দুর্নীতি কি কমেছে?

দেশে দুর্নীতি কমেছে, নাকি বেড়েছে? আপনি কী মনে করেন? নিজেকে প্রশ্ন করুন! উত্তর মিলবে। স্বাধীনতার পর থেকে প্রায় প্রতিটি রাজনৈতিক দলের ইশতেহারেই দেখা গেছে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্সের ঘোষণা।
আসছে জাতীয় নির্বাচনেও হয়তো দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানের ঘোষণা দেবে দলগুলো। বিগত সময়ের দিকে তাকালে দেখি এসব কেবল রাজনৈতিক বুলিই ছিল, বাস্তবে ‘কাজির গরু কেতাবে আছে, গোয়ালে নেই’ প্রবাদের মতো।
দুর্নীতির বিরুদ্ধে রাষ্ট্র বড় বড় কথা বললেও বিশ্বের সবচেয়ে বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় রয়ে গেছে বাংলাদেশ। ২০২৫ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি সর্বশেষ ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআই) ধারণা সূচকে উঠে এসেছে, ২০২৪ সালে বিশ্বে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় আমাদের অবস্থান ছিল ১৪তম। অবশ্য ২০২৩ সালে এই অবস্থান ছিল ১০ম। তার মানে কী, ২০২৩ সালের তুলনায় ২৪ সালে দুর্নীতি কমেছে? নিম্নক্রম অনুযায়ী এ সূচক দেখে খালি চোখে কমেছে মনে হলেও বাস্তবে কমেনি। বরং বাংলাদেশ স্কোর অনুযায়ী নম্বর আরও কম পেয়েছে।
২০২৩ সালে ১০০ স্কোরের মধ্যে বাংলাদেশের স্কোর ছিল ২৪, ২০২৪ সালে পেয়েছে ২৩। মানে হলো, দুর্নীতি বাড়ায় বাংলাদেশের স্কোর ২০২৩ সালের তুলনায় ২০২৪ সালে এক কমেছে। কিন্তু অন্য দেশ আরও খারাপ করায় সূচকে চার ধাপ এগিয়েছে বাংলাদেশ।
২০২৪ সালে ডেনমার্কে সবচেয়ে কম দুর্নীতি হয়েছে। আর সবচেয়ে বেশি দুর্নীতির মাত্রা ছিল দক্ষিণ সুদানে। ধারণা সূচকের দিকে তাকালে দেখা যায়, দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় বাংলাদেশ এক সময় একেক অবস্থানে থাকলেও মানুষের বাস্তব অভিজ্ঞতা বলছে—দুর্নীতি আমাদের জীবন থেকে একচুলও সরে যায়নি।
বাংলাদেশে দুর্নীতির চরিত্র কয়েকবছরে বদলে গেছে। একসময় ঘুষের পরিমাণ ছিল কম। জিনিসপত্রের দাম যেমন বেড়েছে তেমনি পাল্লা দিয়ে ঘুষের রেটও বেড়েছে। তাছাড়া ঘুষ শুধু এক জায়গায় দিলেই হয় না সেবা পেতে দিতে হয় টেবিলে টেবিলে।
বাংলাদেশে দুর্নীতির চরিত্র কয়েকবছরে বদলে গেছে। একসময় ঘুষের পরিমাণ ছিল কম। জিনিসপত্রের দাম যেমন বেড়েছে তেমনি পাল্লা দিয়ে ঘুষের রেটও বেড়েছে। তাছাড়া ঘুষ শুধু এক জায়গায় দিলেই হয় না সেবা পেতে দিতে হয় টেবিলে টেবিলে। কেজি দরে ঘুষ লেনদেন, ডলারে ঘুষ লেনদেনের তথ্যও গণমাধ্যমে এসেছে। এর থেকে বোঝা যায় ঘুষের স্তর যে কোথায় গিয়েছে।
বলা যায়, দুর্নীতি অনেক ক্ষেত্রেই সিস্টেমের ভেতরে জায়গা করে নিয়েছে। আপনি জায়গা জমির কাজে সাব রেজিস্ট্রি অফিসে কিংবা রাজউকসহ নগর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষগুলোর কাছে গেলে এসব জায়গার বাস্তব অভিজ্ঞতা প্রত্যক্ষ করতে পারবেন। সব ঠিকঠাক থাকার পরও যখন বুঝবেন আপনার ফাইল এগোচ্ছে না তখন বাধ্য হয়ে আপনার কাজ সহজে হওয়ার জন্য ঘুষ দিতে হবে।
