নিষ্ক্রিয় গণতন্ত্র মঞ্চ, দলীয় কার্যক্রম ও নির্বাচনমুখী নেতারা

সংস্কার ও শাসন ব্যবস্থা পরিবর্তনের লক্ষ্যে সাতটি দল নিয়ে গঠিত হয়েছিল গণতন্ত্র মঞ্চ। নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের প্রত্যাশায় তৈরি হওয়া এই জোট বর্তমানে কার্যত নিষ্ক্রিয়। সক্রিয় রাজনীতিতে জোটগতভাবে তাদের উপস্থিতি নেই বললেই চলে। শরিক দলের নেতারা নিজেদের দলীয় কার্যক্রম ও নির্বাচনী প্রস্তুতিতে ব্যস্ত। ফলে মঞ্চের কার্যক্রম সীমিত হয়ে পড়েছে কেবল বিবৃতি ও সংবাদ সম্মেলনে।
জোটের একাধিক নেতা জানান, গণতন্ত্র মঞ্চ গঠনের অন্যতম লক্ষ্য ছিল তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন এবং শাসনব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন। তবে ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি নির্বাচন সম্পন্ন হওয়ার পর জোটে হতাশা ছড়িয়ে পড়ে। ৫ আগস্টের পরও সেই অচলাবস্থা কাটানো সম্ভব হয়নি।
আরও পড়ুন
রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক অ্যাডভোকেট হাসনাত কাইয়ুম ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের রাজনীতির মূল কেন্দ্র হচ্ছে সংস্কার। আমরা বিশ্বাস করি সংস্কারই বাংলাদেশের রাজনীতির সংকট সমাধানের পথ। কিন্তু অন্য বিষয়কে প্রাধান্য দিতে গিয়ে রাজনীতির ক্ষতি হচ্ছে, মানুষও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
তিনি জানান, আনুষ্ঠানিকভাবে গণতন্ত্র মঞ্চ ভাঙেনি, তবে সক্রিয় নয়। অভ্যন্তরীণ নানা প্রশ্নের উত্তর না থাকায় জোট অচল হয়ে পড়েছে।
হাসনাত কাইয়ুম আরও বলেন, আমরা সবাই যখন গণতন্ত্র মঞ্চের মাধ্যমে একসঙ্গে চলা শুরু করলাম তখন যেসব বিষয়ে একমত হতে পারতাম, সেসব নিয়েই জোটগত কার্যক্রম হতো। ভিন্নমত থাকলে দলীয়ভাবে পদক্ষেপ নিতাম। গত বছরের ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের পর গণতন্ত্র মঞ্চের করণীয় নির্ধারণে কয়েকটি বৈঠক হলেও ঐকমত্যে পৌঁছানো যায়নি। আবার ৫ আগস্ট অভ্যুত্থানের পরও সেই সংকট কাটিয়ে উঠতে পারিনি। যদিও মাঝেমধ্যে চেষ্টা হয়েছে, বৈঠক করা হয়েছে, এখনও নিজেদের মধ্যে বসার তাগিদ আছে। তবে বিভিন্ন বিষয়ে মতানৈক্য থাকায় মঞ্চের পক্ষ থেকে তৎপরতা নেই।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক গণতন্ত্র মঞ্চের এক শীর্ষ নেতা বলেন, এখন যেসব বিষয়ে কারও আপত্তি নেই, কেবল সেসব নিয়েই বিবৃতি দেওয়া হয় মঞ্চের নামে।
গণতন্ত্র মঞ্চের একাধিক নেতা বলছেন, দেশে এখন নির্বাচনী হাওয়া বইছে। প্রত্যেক শরিক দল নিজ নিজ সাংগঠনিক পুনর্গঠন ও নির্বাচনী এলাকাভিত্তিক কার্যক্রমে ব্যস্ত। আবার এই সরকার সম্পর্কে সমালোচনার সুযোগও কম। নির্বাচনের পাশাপাশি সংস্কার ও বিচার এখন মূল ইস্যু, যা বর্তমান সরকারই করছে।
বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক ঢাকা পোস্টকে বলেন, মঞ্চ কেন্দ্রিক কার্যক্রম কম। দলীয় কার্যক্রমই এখন বেশি সামনে আসছে। সবাই নিজ নিজ সংগঠন ও নির্বাচনী এলাকা নিয়ে ব্যস্ত। তবে মঞ্চের ভেতরে বোঝাপড়া আছে, যদিও কিছু বিষয়ে মতপার্থক্য রয়েছে।
ভাসানী অনুসারী পরিষদের আহ্বায়ক শেখ রফিকুল ইসলাম বলেন, গণতন্ত্র মঞ্চ এখনো আছে। সবাই দলীয় কার্যক্রমে ব্যস্ত, তবে যখন প্রয়োজন হয়, তখন মঞ্চ থেকে বিবৃতি দেওয়া হচ্ছে। কয়েকদিন আগেও আমাদের অফিসে জোটের মিটিং হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, আমরা আন্দোলনে জয়লাভ করেছি। এখন সবাই নিজ নিজ দল গোছানোর কাজে ব্যস্ত। দেশে নির্বাচনী পরিবেশ তৈরি হয়েছে, ফলে সবাই সংসদীয় এলাকায় কাজ করছেন।
আরও পড়ুন
