নির্বাচনকালীন প্রস্তুতি: রাষ্ট্রের সক্ষমতা ও তাত্ত্বিক পর্যালোচনা

নির্বাচন একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও সংবেদনশীল রাজনৈতিক প্রক্রিয়া। নির্বাচন কমিশন যখন আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচনী তফসিল ঘোষণা করে, তখন কেবল ভোটগ্রহণের তারিখই নির্ধারিত হয় না, বরং একটি রাষ্ট্র কার্যত “নির্বাচনকালীন শাসনব্যবস্থা”-তে প্রবেশ করে। এই সময়ে আইনশৃঙ্খলা, প্রশাসনিক নিরপেক্ষতা, রাজনৈতিক সহনশীলতা, নাগরিক সচেতনতা ও প্রাতিষ্ঠানিক বিশ্বাস— সবকিছু একসঙ্গে পরীক্ষার মুখে পড়ে। উন্নত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলো এই সময়টিকে অত্যন্ত পরিকল্পিত ও তাত্ত্বিকভাবে নির্দেশিত প্রস্তুতির মাধ্যমে মোকাবিলা করে। আজকের এই লেখায় রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিভিন্ন তাত্ত্বিক ও আধুনিক গণতান্ত্রিক অনুশীলনের আলোকে নির্বাচনকালীন প্রস্তুতির বিষয়টি বিশ্লেষণ করতে চাই।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী জোসেফ শুম্পেটার (Joseph Schumpeter) গণতন্ত্রকে সংজ্ঞায়িত করেছেন এমন একটি প্রক্রিয়া হিসেবে, যেখানে জনগণ নিয়মিত ও প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচনের মাধ্যমে নেতৃত্ব বেছে নেয়। এই সংজ্ঞার মূল শক্তি নির্বাচন প্রক্রিয়ার বিশ্বাসযোগ্যতার ওপর নির্ভরশীলতা। এ কারণে নির্বাচন কমিশনের তফসিল ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রের প্রধান দায়িত্ব হয়ে দাঁড়ায় বিশ্বাসযোগ্যতা রক্ষা এবং যথাযথভাবে সেটি পরিচালিত করা। শুম্পেটারের দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী, নির্বাচন যদি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ না হয়, তাহলে গণতন্ত্র কার্যত অর্থহীন হয়ে পড়ে। ফলে নির্বাচনকালীন প্রস্তুতি মানে কেবল প্রযুক্তিগত প্রস্তুতি নয়; এটি রাজনৈতিক নৈতিকতা ও প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতার প্রশ্ন।
রবার্ট ডাল (Robert A. Dahl) তার “পলিআর্কি” তত্ত্বে অংশগ্রহণ ও প্রতিযোগিতা — এই দুইটি উপাদানকে গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। নির্বাচনকালীন প্রস্তুতির প্রথম ধাপই হলো এই দুই উপাদান নিশ্চিত করা। উন্নত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলো তফসিল ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য সমান সুযোগ, গণমাধ্যমে ভারসাম্যপূর্ণ প্রচার এবং নাগরিকদের নির্ভয়ে মত প্রকাশের পরিবেশ তৈরি করে। উদাহরণস্বরূপ, কানাডা বা জার্মানিতে নির্বাচন ঘোষণার পরপরই নির্বাচন কমিশন স্পষ্ট আচরণবিধি জারি করে এবং প্রশাসনকে রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা বজায় রাখার জন্য কঠোর নির্দেশনা দেয়। এটি ডালের তত্ত্বের বাস্তব প্রতিফলন।
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নির্বাচনকালীন প্রস্তুতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলোর একটি। ম্যাক্স ওয়েবারের (Max Weber) রাষ্ট্রতত্ত্ব অনুযায়ী, রাষ্ট্র হলো সেই প্রতিষ্ঠান, যার বৈধ বলপ্রয়োগের একচেটিয়া অধিকার রয়েছে। নির্বাচনকালীন সময়ে এই বলপ্রয়োগ যেন রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহৃত না হয়, এটাই ওয়েবারের তত্ত্ব থেকে উদ্ভূত প্রধান শিক্ষা। উন্নত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নির্বাচন কমিশনের অধীনে বা কমিশনের নির্দেশনার আলোকে কাজ করতে দেখা যায়। যুক্তরাজ্যে নির্বাচন ঘোষণার পর পুলিশ ও প্রশাসনকে নির্দলীয়ভাবে কাজ করার জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণ ও নির্দেশনা দেওয়া হয়, যাতে তারা কোনো দলের পক্ষে বা বিপক্ষে অবস্থান না নেয়।