ঘুষ দেওয়া অপরাধ হলেও অনেকক্ষেত্রে দুর্নীতির শিকার হচ্ছে সাধারণ মানুষ। ফলে দেশের নাগরিকদের বিশ্বাস জন্মাচ্ছে না যে নিয়ম মেনে চললে সেবা পাওয়া যায়। শুধু আবেদন অনলাইনে নিলেই দুর্নীতি কমে না, যদি পুরোনো অনুমোদন-নির্ভর ধাপগুলো আগের মতো থাকে।
০৭ ডিসেম্বর ২০২৫ সংবাদ সম্মেলনে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান জানান, ‘দুর্নীতি আগের চেয়ে বেড়েছে নাকি কমেছে, সে বিষয়ে তুলনামূলক তথ্য নেই। এটি নিয়ে টিআইবি কাজ করছে। কিন্তু এটা বলতে পারি, দুর্নীতি অব্যাহত আছে। রাজনৈতিক ও সরকারি স্পেসের ক্ষমতাকে অপব্যহার করে বিভিন্ন মহল দলবাজি, দখলবাজি, চাঁদাবাজিতে লিপ্ত রয়েছে। সরকারের অভ্যন্তরেও কোনো কোনো ক্ষেত্রে দুর্নীতি হয়েছে। এটা উদ্বেগজনক।’
বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে যেসব বিষয় সবচেয়ে চোখে পড়ে তা হচ্ছে-নীতি বা নিয়মকে পাস কাটানোর বদলে অনেক ক্ষেত্রে নিয়ম এমনভাবে সাজানো হয় যাতে, মানুষকে মিথ্যা বা দুর্নীতির আশ্রয় নিতে হয়। যেমন জমি ক্রয় বিক্রয়ের ক্ষেত্রে।
দেখা যায় ঢাকার গুলশান, বারিধারা কিংবা ধানমন্ডির মতো জায়গায় প্রকৃত বাজার মূল্য যা তার অনেক কম মূল্য দেখানো হয় দলিলে। ফলে ক্রেতা যে দরে জমি কিনেছে তা সরকারকে দেখাচ্ছে অনেক কম দরে। এটা শুধু রাজধানীর কয়েকটি এলাকার চিত্র নয়। সারাদেশেই প্রায় একই অবস্থা।
আরও পড়ুন
ফলে বৈধ অর্থে জায়গা-জমি ক্রয় করলেও সিস্টেমের কারণে বাকি অর্থ অপ্রদর্শিত থেকে যাচ্ছে। সরকারও হারাচ্ছে বিপুল রাজস্ব। আবার করের বোঝা থেকে বাঁচতেও মৌজা দরে রেজিস্ট্রেশন করছেন ক্রেতারা। এ সমস্যা সমাধানে প্রকৃত বাজারমূল্যে জমি কেনাবেচার পদ্ধতি বের করতে সরকারিভাবে এর আগে নানা পদক্ষেপ নিলেও সমাধান মেলেনি।
এতে প্রতিবছর কোটি টাকা রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার। কাজেই কখনো কখনো রাষ্ট্রের সিস্টেমের কারণেও নাগরিকরা বাধ্য হয়ে অনিয়ম বা দুর্নীতিতে জড়িয়ে যান।
আমাদের সেবাখাতগুলোর দিকে তাকালেও দেখা যায়, সেখানে দুর্নীতির চিত্র এখনো ব্যাপক। সেবা পেতে এখনো দৌড়ঝাঁপ, মধ্যস্বত্ব আর অনিশ্চয়তা।
আপনি ওয়াসা, বিদ্যুৎ অফিস কিংবা কোনো সেবা সংস্থায় আবেদন করলেন সেবা পেতে। আপনি জানেনই না আপনার আবেদন কোন ধাপে আছে, কেন আটকে আছে বা কতদিন লাগবে। অনেকক্ষেত্রে টাকা দিলেই মিলছে সমাধান।
দুর্নীতি না কমার ক্ষেত্রে অন্যতম কারণ তদন্ত সংস্থার স্বাধীনতার সীমাবদ্ধতাও। আইনগতভাবে স্বাধীন বলা হলেও বাস্তবে তদন্ত শুরু হবে কি না, তার গতিবিধি কেমন হবে—এসবই প্রায়ই নিয়ন্ত্রিত বার্তার ওপর নির্ভর করে বলে জনশ্রুতি থাকে।