জোটের ভেতরে অভিযোগ রয়েছে, গণতন্ত্র মঞ্চের কিছু শরিক দল অন্তর্বর্তী সরকারের ঘনিষ্ঠ হওয়ায় সরকারবিরোধী অবস্থানে মঞ্চ সক্রিয় হতে পারছে না। আবার যখন সংস্কার প্রসঙ্গে অবস্থান নেওয়ার প্রয়োজন হয়, তখন অনেকেই বিএনপি ও অন্যান্য নির্বাচনী শক্তির মতানুযায়ী তাদের অবস্থান গ্রহণ করে। বিএনপির সঙ্গে সুর মিলিয়ে কথা বলে, যাতে তাদের আনুকূল্য পাওয়া যায়। যার ফলে সংস্কার প্রশ্নটি উপেক্ষিত হচ্ছে।
গণতন্ত্র মঞ্চের এক শরিক দলের শীর্ষ নেতা বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারকে বেশি চাপ দেওয়া যায় না। এই সরকারের কাজ হচ্ছে— নির্বাচন, সংস্কার ও বিচার কার্যক্রম এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। তারা সেটি করছে। তবে, আমরা জোটগতভাবে মব জাস্টিস, দ্রব্যমূল্যের সিন্ডিকেট, দুর্নীতির ইস্যুগুলোতে সক্রিয় হতে পারতাম। তাহলে মঞ্চের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা যেত।
জোটের আরেক শীর্ষ নেতা বলেন, আমরা একবার বলেছিলাম, দল হিসেবে যেহেতু মঞ্চের সঙ্গে একমত হতে পারছি না, তাই সৌজন্যতা বজায় রেখে আমরা আলাদা হয়ে যাই। তখন অন্যদের কাছ থেকে অনুরোধ আসে, আরও আলোচনা হোক, যেসব বিষয়ে আমরা একমত হতে পারছি না, সেইগুলো নিয়ে আরও আলোচনা করি। এই সময়ে মঞ্চ ভেঙে যাওয়ার খবর মানুষকে হতাশ করবে। তাই আমাদেরও সরে আসা হয়নি। তবে আমরা জানিয়েছি, এভাবে মঞ্চে থাকতে চাই না।
এই নেতার মূল্যায়ন হচ্ছে, মঞ্চের দলগুলোর জাতীয় স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেওয়ার সুযোগ ছিল, কিন্তু তা নষ্ট হয়েছে। সবাই দলীয় রাজনীতি করছে, অথচ মঞ্চ ছাড়তেও চায় না। এটি এখন দলীয় স্বার্থে ব্যবহৃত হচ্ছে।
আরও পড়ুন
গণতন্ত্র মঞ্চের তিনটি দলের দাবি, ৫ আগস্টের পর বিএনপি তাদের যুগপৎ আন্দোলনের শরিক মঞ্চের কয়েকটি দলকে আসন ছাড়ের ইঙ্গিত দিয়ে চিঠি দেয়। তবে জোটের কয়েকজন শীর্ষ নেতা সেই চিঠি না পাওয়ায় ক্ষুব্ধ হন। ফলে, যারা চিঠি পেয়েছেন, জোট নিয়ে তাদের আচরণ এক রকম। আর যারা চিঠি পাননি তাদের আচরণ আরেক রকম।
গণতন্ত্র মঞ্চের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ বিএনপির একজন নেতা বলেন, জেএসডি সভাপতি আ স ম আব্দুর রব দীর্ঘদিন অসুস্থ। তার স্ত্রী তানিয়া রব ও সাধারণ সম্পাদক জহির উদ্দিন মাহমুদ স্বপন দলীয় কার্যক্রমে বেশি ব্যস্ত। বর্তমান তারুণ্যের রাজনীতির মধ্যে নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না আগের মতো ভোকাল নন। আর বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির নেতা সাইফুল হকের ভাই সাবেক সচিব মহিবুল হকের গ্রেপ্তার নিয়ে ক্ষোভ আছে, কারণ তার গ্রেপ্তারের পেছনে বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত সাবেক এক সচিবের ইন্ধন রয়েছে। অন্যদিকে গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জুনায়েদ সাকি বিএনপি ও অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে ভারসাম্য রক্ষা করে চলেছেন। ফলে, সবাই দলীয় রাজনীতিতে এবং নিজস্ব স্বার্থে ডুবে থাকায় গণতন্ত্র মঞ্চ নিষ্ক্রিয়।
জেএসডির সাধারণ সম্পাদক শহীদ উদ্দিন মাহমুদ স্বপন ঢাকা পোস্টকে বলেন, বিএনপির দেওয়া চিঠিতে আসন বণ্টনের সুপারিশ ছিল না। বরং শরিকদের এলাকায় কাজ করতে বিএনপির নেতাকর্মীদের জন্য নির্দেশনা ছিল। একে আমরা আসন বণ্টনের নিশ্চয়তা হিসেবে দেখিনি।
তিনি গণতন্ত্র মঞ্চ প্রসঙ্গে বলেন, গণতন্ত্র মঞ্চ সংস্কারের প্রশ্নে মতামত দিচ্ছে। কিছু ভিন্নমত আছে। তাছাড়া সবাই দলীয় রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত থাকার কারণে জোটগতভাবে আগের মতো মাঠে দেখা যাচ্ছে না। তবে ঐক্য অটুট আছে।
এএইচআর/এমজে
