এনসিপি’র প্রতি ইসির ‘বিশেষ অনুগ্রহ’, অন্য দল উপেক্ষিত!

নির্বাচন কমিশনের (ইসি) পক্ষ থেকে নতুন রাজনৈতিক দলগুলোর নিবন্ধন প্রক্রিয়া নিয়ে তৈরি হয়েছে নতুন বিতর্ক। প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি)-সহ অন্য কমিশনাররা শুধুমাত্র জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) ছাড়া নিবন্ধনের জন্য আবেদন করা অন্য নতুন দলগুলোর নেতাদের সঙ্গে কোনো আনুষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিক সাক্ষাৎ করছেন না। দলগুলোর দাবি, এটি ইসি’র নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে এবং নিবন্ধন প্রক্রিয়ায় ‘ডাবল স্ট্যান্ডার্ড’ বা দ্বৈত নীতি গ্রহণের ইঙ্গিত দিচ্ছে। নতুন রাজনৈতিক দলের একাধিক নেতা এ অভিযোগ করেছেন।
ইসির নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে জানান, সম্প্রতি এনসিপি’র একটি প্রতিনিধি দলের সঙ্গে সিইসি’র রুদ্ধদ্বার বৈঠক হয়েছে। কিন্তু একই সময়ে আবেদন করা অন্য দলগুলো বারবার ইসির সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য আবেদন জানালেও সেগুলোতে কোনো সাড়া মিলছে না। তবে, এক দিন বা কয়েক ঘণ্টার নোটিশে এনসিপি’র নেতৃবৃন্দের সঙ্গে সাক্ষাৎ করছেন সিইসিসহ কমিশনাররা। মূলত এনসিপি যার সঙ্গে দেখা করতে চায় তার সঙ্গেই দেখা করতে পারে। কিন্তু অন্য দলগুলোর সঙ্গে সাক্ষাৎ করছেন না!
আরও পড়ুন
নিবন্ধন পাওয়ার তালিকায় থাকা বাংলাদেশ জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টির চেয়ারম্যান মো. দেলোয়ার হোসাইন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) ও নির্বাচন কমিশনের (ইসি) কর্মকর্তাদের সঙ্গে সাক্ষাতের ক্ষেত্রে একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলকে বিশেষ সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। অথচ নতুন দলের নিবন্ধনের আবেদনকারী অন্য দলগুলোর সঙ্গে বৈষম্যমূলক আচরণ করা হচ্ছে। যা নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে।

“সিইসি মিডিয়াতে বলেছিলেন, ‘আমার দরজা সবসময় সবার জন্য খোলা।’ এই বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে আমরা গত ৮ অক্টোবর সিইসি’র সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য উনার একান্ত সচিবের কাছে দলীয় প্যাডে লিখিত আবেদন করি। আবেদন করার ১০ দিন অতিবাহিত হলেও যখন কোনো সাড়া মেলেনি, তখন একান্ত সচিবকে কল দিই। তিনি বলেন, ‘স্যার তো অনেক ব্যস্ত, এখন দেখা করতে পারছেন না।’ এরপর সিইসি’র পরিবর্তে সচিবের সঙ্গে দেখা করার পরামর্শ দেওয়া হয়। অবশেষে আজ (২১ অক্টোবর) সচিবের সঙ্গে দেখা করি।”
অন্যান্য দলের অভিযোগ, ইসির পক্ষ থেকে শুধুমাত্র জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)-কে বিশেষ সুবিধা দেওয়া হয়। আধা ঘণ্টা কিংবা কয়েক ঘণ্টার নোটিশেও ঘণ্টার পর ঘণ্টা মিটিং করার সুযোগ পায় তারা। কিন্তু অন্য নতুন দলগুলোর নেতাদের সাথে সাক্ষাৎ করে না ইসি। এটি তাদের ‘দ্বৈতনীতি’ ছাড়া অন্য কিছু নয়
মো. দেলোয়ার হোসাইন বলেন, এনসিপি মাত্র আধা ঘণ্টার নোটিশে দেখা করে, অন্যরা পারে না। মূল বিষয় হলো— সিইসি সাক্ষাতের ক্ষেত্রে বৈষম্য করছেন। আমরা দেখতে পাই, এনসিপি যখনই আসে তখনই তারা দেখা করতে পারে এবং ঘণ্টার পর ঘণ্টা তারা মিটিং করতে পারে। যেটা আমাদের বেলায়, হয়তো ১০ মিনিট সময় পাওয়াটাও ডিফিকাল্ট (কঠিন) হয়ে যায়।
আরও পড়ুন
তিনি প্রশ্ন রাখেন, ‘দল নিবন্ধনের গণবিজ্ঞপ্তি কি শুধু এনসিপিকে নিবন্ধন দেওয়ার জন্যই।’ বৈষম্যের পাশাপাশি নির্বাচন কমিশনের দেওয়া নিবন্ধন বিজ্ঞপ্তির আইনিভিত্তি নিয়েও প্রশ্ন তোলেন দলটির চেয়ারম্যান।
সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে সংশয় প্রকাশ করে তিনি আরও বলেন, ‘এই নির্বাচন কমিশন কতটুকু নির্বাচন সুষ্ঠু করবে আমি বুঝতে পারছি না বা কতটুকু লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করবে, সেটা নিয়েও আমাদের সন্দেহ আছে।’