আর যারা দুর্নীতির তথ্য প্রকাশ করেন—তদন্ত সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা, প্রশাসনিক কর্মকর্তা, ব্যাংকার বা সাংবাদিক—তাদের প্রত্যাশিত সুরক্ষা নেই। ফলে অধিকাংশই নীরব থাকেন, আর নীরবতার মধ্যেই দুর্নীতি আরও পাকাপোক্ত হয়।
বিগত সময় থেকে দেখছি, রাজনৈতিক দলের নেতারাও দুর্নীতির বিরুদ্ধে বড় বড় কথা বললেও দেখা যায় রাজনৈতিক দলের অর্থায়ন অস্বচ্ছ। দলগুলো কীভাবে অর্থ পায়, কোথায় তা খরচ হয়—এ বিষয়ে স্বচ্ছতা না থাকলে নীতিনির্ধারণে অর্থদাতা বা স্বার্থগোষ্ঠীর প্রভাব থাকা স্বাভাবিক। এর পাশাপাশি রাজনৈতিক দলের অর্থায়নে স্বচ্ছতা আনা খুব জরুরি।
ভুটান, দক্ষিণ কোরিয়া বা ইন্দোনেশিয়ার অভিজ্ঞতা বলে, শক্তিশালী তদন্ত সংস্থা দুর্নীতির মাত্রা কমাতে পারে, শর্ত হলো এর ওপর রাজনৈতিক প্রভাব যেন না পড়ে।
অনেক দেশেই এই ধরনের স্বচ্ছতার মাধ্যমে দুর্নীতি কমানোর মূল ভিত্তি তৈরি করেছে। একইভাবে, তথ্যদাতা বা হুইসেল ব্লোয়ারদের জন্য আইনি এবং নিরাপত্তা সুরক্ষা কার্যকর করা প্রয়োজন। কেউ যদি অনিয়ম প্রকাশ করেন, তাকে যেন হুমকি, মামলা বা হয়রানির মুখে না পড়তে হয়—এটা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব।
দেশে দুর্নীতি কমাতে হলে দুর্নীতি দমন কমিশন, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ), গোয়েন্দা সংস্থাসহ তদন্ত সংস্থার স্বাধীনতা কাগজে নয়, বাস্তবে নিশ্চিত করতে হবে।
নিয়োগ, বাজেট, তদন্তের অগ্রাধিকার—এসব নির্ধারণে নির্বাহী প্রভাব কমানো ছাড়া পথ নেই। ভুটান, দক্ষিণ কোরিয়া বা ইন্দোনেশিয়ার অভিজ্ঞতা বলে, শক্তিশালী তদন্ত সংস্থা দুর্নীতির মাত্রা কমাতে পারে, শর্ত হলো এর ওপর রাজনৈতিক প্রভাব যেন না পড়ে।
বাংলাদেশের মতো দেশে দুর্নীতি যেন স্রেফ আচরণগত নয়, কাঠামোগতও। এর শিকড় প্রশাসনিক প্রক্রিয়া, রাজনৈতিক অর্থায়ন, ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ এবং সামাজিক সহনশীলতার গভীরে ঢুকে গেছে। ফলে কোনো একক পদক্ষেপে সমাধান আসে না।
যে দেশগুলো আজ স্বচ্ছতার উদাহরণ, তারা একসময় আমাদের চেয়েও বেশি সমস্যায় ছিল। তারা কাঠামো বদলেছে, নিয়ম সহজ করেছে, তদন্ত স্বাধীন করেছে, আর সমাজ অনিয়মকে সহ্য করা বন্ধ করেছে। আমাদের ক্ষেত্রেও পথটা সেই একই।
ইচ্ছা থাকলেই হয় না; কাঠামো বদলালে আচরণ বদলায়, আর আচরণ বদলালে ফেরে আস্থা। দুর্নীতি বিরোধী দিবস পালনের আনুষ্ঠানিকতার বাইরে গিয়ে এই আস্থাই দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের সবচেয়ে বড় শক্তি।
সবশেষে, রাষ্ট্রের ভূমিকার পাশাপাশি নাগরিকের ভূমিকা অস্বীকার করা যায় না। সেইসঙ্গে দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই চলমান রাখতে নাগরিকদের চাপও প্রয়োজন। সেই চাপ বা গণজোয়ার সবদিক থেকে আসলেই দুর্নীতি বন্ধ হয়। আমরা সেই চাপ বা গণজোয়ারের অপেক্ষায় আছি।
আদিত্য আরাফাত : অ্যাসাইনমেন্ট এডিটর, ডিবিসি নিউজ
