকথিত ছাত্র রাজনীতির নামে হানাহানি-মারামারি-কাটাকাটি বন্ধ করা সম্ভব হবে।
তাই সব বিশ্ববিদ্যালয়ে অবিলম্বে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত।
ড. শাফিউল ইসলাম ।। অধ্যাপক, লোকপ্রশাসন বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়