ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তির অধিকার রক্ষায় রাষ্ট্রের দায়বদ্ধতা

দেশের নজরুল সংগীতের উজ্জ্বলতম নক্ষত্র শবনম মুশতারী সম্বন্ধে একদিন ফলাও করে খবর বেরুলো—কাউকে চিনতে পারছেন না তিনি! জানা গেল, তিনি ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত। একই সমস্যায় আক্রান্ত বাংলাদেশ সরকারের বর্তমান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সহধর্মিণীও। প্রধান উপদেষ্টা এক টিভি সাক্ষাৎকারে খুব আক্ষেপ করে বলছিলেন, “আমাকে ছাড়া সে আর কাউকেই চেনে না। আমি চলে গেলে তার কী হবে!” এ দুটো উদাহরণ সমাজের সচ্ছল ও আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থার কাছাকাছি মানুষের। বাস্তবতা হলো, ডিমেনশিয়া (Dementia)-এর কবলে আজ সব শ্রেণি-পেশা ও শহর থেকে প্রান্তিকের প্রবীণ জনগোষ্ঠী।
এমন চেনা-অচেনা অসংখ্য মানুষ সারা পৃথিবীব্যাপী ভুগছেন মস্তিষ্কের ক্ষয়জনিত সমস্যায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) হিসাব অনুযায়ী, ২০২১ সাল পর্যন্ত সারা পৃথিবীতে ডিমেনশিয়ায় আক্রান্তের সংখ্যা ৫৭ মিলিয়ন, যার মধ্যে শতকরা ৬০ ভাগ বসবাস করছেন নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোয়। সর্বশেষ গবেষণার ফলাফল অনুযায়ী, দেশের বৃদ্ধ জনগোষ্ঠীর শতকরা ৮ শতাংশ ডিমেনশিয়ায় ভুগছেন—অর্থাৎ প্রতি ১২ জন বৃদ্ধ জনগোষ্ঠীর একজন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, ডিমেনশিয়া হলো পৃথিবীব্যাপী সব মৃত্যুর কারণগুলোর মধ্যে ৭ম প্রধান কারণ। সারা পৃথিবীতে এবং একই সাথে বাংলাদেশেও ডিমেনশিয়ার প্রকোপ ক্রমশই বেড়ে চলেছে।
ডিমেনশিয়া যেহেতু স্মৃতিশক্তি এবং স্বাভাবিক চিন্তা ও আচরণ করার ক্ষমতাকে নষ্ট করে দেয়, তাই এ নিয়ে রয়েছে প্রচুর ভ্রান্ত ধারণা বা কলঙ্ক (স্টিগমা)। বেশিরভাগ মানুষই মনে করেন যে এটি মতিভ্রম কিংবা উন্মাদ হয়ে যাওয়ার একটি ধরণ। কেউবা একে অতীন্দ্রিয় শক্তির কালো ছায়া কিংবা পাপের ফল হিসেবে গণ্য করে। এর ফলে এদের প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি থাকে অদ্ভুত ধরনের; যার বেশিরভাগই নেতিবাচক। এর কারণে বেশিরভাগ পরিবারই তাদের আপনজনের এ ধরনের সমস্যার কথা যতদিন পারেন গোপন রাখেন। আর এ বিলম্বের ফলে অসামান্য ক্ষতি হয়ে যায় ডিমেনশিয়ার সাথে বসবাসকারী ব্যক্তিদের। এ বিলম্বে মস্তিষ্কের ক্ষয় আরও বেড়ে যায়। বেশিরভাগ ডিমেনশিয়ার সাথে বসবাসকারী ব্যক্তি ও তাদের পরিবার যাপন করতে থাকেন এক অসহনীয় জীবন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২০১৭ সালে ডিমেনশিয়াকে জনস্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে