জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে বৈঠকে ৩৪ সংস্কারে জোর এনসিপির

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের আহ্বানে সাড়া দিয়ে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) একটি প্রতিনিধি দল আলোচনায় অংশগ্রহণ করে। এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামের নেতৃত্বে এতে অংশ নেন দলটির আরও ছয় নেতা। প্রথম বৈঠকে ৩৪টি সংস্কার নিয়ে আলোচনা হয়েছে।
শনিবার (১৯ এপ্রিল) সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের কার্যালয়ে বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে জাতীয় নাগরিক পার্টির পক্ষ থেকে প্রধান প্রধান সংস্কারগুলো নিয়ে আলোচনা হয়েছে বলে দলটির যুগ্ম সদস্য সচিব (দপ্তর) সালেহ উদ্দিন সিফাত জানিয়েছেন।
বৈঠকে আরও অংশ নেন দলটির সদস্য সচিব আখতার হোসেন, মুখ্য সংগঠক (দক্ষিণাঞ্চল) হাসনাত আব্দুল্লাহ, মুখ্য সমন্বয়ক নাসির আব্দুল্লাহ, সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক সামান্তা শারমিন, সিনিয়র যুগ্ম সদস্য সচিব নাহিদা সারওয়ার নিভা, যুগ্ম আহ্বায়ক ও সংস্কার সমন্বয় কমিটির কো-অর্ডিনেটর সারোয়ার তুষার এবং যুগ্ম আহ্বায়ক ও সংস্কার সমন্বয় কমিটির সদস্য জাবেদ রাসিন।
দিনব্যাপী আলোচনায় সংস্কার প্রশ্নে প্রাথমিক ধাপে ঐকমত্যের নানা দিক নিয়ে আলোচনা হয়। সংবিধান, নির্বাচন কমিশন, বিচার বিভাগ নিয়ে দীর্ঘ আলোচনায় রাষ্ট্রের মৌলিক সংস্কারের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় সংস্কারের প্রসঙ্গ উঠে আসে। দুদক ও জনপ্রশাসন সংস্কার পরবর্তী আলোচনার জন্য রাখা হয়।
এনসিপির পক্ষ থেকে বলা হয়, বর্তমান ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার বিলোপ ঘটিয়ে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও ব্যবস্থা কায়েমের লক্ষ্যে যে সংস্কার প্রয়োজন সেটাই মৌলিক সংস্কার; যার মাধ্যমে এক ব্যক্তিকেন্দ্রিক ক্ষমতা কাঠামোর পরিবর্তন হবে। ক্ষমতার ভারসাম্য, জবাবদিহিতা, ও নিয়ন্ত্রণ ছাড়া মৌলিক কোনো পরিবর্তন আসবে না। ফলে ক্ষমতা কাঠামো কেন্দ্রিক সংস্কারের বিরোধিতা করে অন্য সব সংস্কারে রাজি হয়েও লাভ নেই, তা মৌলিক সংস্কার হবে না। কোন পদ্ধতি বা প্রক্রিয়ায় সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়ন হবে তা প্রাথমিক সভায় আলোচিত হয়নি।
আরও পড়ুন
এনসিপি মনে করে সংবিধানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সংস্কারের লক্ষ্যে গণপরিষদ নির্বাচনের আয়োজন করতে হবে। সংবিধানের সঙ্গে সম্পর্কিত নয় এমন সংস্কার বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারই অধ্যাদেশের মাধ্যমে কার্যকর করবে।
প্রথম বৈঠকে আলোচিত ৩৪ সংস্কার–
১. একজন ব্যক্তি সর্বোচ্চ দুইবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতি হতে পারবেন না। প্রধানমন্ত্রী পরবর্তীতে আর রাষ্ট্রপতি হতে পারবেন না।
২. রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও সরকারের মেয়াদ হবে চার বছর।
৩. সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে দলীয়করণ ও রাজনৈতিক প্রভাব থেকে মুক্ত করার লক্ষ্যে জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিলের মাধ্যমে এবং উচ্চকক্ষের পরামর্শ/মতামতক্রমে সাংবিধানিক পদগুলোতে নিয়োগ দিতে হবে।
৪. পার্লামেন্ট হবে দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট। উচ্চকক্ষ গঠিত হবে প্রাপ্ত ভোটের আনুপাতিক হারে। নির্বাচনের আগেই উচ্চকক্ষের প্রার্থীর তালিকা প্রকাশ করতে হবে।
৫. ১০০ আসনে সরাসরি ভোটের মাধ্যমে নারী সংসদ সদস্য নির্বাচন নিশ্চিত করতে হবে।
৬. ইলেক্টরাল কলেজ পদ্ধতিতে নিম্নকক্ষ ও উচ্চকক্ষের সদস্য, জেলা সমন্বয় কাউন্সিল এবং স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সরাসরি ভোটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হবেন।
৭. সংবিধান সংশোধনের ক্ষেত্রে উভয়কক্ষের দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যদের সমর্থনের পাশাপাশি গণভোটের বিধান থাকতে হবে।
৮. আইনসভার স্থায়ী কমিটিগুলোর সভাপতি সবসময় বিরোধী দলীয় সদস্যদের মধ্য থেকে মনোনীত হবেন।
৯. সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের ভোটে উভয়কক্ষের স্পিকার নির্বাচিত হবেন।
