নিরাপদ মাতৃত্ব ও মাসিক সচেতনতা কি দিবসেই আবদ্ধ থাকবে?

গ্রামের খুব সাধারণ এক কিশোরী রোদেলা। নাম তার রোদেলা হলেও, সে যেন ছিল আশার এক নতুন রোদ। স্কুলে যেতে পছন্দ করতো, বই পড়তে ভালোবাসতো, আর বড় হয়ে মানব সেবার ব্রত নিয়ে একজন নার্স হতে চাইত। কিন্তু সব স্বপ্ন থেমে যেতে বসেছিল ভয়ংকর অভিজ্ঞতায়—যেটা ছিল মাসিক নিয়ে অজ্ঞতা এবং সামাজিক ট্যাবুর কারণে তার শরীর ও মানসিকতায় এক গভীর আঘাত।
শরীরে হঠাৎ এক পরিবর্তন দেখা দেওয়ায়, রোদেলা প্রচণ্ড ভয় পেয়ে গিয়েছিল। মা লজ্জায় কিছু বলেননি, স্কুলেও কেউ শেখায়নি কীভাবে এই সময়ে নিজের যত্ন নিতে হয়। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ঠিকভাবে মেনে না চলার কারণে সে অসুস্থ হয়ে পড়ে।
যখন আরও বড় হয় ১৮ হওয়ার আগেই নার্স হওয়ার স্বপ্ন জলাঞ্জলি দিয়ে পারিবারিক দারিদ্র্যতা আর সামাজিক অন্ধ নিয়মে অল্প বয়সেই বিয়ে করতে রাজি হতে হয়। বিয়ের পর যখন সন্তান ধারণ করে, তখনো সঠিক স্বাস্থ্যসেবা বা নিরাপদ মাতৃত্ব বিষয়ক কোনো ধারণা তার ছিল না। তাই প্রথম সন্তানটি পৃথিবীর আলো দেখার আগেই অসময়ে ঝরে যায়।
এই গল্পটি রোদেলার একার না—এটি বাংলাদেশের হাজারও নারীর বাস্তবতা। কিন্তু পরিবর্তন কি সম্ভব না? সম্ভব, তবে তার জন্য প্রয়োজন সচেতনতা আর আইনের কার্যকর পদক্ষেপ। আর তাই প্রতি বছর বাংলাদেশে পালিত হয়ে আসছে 'জাতীয় নিরাপদ মাতৃত্ব দিবস এবং মাসিক সচেতনতা দিবস।' নারীর জীবনকে সুন্দর, নিরাপদ, স্বাস্থ্যবান এবং মর্যাদাপূর্ণ করতে দিবসটির গুরুত্ব অপরিসীম।
জাতীয় নিরাপদ মাতৃত্ব দিবস ২০২৫, মায়ের নিরাপত্তায় জাতির ভবিষ্যৎ। এ বছর নিরাপদ মাতৃত্ব দিবসের প্রতিপাদ্য 'মাতৃস্বাস্থ্যে সমতা; বাদ যাবে না কোনো মা'।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, একজন মা সুস্থ ও নিরাপদভাবে সন্তান জন্ম দেওয়ার সুযোগ পাওয়াই মাতৃত্বের নিরাপত্তার মূল লক্ষ্য।
বাংলাদেশ সরকার ১৯৯৭ সাল থেকে ২৮ মে দিনটিকে জাতীয় নিরাপদ মাতৃত্ব দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। নিরাপদ মাতৃস্বাস্থ্য, মাতৃমৃত্যু হার হ্রাস ও নবজাতকের স্বাস্থ্য নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যেই নিরাপদ মাতৃত্ব দিবস পালিত হয়ে আসছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, একজন মা সুস্থ ও নিরাপদভাবে সন্তান জন্ম দেওয়ার সুযোগ পাওয়াই মাতৃত্বের নিরাপত্তার মূল লক্ষ্য।
বাংলাদেশে এখনো প্রতি বছর গর্ভকালীন ও প্রসবকালীন জটিলতায় বহু নারী মারা যান। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, ২০২৩ সালের তুলনায় ২০২৪ সালে মাতৃমৃত্যুর হার কিছুটা কমলেও, এখনো নিরাপদ প্রসব সেবা থেকে বহু নারী বঞ্চিত।
নিরাপদ মাতৃত্ব বলতে বোঝানো হয় গর্ভাবস্থায়, প্রসবের সময় এবং পরবর্তী সময়ে মহিলাদের জন্য উপযুক্ত চিকিৎসা, পুষ্টিকর খাবার ও সেবা প্রদান।
নিরাপদ মাতৃত্ব নিশ্চিত করতে গর্ভাবস্থার সময় ৪ বার স্বাস্থ্য পরীক্ষা, দক্ষ ধাত্রী বা প্রশিক্ষিত প্রসব সহায়তাকারীর মাধ্যমে সন্তান জন্ম, প্রসব-পরবর্তী সময়ে মায়ের ও নবজাতকের যত্ন, পরিবার পরিকল্পনা ও পুষ্টির সচেতনতা প্রয়োজন।
এছাড়া নারীদের স্বাস্থ্য সেবায় লিঙ্গ বৈষম্য দূর করে সরকারি-বেসরকারিভাবে মাতৃত্বকালীন ছুটি, পুষ্টিকর খাদ্য এবং সরকারি স্বাস্থ্যসেবা সহজলভ্য করতে হবে। ‘সুস্থ মা, নিরাপদ জন্ম—উন্নত আগামীর প্রতিশ্রুতি’।