প্রাধান্য দিতে সদস্য রাষ্ট্রগুলোর অন্তত ৭৫ শতাংশ রাষ্ট্রকে ২০২৫ সালের মধ্যে ডিমেনশিয়া প্রতিরোধ ও এর যত্ন সম্পর্কিত রাষ্ট্রীয় নীতিমালা ও জাতীয় কর্মপরিকল্পনা প্রণয়নের আহ্বান জানিয়েছিল। কিন্তু এ পর্যন্ত মাত্র ২৫ ভাগ সদস্য রাষ্ট্র ডিমেনশিয়া নীতিমালা প্রণয়ন করতে সক্ষম হয়েছে বা করেছে। বাংলাদেশে এ সংক্রান্ত কোনো নীতিমালা প্রণয়নে এখনো এগিয়ে আসা হয়নি। যেহেতু আমাদের দেশে বৃদ্ধ জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ক্রমশ বেড়ে চলছে এবং এর সাথে ডিমেনশিয়া আক্রান্ত ব্যক্তির সংখ্যাও, তাই এর সামাজিক, রাষ্ট্রীয় ও আর্থিক চাপও উল্লেখযোগ্য মাত্রায় বৃদ্ধি পাচ্ছে।
প্রায়শই দেখা যায়, এ জনগোষ্ঠীর সামাজিক, আর্থিক ও আইনগত অধিকার পদে পদে লঙ্ঘিত হয়। তাই রাষ্ট্রের দায়িত্ব হলো এ জনগোষ্ঠীকে রাষ্ট্রীয় সুরক্ষা প্রদানের মাধ্যমে তাদের শেষ দিনগুলো আরামদায়ক করে তোলা।
বাংলাদেশে প্রণীত হয়েছে প্রবীণ নীতিমালা, পিতা-মাতার ভরণপোষণ আইন, মানসিক স্বাস্থ্য আইন ও নীতিমালা। রয়েছে দুর্বল ও অসহায় জনগোষ্ঠীর জন্য সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী নিশ্চিত করার নানা আইনকানুন ও নীতিমালা। কিন্তু এসবের কোনোটিতেই ঠাঁই হয়নি ডিমেনশিয়া ও এর সাথে জড়িত আলঝেইমারসহ অন্যান্য ধরনের ডিমেনশিয়া সংক্রান্ত জটিলতায় বসবাসকারী ব্যক্তিদের সুরক্ষার কোনো বিধান। উদাহরণস্বরূপ, প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন, ২০১৩-এ ১২ ধরনের প্রতিবন্ধিতার সুরক্ষার কথা বললেও বলা হয়নি বার্ধক্যজনিত অক্ষমতায় ভোগা ব্যক্তিদের সুরক্ষার কথা। সমাজসেবা অধিদপ্তর কর্তৃক যে জটিল ৬টি রোগের জন্য নগদ পঞ্চাশ হাজার টাকা আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয়, সেখানে নেই তৃতীয় পর্যায়ে উপনীত হয়ে, স্মৃতিশক্তিসহ চিন্তা করার সব শক্তি এবং বুদ্ধিবৃত্তিক ও শারীরিক সব ধরনের সক্ষমতা হারিয়ে নিশ্চিত মৃত্যুর জন্য দিনগোনা ডিমেনশিয়ার সাথে বসবাসকারী ব্যক্তিদের সুরক্ষার কথা। অথচ ডিমেনশিয়ার পারিবারিক, আর্থিক, সামাজিক ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ওপর চাপ উক্ত ৬টি রোগের চেয়ে কোনো অংশেই কম নয়; বরং বেশিই। তাই সরকারের প্রতি উদাত্ত আহ্বান—বার্ধক্যে উপনীত হওয়া সব ব্যক্তির মধ্যে সবচেয়ে অসহায় এ অংশটিকে সব ধরনের সামাজিক সুরক্ষার আওতায় নিয়ে এসে তাদের শেষ দিনগুলোয় পাশে দাঁড়ানোর।
