শিশুদের ডে-কেয়ার সেন্টার জরুরি কেন?

শিশুদের নিরাপত্তা নিয়ে আমরা নানাভাবে চিন্তা করি। যেমন নিরাপদ বাসা-বাড়ি, খেলার মাঠ, বন্ধু, স্কুল, সড়ক ইত্যাদি। আমরা ভাবি দীর্ঘ বা স্বল্প সময়ের জন্য শিশুকে বাড়িতে রেখে বাইরে বের হলে কার কাছে রেখে যাবো? কে দেখবে আমার শিশুকে? কার কাছে পাবে নিরাপত্তা? কোথায় সে নিরাপদ?
একটা সময় যৌথ পরিবারের পারিবারিক কাঠামো আমাদের বাঁচিয়েছিল। বাড়ির শিশুদের নিরাপত্তা, দেখাশোনা, খাবার, খেলাধুলা, কোনোকিছু নিয়েই ভাবতে হতো না। শিশুদের খেলার সঙ্গী, একাকীত্বও ছিল না চিন্তার কারণ! সময়ের সাথে পরিস্থিতি বদলে গেছে নানা কারণেই!
মানুষ এক স্থান থেকে আরেক স্থানে চাকরির জন্য ছুটছে। গ্রাম থেকে শহরে এসেছে। যৌথ থেকে একক হয়েছে, একক থেকে আরও ক্ষুদ্র পরিসর খুঁজছে। বেড়েছে ঢাকামুখী মানুষের সংখ্যা। বাড়ছে ডিভোর্স। জিনিসপত্রের দামের সাথে পাল্লা দিয়ে সংসার এখন কোনো একক মানুষের আয়ে চালানো হয়ে গেছে কঠিন! ইভটিজিং, শ্লীলতাহানি, ধর্ষণসহ নানা রকমের সামাজিক সমস্যাও মানুষকে প্রতিনিয়ত ভাবাচ্ছে।
জীবন ও জীবিকার তাগিদে ছুটতেই হবে মানুষকে। ক্যারিয়ার পুরুষের যেমন প্রয়োজন তেমনি নারীর। পৃথিবীকে বাঁচিয়ে রাখতে প্রয়োজন নারী ও পুরুষের সমান অংশগ্রহণ। কিন্তু একই সাথে সন্তানের চিন্তাও আচ্ছন্ন করে রাখছে তাদের! তাহলে?
ঠিক এ মুহূর্তে আমরা যারা ঢাকা বা অন্যান্য শহরে থাকি এবং একই সাথে স্বামী ও স্ত্রী দুজনেই কর্মজীবী তাদের কাছে সবচেয়ে বড় চিন্তা হলো সন্তানকে নিরাপদ আশ্রয়ে কার কাছে রেখে চাকরি করা যায়? সন্তান একটি হলেও একরকম চিন্তা আর একাধিক হলে আরও বেশি চিন্তা! এ চিন্তা সিঙ্গেল মাদারদেরও আছে, সিঙ্গেল ফাদারদেরও আছে। চিন্তা আছে যারা অর্থ খরচ করে বেশি দামের ন্যানি রাখতে পারেন না তাদেরও। চিন্তা আছে যাদের অফিস এবং বাসা অনেক দূরে, চাইলেও প্রয়োজনে সন্তানের কাছে ছুটে যেতে পারেন না!
এমন সব পরিস্থিতি মোকাবিলায় অভিভাবকেরা তাদের বাবা-মা অথবা শ্বশুর-শাশুড়ির সাহায্য নেন। অনেকেই নিজ নিজ দেশের বাড়ি থেকে গৃহকর্মী বা কেয়ারগিভার আনেন। যার দেশের বাড়িতে তেমন ব্যবস্থা নেই তারা শহরেই একজন অপরিচিত গৃহকর্মী খুঁজে নেন নিজ এলাকায়। সেক্ষেত্রেও নানা ধরনের নির্যাতনের সংবাদ আমরা পত্রিকায় দেখি।
বাড়িতে থাকা গৃহকর্মীর বেশিরভাগই আধুনিক প্যারেন্টিং সম্পর্কে জানেন না বা বোঝেন না বা ধারণা নেই। এটাই স্বাভাবিক। পূর্ণভাবে তাদের ওপর নির্ভর করাটাও বোকামি। এ অবস্থায় বেশিরভাগ অভিভাবক তাদের সন্তানদের অঢেল অর্থ ব্যয়ে ডে-কেয়ার সেন্টারে রাখতে পারছেন না।
ঠিক এমন পরিস্থিতিতে অনেকেই ভাবতে পারেন পুরুষরা বাইরে কাজ করলে আর নারীরা সম্পূর্ণভাবে ঘর সামালালে এই সমস্যা থেকে মুক্তি মিলবে। সত্যিই কি তাই? সামাজিকভাবে বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে নারীর কন্ট্রিবিউশান কি অর্থনৈতিকভাবে অপ্রয়োজনীয়? মূল্যহীন? সামাজিক সমস্যার সমাধান হিসেবে মানুষ হিসেবে নারীর ব্যক্তিগত ইচ্ছে বা অনিচ্ছাকে বেঁধে রাখলে যে নতুন করে আর কোনো সমস্যা-সংকট তৈরি হবে না সে কথা কিন্তু বলা যায় না!
