বাজেট হোক সমতা, ন্যায্যতা ও মানব কল্যাণের

বাংলাদেশে বাৎসরিক বাজেট ঘোষণার ইতিহাস কেবল অর্থনৈতিক পরিকল্পনার বিষয় নয়, এটি সুশাসন প্রতিষ্ঠার সাথেও গভীরভাবে যুক্ত। বাজেট ঘোষণা একটি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার অংশ, যার মাধ্যমে সরকার তার আয় ও ব্যয়ের হিসাব সংসদ এবং জনগণের সামনে উপস্থাপন করে।
এটি সরকারের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করে, স্বচ্ছতা বজায় রাখে এবং জনগণের চাহিদা অনুযায়ী সম্পদের সুষম বণ্টন সম্ভব করে তোলে। ১৯৭২ সাল থেকে বাংলাদেশে বাজেট উপস্থাপন একটি নিয়মিত প্রক্রিয়ায় পরিণত হয়েছে, যা সুশাসনের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে কাজ করছে।
বাজেট জনসমক্ষে উপস্থাপনের যে নিয়ম, তা মূলত এই ধারণা থেকে উদ্ভূত হয়েছে যে, সরকার জনগণের অর্থ কীভাবে উপার্জন ও ব্যয় করছে সে বিষয়ে তাদের কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য। ব্রিটিশ পার্লামেন্ট যখন কর ও ব্যয়ের ওপর নিয়ন্ত্রণ দাবি করে, তখন থেকেই এই প্রক্রিয়ার সূচনা। এ প্রক্রিয়া স্বচ্ছতা, আর্থিক শৃঙ্খলা ও আইনসভা কর্তৃক তদারকির ভিত্তি স্থাপন করে—যা সুশাসনের মূল উপাদান।
বাংলাদেশের মতো দেশে সংসদে নিয়মিত বাজেট উপস্থাপন নিশ্চিত করে যে নির্বাহী বিভাগ জবাবদিহিতার আওতায় থাকে, জনগণের অগ্রাধিকার নিয়ে আলোচনা হয় এবং আর্থিক সিদ্ধান্তসমূহ বিশ্লেষণ করা যায়। সুতরাং, বাজেট ঘোষণার এই ঐতিহাসিক ধারা কেবল অর্থনৈতিক নীতিকে নয়, গণতান্ত্রিক চর্চাকেও প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছে এবং অংশগ্রহণমূলক ও স্বচ্ছ শাসনব্যবস্থাকে উৎসাহিত করেছে।
বর্তমানে বিশ্বের প্রায় সব দেশই তাদের বাৎসরিক বাজেট ঘোষণা করে থাকে, যা সরকারি আর্থিক ব্যবস্থাপনার একটি মৌলিক অংশ। তবে এই বাজেটগুলো কতটা স্বচ্ছ এবং কীভাবে জনসমক্ষে উপস্থাপিত হয়, তা দেশভেদে ভিন্ন হতে পারে। ইন্টারন্যাশনাল বাজেট পার্টনারশিপ (IBP) এর মতো সংস্থাগুলো এ স্বচ্ছতা মূল্যায়ন করে থাকে।
বর্তমানে বিশ্বের প্রায় সব দেশই তাদের বাৎসরিক বাজেট ঘোষণা করে থাকে, যা সরকারি আর্থিক ব্যবস্থাপনার একটি মৌলিক অংশ।
যদিও বিশ্বের প্রায় ১৯৫টি দেশের অধিকাংশই বার্ষিক বাজেট প্রস্তুত ও ঘোষণা করে, বাজেটের বিস্তারিত বিবরণ এবং সাধারণ নাগরিকদের জন্য এর সহজলভ্যতা অনেক ক্ষেত্রেই ভিন্ন।
IBP কর্তৃক পরিচালিত ওপেন বাজেট সার্ভে (OBS) ২০২৩-এ ১২৫টি দেশের বাজেট স্বচ্ছতা, জনগণের অংশগ্রহণ ও তদারকি পরিস্থিতি মূল্যায়ন করা হয়েছে। এই রিপোর্টটি সরকারের আর্থিক ব্যবস্থাপনা কতটা অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং জবাবদিহিমূলক, সে বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সরবরাহ করে। রিপোর্ট অনুযায়ী, বাজেট প্রক্রিয়ায় কিছু অগ্রগতি সত্ত্বেও বেশিরভাগ দেশেই ব্যাপক চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে।