বাংলাদেশ জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টির চেয়ারম্যান ইসি সচিবের কাছে মাঠপর্যায়ে ‘পুনঃতদন্তের’ নামে চরম হয়রানির সুস্পষ্ট অভিযোগ তোলেন। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি তৃতীয়বার পুনঃতদন্ত বয়কট করেছে। প্রতিটি স্থানে কমপক্ষে ৫-৭ বার তদন্তের নামে সরাসরি ও গোপনে যাচ্ছেন ইসি কর্মকর্তারা। বেশিরভাগ স্থানে গোপনে সাধারণ জনগণকে দল সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। অফিসের ডিড নিয়ে বাড়ির মালিককে তার মালিকানা প্রমাণের জন্য সম্পত্তির দলিল নিয়ে হাজির থাকতে বলা হচ্ছে। এমনকি সদস্যদের ধমকানোও হচ্ছে।’
এছাড়া, অফিসের আয়তন কম, ব্যানার ছোট-বড়, মোড়ে মোড়ে ব্যানার নাই কেন, অফিস টিনের ঘর কেন, ২০০ ভোটার হাজির নাই কেন, নারী সদস্যদের সন্ধ্যা ৫-৬টার দিকে অফিসে যেতে বলা এবং এত বড় বড় দল থাকতে এই দল করেন কেন— এমন বিব্রতকর প্রশ্ন করা হচ্ছে বলে অভিযোগ দেলোয়ার হোসাইনের।
আরও পড়ুন
এদিকে, নিবন্ধনপ্রত্যাশী দল ‘মৌলিক বাংলা’র সাধারণ সম্পাদক ছাদেক আহমেদ সজীব বলেন, “বর্তমান সরকার এনসিপি’র নেতাকর্মীদের বগলে নিয়ে ঘুরছে। ভাবসাব দেখলে মনে হয়, তারা এখনই নেতা হয়ে গিয়েছেন। আমাদের ওপর যারা অত্যাচার করছে, সেই জামায়াত বা বিএনপির লোকজনদের ক্ষেত্রে মনে হয় তারা ইতোমধ্যে নির্বাচিত হয়ে গিয়েছেন। বর্তমানে যারা রাজনীতি করছে তারা কেউই আগামী দিনের কথা ভাবছেন না। তারা ভাবছেন বর্তমানের কথা।”
ইসি’র নিবন্ধন কার্যক্রম নিয়ে বিভিন্ন অভিযোগ তুলে তিনি বলেন, “প্রথমে তদন্ত, পরে পুনঃতদন্ত, এখন আবার অধিকতর তদন্ত করছে। এতে আমাদের আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে। আমাদের অনেক নেতাকর্মী অন্য পেশার পাশাপাশি রাজনীতি করেন। বারবার মাঠ পরিদর্শনে ডেকে নেওয়ায় তাদের কাজ ব্যাহত হচ্ছে। এই তদন্ত আসলে ‘রাজনৈতিক ময়নাতদন্তের’ মতো।”