নাগরিক সচেতনতা নির্বাচনকালীন প্রস্তুতির আরেকটি মৌলিক স্তম্ভ। অ্যালেক্সিস দ্য টকভিল (Alexis de Tocqueville) তার “ডেমোক্রেসি ইন আমিরেকা’’ গ্রন্থে দেখিয়েছেন, গণতন্ত্রের স্থায়িত্ব কেবল আইনের ওপর নয়, নাগরিকদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও সচেতনতার ওপর নির্ভর করে। এই তত্ত্বের আলোকে উন্নত রাষ্ট্রগুলো নির্বাচন ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে ব্যাপক ভোটার শিক্ষামূলক কার্যক্রম শুরু করে। সুইডেন বা অস্ট্রেলিয়ায় ভোটারদের জন্য তথ্যভিত্তিক প্রচারণা চালানো হয়— কীভাবে ভোট দিতে হবে, কেন ভোট গুরুত্বপূর্ণ এবং গুজব বা ভুল তথ্য থেকে কীভাবে সতর্ক থাকতে হবে। এর ফলে নির্বাচনকালীন উত্তেজনা ও সহিংসতার সম্ভাবনা কমে।
প্রচারণা ব্যবস্থাপনাও নির্বাচনকালীন প্রস্তুতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। জার্গেন হাবারমাসের (Jurgen Habermas) “পাবলিক স্ফেয়ার” তত্ত্ব অনুযায়ী, গণতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য একটি মুক্ত ও যুক্তিনির্ভর জনপরিসর অপরিহার্য। নির্বাচন ঘোষণার পর রাষ্ট্রের দায়িত্ব হয় এই জনপরিসরকে সুরক্ষিত রাখা। উন্নত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলো তাই নির্বাচনী প্রচারণায় ঘৃণামূলক বক্তব্য, মিথ্যা তথ্য ও সহিংস উসকানি কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও নজরদারি বাড়ানো হয়, তবে তা যেন মতপ্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব না করে এই ভারসাম্য বজায় রাখাই হাবারমাসীয় দৃষ্টিভঙ্গির বাস্তব প্রয়োগ।
প্রশাসনিক প্রস্তুতির প্রশ্নে স্যামুয়েল হান্টিংটনের (Samuel P. Huntington) “ইন্সটিটুশনালাইজেশন’’ তত্ত্ব বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক। হান্টিংটনের মতে, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নির্ভর করে প্রাতিষ্ঠানিক শক্তির ওপর, ব্যক্তির ওপর নয়। নির্বাচন ঘোষণার পর উন্নত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলো প্রশাসনের রুটিন কাজ থেকে নির্বাচন-সম্পর্কিত কাজকে আলাদা করে এবং নির্বাচন কমিশনের সক্ষমতা বাড়াতে অতিরিক্ত জনবল, প্রযুক্তি ও বাজেট বরাদ্দ করে। ভারতের নির্বাচন কমিশনের উদাহরণ এখানে উল্লেখযোগ্য। বিশাল জনসংখ্যা ও ভৌগোলিক বৈচিত্র্যের মধ্যেও তারা প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতার মাধ্যমে নির্বাচন পরিচালনা করে।
নির্বাচনকালীন সময়ে রাজনৈতিক সহনশীলতা ও সংলাপের পরিবেশ তৈরি করাও গুরুত্বপূর্ণ। জন রলসের (John Rawls) “পলিটিক্যাল লিবারালিজম” তত্ত্ব অনুযায়ী, ভিন্ন মত ও আদর্শের সহাবস্থানই গণতন্ত্রের প্রাণ। উন্নত রাষ্ট্রগুলো তাই নির্বাচন ঘোষণার পর রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংলাপ বজায় রাখে, বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক পথ খোলা রাখে। এর ফলে নির্বাচনের আগে বা পরে সংঘাতের ঝুঁকি কমে যায়।
বর্তমান সময়ের নির্বাচন আর কেবল ব্যালট বাক্স, পোস্টার কিংবা মাইকিংয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) এখন নির্বাচনী প্রক্রিয়ার দৃশ্যমান ও অদৃশ্য- উভয় স্তরেই গভীরভাবে প্রবেশ করেছে। ভোটার তালিকা বিশ্লেষণ, আচরণগত ডেটা সংগ্রহ, লক্ষ্যভিত্তিক রাজনৈতিক বিজ্ঞাপন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কনটেন্ট নিয়ন্ত্রণ, এমনকি ভুয়া তথ্য ছড়িয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রেও এআই একটি শক্তিশালী নিয়ামকে পরিণত হয়েছে। ফলে নির্বাচন কমিশন যখন তফসিল ঘোষণা করে, তখন আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোর জন্য নির্বাচনকালীন প্রস্তুতির একটি নতুন ও জটিল মাত্রা যুক্ত হয় তা হলো এআই শাসন (AI governance)।
এই প্রসঙ্গে বেলজিয়ান দার্শনিক মার্ক কোকেলবার্গ (Mark Coeckelbergh) তার গ্রন্থ এআই এথিকস এবং পলিটিক্যাল ফিলোসফি অব এআই-এ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে কেবল একটি প্রযুক্তি নয়, বরং একটি রাজনৈতিক ও নৈতিক সম্পর্ক (political-ethical relation) হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন। তার মতে, এআই কখনোই নিরপেক্ষ নয়; এটি মানুষের মূল্যবোধ, ক্ষমতার কাঠামো ও রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের মধ্যেই গঠিত হয়। এই দৃষ্টিভঙ্গি নির্বাচনকালীন এআই নিয়ন্ত্রণে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