এবার আসি আইনগত সুরক্ষার কথায়। বাস্তব অভিজ্ঞতায় প্রায়শই দেখা যায় যে সন্তান ও পরিবারের সদস্যদের অবহেলায় ধুঁকে ধুঁকে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যান বিপুল ধনসম্পত্তির মালিক হয়েও ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত অনেক ব্যক্তি। শিকার হন নির্যাতনের। রাজধানী ঢাকারই এক সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিকে চিনি, যার একমাত্র সন্তান দিনের পর দিন এক ফোঁটা জল পর্যন্ত মুখে না দিয়ে তিলে তিলে মেরেছে নিজ বাবাকে। অন্য সন্তানেরা দূর থেকে কেবল চেয়ে চেয়ে দেখেছে, আর বিচারের জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরেও বিচার পাননি। এখানে যেমন আছে আইনের শাসনের অভাব, তেমনি আছে আইনেরও নানা সমস্যা। যেমন সন্তানের অবহেলা বা নির্যাতনের কারণে কোনো পিতার মৃত্যু হলে সেই সন্তান কি পিতার সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হবেন—প্রচলিত বার্ধক্য বিষয়ক আইনে এ নিয়ে স্পষ্ট কোনো বিধান নেই। এ ক্ষেত্রে দেওয়ানি ও ফৌজদারি উভয় উপাদানের আলোকে বিচার এবং ফৌজদারি অপরাধের প্রমাণ সাপেক্ষে উত্তরাধিকার বিষয়ে আদালত সিদ্ধান্ত প্রদানের কর্তৃত্ব রাখে। এ বিষয়ে প্রচলিত আইনে সুস্পষ্ট বিধান এনে সংশোধনীর সুপারিশ করছি। একজন ডিমেনশিয়ার সাথে বসবাসকারী ব্যক্তি যেহেতু তার যৌক্তিক চিন্তার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেন, এ ক্ষেত্রে তার সম্পত্তির বিষয়ে মানসিক স্বাস্থ্য আইনে কিছুটা বলা হলেও তার চিকিৎসা সিদ্ধান্ত ও অক্ষমতা-পরবর্তী চিকিৎসা ব্যয় নির্বাহ নিয়ে কোনো সুরক্ষা আইনে স্পষ্ট নিশ্চিত করা হয়নি।
ডিমেনশিয়া আক্রান্ত ব্যক্তির ভরণপোষণ, যত্ন ও চিকিৎসা নিয়ে সন্তানদের মাঝে শুরু হয় পারস্পারিক দায় চাপানোর প্রবণতাকে নেবে এ দায়! শেষমেশ কোনো এক সন্তানকেই হয়তো মানবিক বিবেচনায় গ্রহণ করতে হয় পিতার বা মাতার সার্বিক ভার। দেওয়ানি আইনে পিতার মৃত্যুর পর তার যেকোনো দেনা ও অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার ব্যয় সন্তানের দেনা হিসেবে বর্তায় এবং তা পিতার সম্পত্তি থেকে ব্যয় করা আইনত বাধ্যতামূলক। এর আলোকে পিতার ব্যয়ভার যদি এক সন্তান বহন করেন, সেক্ষেত্রে এ ব্যয় কেন অন্য সন্তানদের ওপর পিতার দেনা হিসেবে বর্তাবে না? এ বিষয়ে পিতা-মাতার ভরণপোষণ আইনে স্পষ্ট ধারা সন্নিবেশ করা একান্ত জরুরি।
ডিমেনশিয়ার সাথে বসবাসকারী ব্যক্তিরা তাদের সোনালি যৌবনের মেধা, শক্তি, সামর্থ্য একসময় এ দেশের কল্যাণেই ব্যয় করেছেন। পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রকে দিয়েছেন অনেক কিছু। এখন রাষ্ট্রের দায়িত্ব তাদের মৌলিক সুরক্ষা নিশ্চিতকল্পে আইনগত ও আর্থ-সামাজিক সুরক্ষায় নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা।
ইমদাদুল হক তালুকদার : জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