‘নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা সহযোগিতার চেয়ে অসহযোগিতাই বেশি করেছেন’— উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ‘বিধিমালা অনুযায়ী প্রয়োজনীয় সব নথি জমা দেওয়ার পরও তারা আমাদের অফিসের মালিকের সম্পত্তির দলিল চাচ্ছেন, যা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক ও অনৈতিক।’
অন্যদিকে, নির্বাচন কমিশনে রাজনৈতিক দল হিসেবে নিবন্ধনের আবেদন জমা দেওয়ার পর কমিশনের আচরণে চরম হতাশা ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন ‘বাংলাদেশ আমজনগণ পার্টি’র আহ্বায়ক মোহাম্মদ রফিকুল আমিন। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘নিবন্ধনের আবেদন জমা দেওয়ার পর নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে বহুবার বৈঠক করেছি। অন্তত ১২টি বৈঠক করেছি আবেদন জমা দেওয়ার পর। তারা খুব পজিটিভ ছিলেন। আমাদের ব্যাপারে তাদের কাছে ধারণা ও প্রতিবেদন সবই ইতিবাচক ছিল। তবে, পরিস্থিতি হঠাৎ করেই পাল্টে যায়।’
আরও পড়ুন
তার অভিযোগ, ‘সেখান থেকে হঠাৎ করেই পুনঃতদন্ত দেওয়া হয়। এরপর থেকে আমরা চিঠি দিয়েও নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে দেখা করতে পারিনি। নির্বাচন কমিশনার আব্দুর রহমানেল মাছউদ সাহেবের সঙ্গে একবার দেখা করতে পারলেও, অন্যান্য কমিশনারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে পারিনি। যিনি নিবন্ধনের দায়িত্বে আছেন তিনিও আমাদের চিঠির জবাব দেননি।’
বাংলাদেশ আমজনগণ পার্টির আহ্বায়ক মনে করেন, ‘নির্বাচন কমিশনের এমন আচরণ অপ্রত্যাশিত। হয়তো উনারা দেখা করবেন কিন্তু আমাদের যখন দেখা করতে হবে, সত্য জানাতে হবে, অবস্থা জানতে হবে তখন দেখা করছেন না।’

রফিকুল আমিন কঠোর ভাষায় বলেন, ‘নির্বাচন কমিশনের দরজা রাজনীতিবিদদের জন্য সবসময় খোলা থাকা উচিত। কিন্তু তাদের এই আচরণ অনভিপ্রেত ও অগ্রহণযোগ্য। এমন রক্তক্ষয়ী গণঅভ্যুত্থানের পর আমরা নির্বাচন কমিশনের এমন আচরণ আশা করিনি। আমরা খুবই দুঃখিত এমন আচরণে। নির্বাচন কমিশন যেন দ্রুত আমাদের সঙ্গে আলোচনায় বসেন এবং নিবন্ধন প্রক্রিয়ার বর্তমান অবস্থা ও সত্য পরিস্থিতি যেন দ্রুত তুলে ধরেন।’
যা বলছে নির্বাচন কমিশন
নতুন রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন প্রক্রিয়ায় ‘পুনঃতদন্তের নামে চরম হয়রানি’ করা হচ্ছে বলে একাধিক দলের অভিযোগের বিষয়ে নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করেছেন নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদ। দলগুলোর কাছে অফিসের দলিল, দাগ নম্বর, এমনকি ব্যানারের আকার সংক্রান্ত ‘অযৌক্তিক’ তথ্য চাওয়ার অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘অভিযোগগুলো শুনেছি এবং সেগুলো গুরুত্বের সঙ্গে দেখছি।’ এই ধরনের অভিযোগের পর মাঠপর্যায়ে তার নিজেরও যাওয়া উচিত বলে মন্তব্য করেন তিনি।
সচিব বলেন, “অনেক সময় শব্দচয়নের কারণে ভুল বোঝাবুঝি হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ‘আমি যদি জিজ্ঞেস করি যে আপনার এখানে দপ্তর আছে কিন্তু কার্যক্রম তো দেখছি না’; এই একই প্রশ্ন ঘুরিয়ে ‘আপনার এখানে দপ্তর আছে, কী কী কার্যক্রম নিয়েছেন, আমাকে একটু বলেন’— এভাবে বললেও ভিন্নভাবে শোনাতে পারে। হাতের পাঁচটা আঙুল সমান না। যারা প্রশ্ন গ্রহণ করছেন বা যে তথ্যটা নিতে যাচ্ছেন, তাদের অবস্থানগত বিবেচনায় যেটা মনে হয়েছে সেটাই করছে।”