এখন এমন সমস্যার সমাধান কী হতে পারে? নিজের সন্তানদের সম্পূর্ণ দায়িত্ব কি বৃদ্ধ বাবা-মায়ের ওপর দিয়ে দেওয়া ঠিক হবে? এক প্রজন্মের প্যারেন্টিং স্টাইলের সাথে আরেক প্রজন্মের প্যারেন্টিং স্টাইলের কি পার্থক্য নেই? অনেক পরিবারেই কেবল ডায়াপার পরানো বা না পরানো নিয়ে কথা কাটাকাটি হয়।
কথা কাটাকাটি হয় তেল দেওয়া বা কানে সরিষার তেল দেওয়া নিয়ে। তর্ক হয় খাবারের ধরন নিয়ে। আমি কয়েকজন অভিভাবকদের কাছ থেকে জেনেছি এ সময়ের শিশুদের চঞ্চলতার সাথে বৃদ্ধ অভিভাবকদের তাল মেলানো কঠিন হয়ে গেলে মোবাইল কনটেন্ট দিয়ে ওদের শান্ত রাখার চেষ্টা বেশি করা হয়। সেক্ষেত্রে শিশুরা ঠিকঠাক কমিউনিকেশনের অভাবে ভোগে।
মোবাইল নির্ভর কনটেন্ট বেশিরভাগই হয় ইংরেজি। সেক্ষেত্রে শিশুরা বাংলা ভাষা পারিবারিকভাবে যত না শোনে তার চেয়েও বেশি শোনে ইংরেজি শব্দ! কমিউনিকেশনের সমস্যা, শব্দ শেখার সমস্যা স্পিচ ডিলের অন্যতম কারণ এ মুহূর্তে! এ ঘটনা বাড়ির ন্যানিদের ক্ষেত্রেও হয়। তারাও মোবাইল দিয়ে শিশুকে শান্ত রাখতে চায়। বাবা-মা নিজেরাও অনেক সময় শিশুকে অনেক বেশি মোবাইল নির্ভর কনটেন্ট দিয়ে ফেলেন! সমস্যা নানা ভাবেই প্রতিনিয়ত তৈরি হচ্ছে!
আসলে কোনো কিছুর স্থায়ী সমাধান বলে কিছু নেই। তবু এমন পরিস্থিতি মোকাবিলায় কিছু বিষয়ে আমরা গুরুত্ব দিয়ে ভাবতে পারি। প্রথমেই পরিস্থিতিকে এভাবে কল্পনা করে নিচ্ছি—২০২৫ সালে বসে বাবা-মা দুজনেই চাকরি করছেন যাতে করে স্বচ্ছলভাবে সংসার চালাতে পারেন। বাড়িতে অভিভাবক থাকার পরেও পুরো দায়িত্ব ছেড়ে দেননি কারণ সিনিয়র সিটিজেনদের পক্ষে ছোট শিশুর স্বাভাবিক চঞ্চলতার সাথে তাল মেলানো ক্লান্তিকর! আবার একই সাথে একটা লম্বা সময়ের জন্য তাদের নিজস্ব সময় নিয়ে নেওয়াটা হবে অমানবিক।
বাড়িতে থাকা গৃহকর্মীর বেশিরভাগই আধুনিক প্যারেন্টিং সম্পর্কে জানেন না বা বোঝেন না বা ধারণা নেই। এটাই স্বাভাবিক। পূর্ণভাবে তাদের ওপর নির্ভর করাটাও বোকামি। এ অবস্থায় বেশিরভাগ অভিভাবক তাদের সন্তানদের অঢেল অর্থ ব্যয়ে ডে-কেয়ার সেন্টারে রাখতে পারছেন না।
আরও পড়ুন
আবার শহরের সব এলাকায় ভালো ডে-কেয়ার সেন্টারও নেই! সেখানেও শিশুদের প্রতি অযত্নের নানা খবর প্রকাশিত হয়। এ অবস্থায় এই কিছু অফিস কর্মচারীদের জন্য ডে-কেয়ার সেন্টারের সুবিধা শুরু করেছেন সঠিক যত্নে ও বহনযোগ্য অর্থে, এই সংখ্যা দু-চারটে।
শহরের বেশিরভাগ অফিস এমন ডে-কেয়ার সেন্টার চালু করলে কিন্তু নারীদের সন্তান জন্ম দেওয়ার পর আর চাকরি ছেড়ে দেওয়ার প্রয়োজন হয় না। আর সেই সাথে সামাজিক সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে থাকে এটা চমৎকার ব্যাল্যান্স! এ বিষয়ে বিভিন্ন অফিস, গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি, সরকারি ও বেসরকারি নানা সংস্থা ভাবতে পারেন।
এক্ষেত্রে মানের দিকটি যাতে ঠিকভাবে বজায় থাকে সে বিষয়ে দেশের সব সেন্টারের জন্য কিছু নীতিমালা প্রণয়ন করা জরুরি। এ নীতিমালা সঠিকভাবে কার্যকর করা হচ্ছে কি না সে বিষয়েও তদারকি থাকতে হবে। কী কী থাকতে হবে সে বিষয়ে আমাদের সমাজের আর্লি চাইল্ডহুড বিষয়ক বিশেষজ্ঞ বিশেষভাবে ভূমিকা রাখতে পারেন।