বিশ্বব্যাপী বাজেট স্বচ্ছতার গড় স্কোর মাত্র ৪৫ (১০০ এর মধ্যে), যা ইঙ্গিত করে যে অধিকাংশ দেশ এখনো জনগণের কাছে পর্যাপ্ত বাজেট তথ্য প্রকাশ করে না। তথ্য প্রকাশের ক্ষেত্রে অর্থাৎ বাজেট স্বচ্ছতায় সর্বোচ্চ স্কোরপ্রাপ্ত দেশগুলো হলো, জর্জিয়া (৮৭), দক্ষিণ কোরিয়া (৮৫), নিউজিল্যান্ড (৮৫), নরওয়ে (৮৩) ও মেক্সিকো (৮২)। অপরদিকে, ইকুয়েটোরিয়াল গিনি (০), ইয়েমেন (৩) ও ভেনেজুয়েলা (৫) বাজেট স্বচ্ছতায় অত্যন্ত দুর্বল।
আরও পড়ুন
জনগণের অংশগ্রহণে গড় স্কোর মাত্র ১৫, যা নির্দেশ করে নাগরিকদের বাজেট প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের সুযোগ খুবই সীমিত। মাত্র ৩৮টি দেশ বিভিন্ন ধাপে জনসম্পৃক্ততা নিশ্চিত করেছে। দক্ষিণ কোরিয়া (৫৯), নিউজিল্যান্ড (৫২) এবং যুক্তরাজ্য (৫০) এক্ষেত্রে শীর্ষে রয়েছে। এটি প্রতিফলিত করে যে, স্বচ্ছতা বাড়লেও জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ এখনো অনেক কম।
তদারকির ক্ষেত্রে ফলাফল মিশ্র। সংসদীয় তদারকির গড় স্কোর ৪৫; অনেক পার্লামেন্ট বাজেট অনুমোদনের আগে যথাযথ পর্যালোচনার সুযোগ দেয় না এবং বাজেট তড়িঘড়ি করে পাস হয়। অপরদিকে, সর্বোচ্চ নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর গড় স্কোর ৬২। ৮৩ শতাংশ দেশেই সুপ্রিম অডিট ইনস্টিটিউশন (SAI) আছে যারা নিরীক্ষা প্রতিবেদন প্রকাশ করে, যদিও কার্যকারিতা দেশভেদে ভিন্ন।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে দেখা যায় বাজেট স্বচ্ছতার স্কোর মাত্র ৩৮, যা বৈশ্বিক গড়ের নিচে। এর অর্থ, গুরুত্বপূর্ণ বাজেট দলিল যথাসময়ে এবং সহজবোধ্যভাবে প্রকাশিত হয় না। জনগণের অংশগ্রহণ স্কোর মাত্র ১১—এটি বাজেট প্রণয়ন, বাস্তবায়ন ও পর্যালোচনায় নাগরিক অংশগ্রহণের অভাব প্রতিফলিত করে। এটি সরকারের জবাবদিহিতা ও জনগণের আস্থার ঘাটতির কারণ হতে পারে।
অন্যদিকে, বাংলাদেশ অডিট তদারকিতে ৬৭ স্কোর অর্জন করেছে, যা আন্তর্জাতিক গড়ের উপরে এবং সুপ্রিম অডিট ইনস্টিটিউশনের কার্যকারিতাকে নির্দেশ করে। তবে এই নিরীক্ষা প্রতিবেদনগুলো কতটা কার্যকরভাবে সরকারের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করে, তা এখনো প্রশ্ন সাপেক্ষ। সংসদীয় তদারকিতে বাংলাদেশের স্কোর ৪১—যা সংসদের সীমিত ক্ষমতা প্রতিফলিত করে।
গ্লোবাল স্কেলে বাজেট স্বচ্ছতায় বাংলাদেশ নিম্নমধ্যম স্তরে রয়েছে। বাজেট তথ্য প্রকাশে অনিয়ম, অংশগ্রহণের অভাব এবং সীমিত সংসদীয় তদারকি বাংলাদেশের আর্থিক শাসনে গঠনমূলক পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে।
বর্তমান সরকার একটি অন্তর্বর্তীকালীন প্রশাসন, যা জুলাই মাসের গণআন্দোলনের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসেছে। যদিও আওয়ামী লীগ সহ পূর্বতন নির্বাচিত সরকার সমূহ প্রতি বছর বাজেট ঘোষণা করত, IBP রিপোর্টে তাদের আমলে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার ঘাটতি স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়েছে।