একাধিকবার পরিদর্শনের কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘আমরা একাধিকবার এটা চর্চা করতে চাই যাতে আমাদের ভুল না হয়। প্রথমবার হয়তো একজন কর্মী শুধুমাত্র ঠিকানা দেখতে যেতে পারেন, দ্বিতীয়বার একজন কর্মকর্তা তথ্য নিতে যেতে পারেন, যা ভিন্ন ভিন্ন তদন্ত হিসেবে গণ্য হতে পারে।’
আইনগতভাবে তথ্য চাওয়া প্রসঙ্গে সচিব বলেন, ‘আইনে যদি না থেকে থাকে দলিল কি চাইতে পারবে না, আমি একটা চুক্তিপত্র যদি চাই এবং চুক্তিপত্র যদি না থাকে তাহলে বলবে যে চুক্তিপত্র নাই। কোনো তথ্যের যৌক্তিকতা বা অযৌক্তিকতা তথ্যের প্রকৃতি আসার পরে যাচাই করে দেখা হবে।’
সিনিয়র সচিব আরও জানান, দলগুলোর নিবন্ধনের এই প্রক্রিয়া আগামী পরশুদিন (বৃহস্পতিবার) পর্যন্ত চলমান রয়েছে। এরপরে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
দলগুলোর অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে কর্মকর্তাদের কোনো সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে কি না— এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘কোনটা যৌক্তিক বা অযৌক্তিক, তা তথ্য যাচাই-বাছাইয়ের পরই নির্ধারণ করা হবে।’
তবে, দলগুলোর পক্ষ থেকে কমিশনারদের সঙ্গে সাক্ষাৎ না পাওয়ার অভিযোগের বিষয়ে মন্তব্য করতে রাজি হননি সচিব।
আরও পড়ুন
‘পক্ষপাতিত্ব’র অভিযোগ প্রসঙ্গে যা বলছেন বিশেষজ্ঞরা
এনসিপি’র প্রতি বিশেষ মনোযোগ, কিন্তু অন্য দলগুলো উপেক্ষিত— এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সাব্বির আহমেদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, “নতুন দলগুলোর প্রতি নির্বাচন কমিশনের আচরণে চরম পক্ষপাতিত্ব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। অভিযোগ উঠেছে, সরকার-সমর্থিত এনসিপি’কে বিশেষ সুবিধা দেওয়া হচ্ছে, যা কমিশনের নিরপেক্ষতাকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে।”

সাক্ষাৎকার নিয়ে বৈষম্য প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “নতুন দলগুলোর প্রতিনিধিরা সাক্ষাতের জন্য আবেদন করলেও কমিশনের কোনো কর্মকর্তার সঙ্গে দেখা করতে পারছেন না। অথচ, এনসিপি’র প্রতিনিধিরা আধা ঘণ্টার নোটিশেও কমিশনারদের সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা মিটিং করার সুযোগ পাচ্ছেন বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে নির্বাচন কমিশনের সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সমান আচরণ করার বাধ্যবাধকতা আছে। এই ধরনের পক্ষপাতমূলক আচরণ কমিশনের বিশ্বাসযোগ্যতাকে গুরুতরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে বলে মনে করি।”
এসআর/এমএআর/