কোকেলবার্গ যুক্তি দেন, গণতান্ত্রিক সমাজে এআই-এর প্রধান ঝুঁকি হলো— এটি গণতন্ত্রকে সহায়তা করার বদলে নীরবে ক্ষমতার ভারসাম্য বদলে দিতে পারে। নির্বাচনকালীন সময়ে যদি অ্যালগরিদমের মাধ্যমে ভোটারদের আবেগ, ভয় বা পরিচয়কে লক্ষ্য করে রাজনৈতিক বার্তা ছড়িয়ে দেওয়া হয়, তাহলে নাগরিকের স্বাধীন সিদ্ধান্তগ্রহণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কোকেলবার্গ একে বলেন “algorithmic influence without visibility”—অর্থাৎ প্রভাব আছে, কিন্তু জবাবদিহি নেই।
উন্নত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলো এই ঝুঁকি মোকাবিলায় কয়েকটি কাঠামোগত পদক্ষেপ গ্রহণ করে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের উদাহরণ এখানে গুরুত্বপূর্ণ। নির্বাচনকালীন সময়ে এআই-ভিত্তিক রাজনৈতিক বিজ্ঞাপনের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা বাধ্যতামূলক করা হয়। কোন কনটেন্ট কেন দেখানো হচ্ছে, কোন ডেটার ভিত্তিতে দেখানো হচ্ছে, তা ভোটারকে জানাতে হয়। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো দায়িত্ব ও জবাবদিহিতা। কোকেলবার্গ স্পষ্টভাবে বলেন, এআই কোনো নৈতিক এজেন্ট নয়; নৈতিক দায়িত্ব সবসময় মানুষের। তাই উন্নত রাষ্ট্রগুলো নির্বাচনকালীন সময়ে এআই ব্যবহারের দায় প্রযুক্তি কোম্পানির ওপর এককভাবে না চাপিয়ে- নির্বাচন কমিশন, রাষ্ট্র ও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ভাগ করে দেয়। কানাডা ও জার্মানিতে নির্বাচন ঘোষণার পর সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলোর সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের সরাসরি সমন্বয় কাঠামো তৈরি করা হয়, যাতে ভুয়া তথ্য বা ঘৃণামূলক কনটেন্ট দ্রুত শনাক্ত ও নিয়ন্ত্রণ করা যায়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো- এআই নিয়ন্ত্রণ যেন রাজনৈতিক দমনমূলক হাতিয়ার না হয়, সেজন্য কোকেলবার্গ সতর্ক করেছেন। নিরাপত্তার অজুহাতে যদি এআই ব্যবহারে অতিরিক্ত নজরদারি বা মতপ্রকাশ নিয়ন্ত্রণ করা হয়, তবে তা গণতন্ত্রের জন্য সমানভাবে বিপজ্জনক। উন্নত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলো তাই নির্বাচনকালীন এআই নীতিমালায় একটি সূক্ষ্ম ভারসাম্য বজায় রাখে— ভুয়া তথ্য নিয়ন্ত্রণ করা হয়, কিন্তু রাজনৈতিক বিরোধিতা বা ভিন্নমত দমন করা হয় না।
উন্নত রাষ্ট্রগুলো এআই-কে নিষিদ্ধ করে নয়, বরং স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও মানবিক মূল্যবোধের কাঠামোর মধ্যে এনে নির্বাচনকে সুরক্ষিত করে। এই দৃষ্টিভঙ্গি অনুসরণ করলে নির্বাচন কমিশনের তফসিল ঘোষণার পর রাষ্ট্র শুধু আইনশৃঙ্খলা নয়, বরং ডিজিটাল গণতন্ত্রকেও সুরক্ষিত রাখতে সক্ষম হয়।
সবশেষে বলা যায়, নির্বাচন কমিশনের তফসিল ঘোষণা কোনো একক প্রশাসনিক ঘোষণা নয়; এটি একটি রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক সক্ষমতার (যাছাই-বাছাই) লিটমাস টেস্ট। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের তাত্ত্বিকদের বিশ্লেষণ দেখায়, নির্বাচনকালীন প্রস্তুতি সফল হতে হলে আইনশৃঙ্খলা, নাগরিক সচেতনতা, প্রশাসনিক নিরপেক্ষতা, রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের কার্যকারিতা প্রভৃতি বিষয়ে সমন্বয় জরুরি। উন্নত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলো এই সমন্বয়কে তাত্ত্বিক ভিত্তি ও বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে গড়ে তুলেছে। সেই অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে যে কোনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র যদি নির্বাচনকালীন প্রস্তুতিকে কেবল আনুষ্ঠানিকতা নয়, বরং একটি সামগ্রিক রাজনৈতিক প্রক্রিয়া হিসেবে বিবেচনা করে, তবে নির্বাচন সত্যিকার অর্থেই জনগণের ক্ষমতায়নের উৎস হয়ে উঠতে পারে।
লেখক: ড. সুলতান মাহমুদ রানা, অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
ই-মেইল: [email protected]