বাবা-মায়ের পর ডে-কেয়ার সেন্টারের মানুষগুলোই অভিভাবকের দায়িত্ব পালন করবেন কাজেই এ জায়গায় স্বচ্ছতা, দক্ষতা, নিষ্ঠা, অভিজ্ঞতার বিষয়ে জোর দিতে হবে।
কথা হলো, ডে-কেয়ার সেন্টারের চিন্তাই সবচেয়ে নিখুঁত নিরাপত্তার চিন্তা এমনটা অবশ্য ভাবা ঠিক হবে না কারণ যেকোনো সময় নানা কারণেই নানা রকমের ঘটনা ঘটে যেতে পারে, ঘটছেও! বিশেষ করে পুষ্টিকর খাবার, খাবার সংরক্ষণ পদ্ধতি, আচরণ ইত্যাদি বিষয়গুলো গুরুত্বপূর্ণ।
আবার জাতি, ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ, শ্রেণি, রাজনৈতিক মতাদর্শ নির্বিশেষে একটা চমৎকার শেখার পরিবেশও নিশ্চিত করতে হবে। বাবা-মায়ের পর ডে-কেয়ার সেন্টারের মানুষগুলোই অভিভাবকের দায়িত্ব পালন করবেন কাজেই এ জায়গায় স্বচ্ছতা, দক্ষতা, নিষ্ঠা, অভিজ্ঞতার বিষয়ে জোর দিতে হবে।
নীতিমালা প্রণয়নের আগে জরুরি হলো সমাজ ও সমাজের মানুষকে এ বিষয়ে সতর্ক করা। এ বিষয়ে প্রচুর আলোচনা, টক-শো হওয়া উচিত। সরকারের পক্ষ থেকেও নানা পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। নানা ধরনের বিজ্ঞাপনের মাধ্যমেও প্রচারণা চালানো চাই। অর্থাৎ প্রস্তুতির প্রয়োজন আছে।
সরকারি কিছু ডে-কেয়ার সেন্টারের কথা আমরা জানি। তা নিয়েও মিশ্র প্রতিক্রিয়া আছে। তার পাশাপাশি কিছু কিছু বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব কেয়ার সেন্টার আছে। এছাড়া আরও অনেক প্রতিষ্ঠান শুরু করেছে। এরকম প্রতিটি অফিসে থাকা চাই।
একটা ঘটনা বলে শেষ করছি, আমার এক গৃহকর্মী একবার বলেছিল সে বাচ্চা হওয়ার আগে অনেক বছর গার্মেন্টসে চাকরি করেছে। বাচ্চা হওয়ার পর খুব বেশিদিন কাজ চালাতে পারেনি। কারণ বাচ্চাকে লম্বা সময়ের জন্য দেখার কেউ ছিল না। তার গরিব বলে স্বামী ও শাশুড়িকেও কাজ করতে হতো। তবু কয়েকদিন পাশের বাড়িতে রেখে কাজে গেলেও কাজ থেকে ফিরে পরেরদিন নানা ঘটনা মীমাংসা করতে গিয়ে হয়রান হয়ে যেত!
শেষে বাসা বাড়িতে কাজে ঢুকেছে এবং শাশুড়ির সাথে কাজের সময় ভাগাভাগি করে নিয়েছে অথবা খুব ঠেকায় পড়লে কিছু সময়ের জন্য বাচ্চাকে পাশের বাড়িতে রেখে বাইরে যেতে পারত! এবং এও বলেছে সবাই মিলে কাজ না করলে বাসা ভাড়া দিয়ে, বাচ্চাদের স্কুলের বেতন দিয়ে, চিকিৎসা ও খাবার খরচ সব মিলিয়ে টিকে থাকা কঠিন হয়ে যায়!। এইসব খেটে খাওয়া মানুষদের জন্য একটা জায়গা কি শিশুদের নিরাপদে রাখার জন্য হতে পারে না?
আমি শুনেছিলাম ব্র্যাক গ্রামাঞ্চলে একটা বাড়ির গৃহিণীকে আশেপাশের কয়েকজন প্রতিবেশীর শিশুদের ট্রেনিং নিয়ে দেখাশোনা করার কাজ শিখছে! এতে তারও উপার্জন হচ্ছে এবং একই সাথে তার চারপাশের নারীদেরও নিশ্চিন্তে উপার্জনের ব্যবস্থা হচ্ছে। কাজেই ভেবে দেখতেই পারি সমাজ পরিবর্তনের জন্য এলাকা ভিত্তিক ডে-কেয়ার সেন্টার প্রতিষ্ঠার চিন্তাভাবনা করে! তাই না?
ফারহানা মান্নান : প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী, শৈশব; শিক্ষা বিষয়ক লেখক ও গবেষক