আরও পড়ুন
মায়ের সুস্থতার পাশাপাশি নারীর আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় জানা জরুরি। সেটা হলো মাসিক বিষয়ে সচেতনতা।
মাসিক সচেতনতা দিবস ২০২৫, লজ্জা নয়, সচেতনতার বিষয়।
২৮ মে বিশ্বজুড়ে পালিত হয় Menstrual Hygiene Day, আর বাংলাদেশেও এর গুরুত্ব বাড়ছে দিন দিন। এই দিবসের মূল উদ্দেশ্য—মাসিক নিয়ে সামাজিক ট্যাবু ভাঙা, স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধি এবং পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতায় মাসিক ব্যবস্থাপনার ওপর গুরুত্ব দেওয়া।
অসংখ্য কিশোরী এখনো মাসিক শুরু হলে স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দেয়। মাসিক নিয়ে বিভিন্ন ট্যাবু, সংকোচ ও কুসংস্কার, সঠিক তথ্য, শিক্ষা এবং দিক নির্দেশনার অভাব রয়েছে। তাছাড়া স্যানিটারি প্যাডের সংকট বা দাম বেশি, স্কুলে উপযুক্ত টয়লেট বা হাত ধোয়ার জায়গার অভাব রয়েছে।
এই সমস্যাগুলো দূর করতে হলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মাসিক নিয়ে স্বাস্থ্য শিক্ষা বাধ্যতামূলক করতে হবে, স্থানীয়ভাবে সাশ্রয়ী মূল্যে প্যাড তৈরি ও সরবরাহ বাড়াতে হবে, মা ও মেয়েদের মধ্যে খোলামেলা আলোচনা বাড়াতে হবে এবং পুরুষদেরও এই আলোচনায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
মাসিক নিয়ে স্লোগান হতে পারে—‘মাসিক নিয়ে বলুন, জানুন, এটা লজ্জা নয় অধিকার’।
দুই দিবস, এক লক্ষ্য—নারীর সুস্বাস্থ্য, প্রয়োজনীয় শিক্ষা, সচেতনতা ও মর্যাদা নিশ্চিতকরণ।
জাতীয় নিরাপদ মাতৃত্ব দিবস এবং মাসিক সচেতনতা দিবস—দুটো দিবসই নারীর স্বাস্থ্য সুরক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ। একটি মাতৃত্বকালীন স্বাস্থ্যসেবায় জোর দেয়, অন্যটি নারীর জীবনের একটি নিয়মিত প্রাকৃতিক বিষয়কে সম্মান ও গুরুত্ব নিয়ে বিবেচনা করে।
অসংখ্য কিশোরী এখনো মাসিক শুরু হলে স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দেয়। মাসিক নিয়ে বিভিন্ন ট্যাবু, সংকোচ ও কুসংস্কার, সঠিক তথ্য, শিক্ষা এবং দিক নির্দেশনার অভাব রয়েছে।
প্রশ্ন হলো—এই দিবসগুলো শুধু প্রতীক হয়েই থাকবে, নাকি বাস্তব জীবন বদলাবে?
সরকার, স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান, এনজিও, শিক্ষাব্যবস্থা এবং আমাদের পরিবার-সমাজ সবাইকে একসাথে এগিয়ে আসতে হবে। স্কুলে যদি রোদেলার মতো মেয়েরা শিখতে পারে—মাসিক মানেই স্বাস্থ্য সচেতনতার সূচনা, আর স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যদি তারা পায় বিনামূল্যে সেবা ও সম্মান—তবে একদিন এই রোদেলারা নিজেরাই সুস্থ থেকে আলোর পথ দেখাবে অন্যদেরও।
প্রতিটি মা যেন নিরাপদভাবে সন্তান জন্ম দিতে পারেন, প্রতিটি কিশোরী যেন নিজের দেহ সম্পর্কে সচেতন হয়, প্রতিটি পরিবার যেন লজ্জা ভেঙে নারীর স্বাস্থ্য নিয়ে খোলামেলা কথা বলে—এই হোক জাতীয় নিরাপদ মাতৃত্ব দিবস ২০২৫ এবং মাসিক সচেতনতা দিবস ২০২৫-এর অঙ্গীকার।
রোদেলার গল্প আজ শুধুই গল্প নয়,
এটা হতে পারে পরিবর্তনের শুরু।
এগিয়ে আসুন, সচেতন হোন,
কারণ নারী মানেই ভবিষ্যৎ—আর সেই জন্য চাই সুস্থতা, সচেতনতা ও সম্মান।
‘জীবন হোক নিরাপদ, মাসিক হোক মর্যাদাপূর্ণ’।
ডা. কাকলী হালদার ।। সহকারী অধ্যাপক, মাইক্রোবায়োলজি বিভাগ, ঢাকা মেডিকেল কলেজ