বিশ্বের প্রায় ১৯৫টি দেশের অধিকাংশই বার্ষিক বাজেট প্রস্তুত ও ঘোষণা করে, বাজেটের বিস্তারিত বিবরণ এবং সাধারণ নাগরিকদের জন্য এর সহজলভ্যতা অনেক ক্ষেত্রেই ভিন্ন।
ড. ইউনূসের নেতৃত্বে এবারের বাজেট আন্তর্জাতিক রিপোর্টে উল্লিখিত বাজেট স্বচ্ছতা ও জনসম্পৃক্ততার ঘাটতি পূরণের এক অনন্য সুযোগ হতে পারে।
আধুনিক গণতান্ত্রিক উন্নয়ন ভাবনায় সামাজিক ব্যবসা এবং এমন কিছু উদ্যোগ এখন গুরুত্ব পাচ্ছে, যেগুলো কেবলমাত্র আর্থিক লাভ নয়, বরং নাগরিক কল্যাণ, অংশগ্রহণ, স্বচ্ছতা এবং টেকসই সুশাসনের লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে চলে। এ ধরনের জনমুখী উদ্যোগ সমাজের উপেক্ষিত শ্রেণির ক্ষমতায়ন, দারিদ্র্য হ্রাস, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা প্রসার এবং পরিবেশ রক্ষায় কার্যকর ভূমিকা রাখতে সক্ষম। এতে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনীতি গড়ে ওঠে, যেখানে তরুণ উদ্যোক্তারা উদ্ভাবনী চেতনায় সমাজের সমস্যা সমাধানে অংশ নেন এবং তাদের উদ্যোগের পুনরায় বিনিয়োগ সমাজকল্যাণে ব্যবহৃত হয়।
জাতীয় বাজেট গণতন্ত্রের গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ—এটি কেবল সংখ্যার খেলা নয়, বরং রাষ্ট্রীয় দায়বদ্ধতা, জনগণের অংশগ্রহণ ও সুশাসনের প্রতিচ্ছবি। তাই এবারের বাজেটে এমন জনমুখী ও সমাধানভিত্তিক উদ্যোগগুলোর জন্য উপযুক্ত বরাদ্দ রাখা যেতে পারে। প্রশিক্ষণ, আরম্ভিক পুঁজি, গবেষণা এবং নীতিগত সহায়তা নিশ্চিত করে এ খাতকে টেকসই ভিত্তিতে দাঁড় করানো সম্ভব।
গণতন্ত্র ও সুশাসনের শক্ত ভিত হলো অংশগ্রহণ, জবাবদিহিতা ও অন্তর্ভুক্তি। যদি বাজেট পরিকল্পনায় সমাজকল্যাণে নিবেদিত এই উদ্যোগগুলো মূলধারায় আনা যায়, তবে তা হবে একটি অংশগ্রহণভিত্তিক ন্যায়সঙ্গত অর্থনীতির সূচনা। সরকার চাইলে কর-প্রণোদনা, স্বল্পসুদে ঋণ এবং গবেষণা অর্থায়নের মাধ্যমে এই ধরনের উদ্যোগগুলো উৎসাহিত করতে পারে।
একইসঙ্গে, পরিবেশগত সংকট মোকাবিলা ও ন্যায়ভিত্তিক উন্নয়ন নিশ্চিতে এ খাতে বরাদ্দ বাড়ানো প্রয়োজন—যেমন গ্রামীণ উন্নয়ন, পরিচ্ছন্ন শক্তি, সাশ্রয়ী স্বাস্থ্যসেবা বা দূষণ নিয়ন্ত্রণে উদ্ভাবনী প্রয়াস। এতে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (SDGs) বাস্তবায়নেও অগ্রগতি সম্ভব হবে।
সবশেষে, এই ধরনের উদ্যোগগুলোর প্রভাব মূল্যায়নের জন্য স্বচ্ছ গবেষণা, পর্যালোচনা ও তথ্যভিত্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে বাজেট বরাদ্দ রাখা উচিত। এটি শুধু বাজেট বাস্তবায়নের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করবে না, বরং গণতান্ত্রিক নীতি-নির্ধারণেও অবদান রাখবে।
জাতীয় বাজেট যদি অংশগ্রহণ, সমতা, ন্যায্যতা ও মানবিক কল্যাণের পথে পরিচালিত হয়, তবে তা নিঃসন্দেহে গণতন্ত্র ও সুশাসনের জীবন্ত প্রতীক হয়ে উঠতে পারে।
ড. এ কে এম মাহমুদুল হক ।। অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