১০. বিচার বিভাগের রাজনীতিকরণ রোধে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। যেমন– আপিল বিভাগের বিচারকদের মধ্য থেকে সর্বোচ্চ জ্যেষ্ঠ বিচারককে প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ প্রদানকে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের বিধান সংবিধানে যুক্তকরণ; বিচার প্রাপ্তির ক্ষেত্রে দুর্ভোগ লাঘবের উদ্দেশ্যে সকল বিভাগে হাইকোর্টের সমান এখতিয়ার সম্পন্ন স্থায়ী আসন প্রবর্তন; সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের আসন রাজধানীতে স্থাপন, স্বতন্ত্র সচিবালয় ও আর্থিক স্বাধীনতা, স্থায়ী অ্যাটর্নি সার্ভিস, জুডিশিয়াল অ্যাপয়েন্টমেন্ট কমিশন।
১১. ‘অধস্তন আদালত’-এর পরিবর্তে ‘স্থানীয় আদালত’ ব্যবহার করা।
১২. ৭২ এর সংবিধানের চার মূলনীতি এবং পরবর্তীতে সংশোধনীর মাধ্যমে গৃহীত বিভিন্ন দলীয় মূলনীতিকে সংবিধানের মূলনীতি থেকে বাদ দিতে হবে। প্লুরালিজমের সর্বজন গ্রহণযোগ্য বাংলা প্রতিশব্দ খুঁজে পেতে হবে।
১৩. বাংলাদেশের অধিবাসী এমন প্রত্যেক জাতি ও নৃগোষ্ঠীর সাংবিধানিক স্বীকৃতি নিশ্চিত করতে হবে।
১৪. নিরবচ্ছিন্ন ইন্টারনেট প্রাপ্তির অধিকারকে মৌলিক অধিকারের স্বীকৃতি দিতে হবে।
১৫. মৌলিক অধিকার হবে নিরঙ্কুশ ও আদালত দ্বারা বলবৎযোগ্য। অর্থনৈতিক অধিকার ধারাবাহিকভাবে বাস্তবায়ন ও অর্জনের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।
১৬. প্রার্থীর ন্যূনতম বয়স ২৩ এবং ভোটাধিকারের ন্যূনতম বয়স ১৬ করতে হবে।
১৭. ডেপুটি স্পিকার অন্তত একজন হবেন বিরোধী দলের।
১৮. প্রধানমন্ত্রী ও দলের প্রধান একই ব্যক্তি হবেন না।
১৯. প্রধানমন্ত্রী শাসিত নয়, সরকার হবে মন্ত্রিপরিষদ শাসিত।
২০. সংসদ সদস্যরা স্থানীয় উন্নয়ন কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকবেন।
২১. সংসদ সদস্যদের স্বাধীনতা এবং সরকারের স্থিতিশীলতার (অর্থবিল ও আস্থা ভোট ব্যতিরেকে দলের বিরুদ্ধে ভোটদানের বিধান) সাপেক্ষে ৭০ অনুচ্ছেদের সংস্কার করতে হবে।
২২. স্বাধীন কমিশনের মাধ্যমে সংসদীয় আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণ করতে হবে।
২৩. শান্তিপূর্ণ ও নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে ক্ষমতা হস্তান্তর যেন নির্বিঘ্নে হয়, তেমন প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা করতে হবে। নির্বাচন আয়োজনের উদ্দেশ্যে গঠিত অন্তর্বর্তী/তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তী/তত্ত্বাবধায়ক সরকার অভিহিত করতে হবে।
২৪. উচ্চকক্ষে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী, ধর্মীয় সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্বসহ বিশেষজ্ঞদের অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করতে হবে।
২৫. উচ্চকক্ষের মোট আসনের ২৫ ভাগ নারীদের জন্য বরাদ্দ করতে হবে। দলগুলোর মোট আসনের ৩৩ ভাগ নির্দলীয় ব্যক্তিদের জন্য বরাদ্দ করতে হবে।
২৬. ন্যায়পাল জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিলের বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্ত করবে।
২৭. স্থানীয় সরকার নির্বাচন হবে নির্বাচন কমিশনের সরাসরি তত্ত্বাবধানে। স্থানীয় সরকার কমিশন প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
২৮. জরুরি অবস্থা চলাকালীন মৌলিক অধিকার রদ করা যাবে না।
২৯. ফৌজদারি অপরাধের দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি ছাড়া প্রাপ্তবয়স্ক যেকোনো ভোটার নির্বাচনের প্রার্থী হওয়ার অধিকার সংরক্ষণ করেন। এক্ষেত্রে শিক্ষাগত যোগ্যতার বাধ্যবাধকতা থাকা উচিত নয়।
৩০. উচ্চকক্ষের প্রার্থীর বয়স ন্যূনতম ৩৩ করতে হবে।
৩১. ন্যায়পাল নিয়োগ বাধ্যতামূলক করতে হবে।
৩২. সংবিধান বিষয়ক অপরাধ ও সংবিধান সংশোধনের সীমাবদ্ধতা সংক্রান্ত অনুচ্ছেদ বিলুপ্ত করতে হবে।
৩৩. দুর্নীতি দমন কমিশনের সাংবিধানিক স্বীকৃতি নিশ্চিত করতে হবে।
৩৪. সুপ্রিম কোর্ট ও অধস্তন আদালতের বিচারক এবং সব আদালতের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সম্পত্তির বিবরণ ওয়েবসাইটের মাধ্যমে জনসাধারণের কাছে প্রতি আয়কর বর্ষে প্রকাশ করতে হবে। সব সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য অনুরূপ বিধান প্রযোজ্য হবে।
এমএসআই/এসএসএইচ