ইরানে ইসলামী ঐতিহ্যের যত শহর

ইতিহাস, ঐহিত্য, সভ্যতার প্রাণ কেন্দ্র ইরান। ইরানে গড়ে উঠেছে অসংখ্য মসজিদ, মাদরাসা। জন্ম নিয়েছেন অনেক মুসলিম মনীষী। তাদের জ্ঞানে আলোকিত হয়েছে বিশ্ব। যদিও বর্তমান ও প্রাচীন ইরানের মধ্যে অনেক পার্থক্য। বদলে গেছে প্রাচীন ইরানের ভৌগলিক অবস্থান। জন্ম নিয়েছে অনেক দেশ।
ইরানে মুসলিম সভ্যতার বিখ্যাত চার নিয়ে আজকের আয়োজন—
ইসফাহান

ইরানের রাজধানী তেহরানের ৩৪০ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত ইসফাহান। ভৌগলিকভাবে ইসফাহান জাগ্রোস পর্বতমালার পাদদেশে জায়েন্দে নদীর তীরে অবস্থিত। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এটি ১৫৯০ মিটার উপরে অবস্থিত। এটি ইরানের তৃতীয় বৃহত্তম নগরী। একসময় ইসফাহান বিশ্বের বড় শহরগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল। ১০৫০ থেকে ১৭২২ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত ছিল এর সমৃদ্ধিকাল।
অনন্য ইসলামী স্থাপত্য, ছাদ ঢাকা সেতু, মসজিদ ও মিনারের অসাধারণ সৌন্দর্য আজও ইসফাহানকে আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করে রেখেছে। ইসফাহানের সৌন্দর্য কিংবদন্তিতুল্য। ইরানে প্রবাদ প্রচলিত আছে ইসফাহান পৃথিবীর অর্ধেক।
প্রাচীন ইসফাহান এলামীয় সাম্রাজ্যের অংশ ছিল। মেদিয়ান গোত্রের অধীনে শহরটির নাম ছিল আসপানদানা। ম্যাসেডোনীয় দখল থেকে আর্সাসিডরা ইরানকে মুক্ত করার পর এটি পার্থীয় সাম্রাজ্যভুক্ত হয়।
আরও পড়ুন
সাসানিদ যুগে ইসফাহান শাসন করতেন "ইসফুরান" বা সাতটি অভিজাত পরিবারের সদস্যরা। এ সময় ইসফাহান সামরিক দিক দিয়ে বেশ শক্তিশালী হয়ে উঠে। আরবদের কাছে ইরানীদের সর্বশেষ পরাজয়ের পর ইসফাহান আরবদের পদানত হয়।
সেলজুক বংশের মালিক শাহের শাসনামলে ইসফাহান পুনরায় রাজধানীর মর্যাদা পায়। এ সময়টা ছিল ইসফাহানের স্বর্ণযুগ। চিকিৎসক ও দার্শনিক ইবনে সিনা ১১শ শতকে ইসফাহানে শিক্ষকতা করেন।
বর্তমানে ইসফাহান জায়নামাজ, শতরঞ্জি ও গালিচা, বস্ত্র, ইস্পাত এবং বিবিধ হস্তশিল্পের জন্য বিখ্যাত। এখানে পারমাণবিক জ্বালানি উৎপাদনের চুল্লী রয়েছে। ইসফাহানের অনুকূল অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে গড়ে উঠেছে ২০০০টির বেশি শিল্প প্রতিষ্ঠান।
ইরানের বড় খনিজ তেল শোধনাগার এবং গুরুত্বপূর্ণ বিমান ঘাঁটি এখানে অবস্থিত। ইরানের সবচয়ে উন্নত উড়োজাহাজ তৈরির কারখানাটিও এখানে অবস্থিত। এখানে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর রয়েছে।
তাবরিজ

ইরানের উত্তর-পশ্চিম কোণে অবস্থিত তাবরিজ। এটি প্রশাসনিকভাবে দেশটির পূর্ব আজারবাইজান প্রদেশের রাজধানী। ভৌগোলিকভাবে শহরটি উর্মিয়া হ্রদের ৬০ কিলোমিটার পূর্বে, সমুদ্র সমতল থেকে ১৩৫০ থেকে ১৬০০ মিটার উচ্চতায়, তিন দিকে পর্বতবেষ্টিত একটি অঞ্চলে, কুরি নদীর উপত্যকাতে অবস্থিত। শহরের পশ্চিমভাগটি একটি সমভূমিতে উন্মুক্ত, যেটি ধীরে ধীরে ঢালু হয়ে উর্মিয়া হ্রদের তীর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে।
নগরীটি একটি ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চলে অবস্থিত যেটিতে ঘনঘন ও তীব্র ভূমিকম্পের ঝুঁকি রয়েছে। ইতিহাসে বেশ কয়েকবার ভূমিকম্পের কারণে তাবরিজ শহরটির ব্যাপক ক্ষতি হয়। ৭৯১, ৮৫৮, ১০৪১, ১৭২১, ১৭৮০ ও ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দের ভূমিকম্পগুলি উল্লেখ্য। প্রত্যেকবারই ধ্বংসপ্রাপ্ত নগরীকে পুনর্নির্মাণ করা হয়।
১৩শ শতকের শেষে এসে তাবরিজ মঙ্গোল রাজবংশ ইল-খান এর শাসক মাহমুদ গাজান ও তার উত্তরসূরীর রাজধানীতে পরিণত হয়। ১৪শ শতকের শেষে ১৩৯২ সালে তুর্কি দিগ্বিজয়ী তৈমুর লং শহরটি দখল করেন। এর কয়েক দশক পরে কারা কৈউনলু নামের তুর্কমেন জাতির লোকেরা তাবরিজকে তাদের রাজধানী বানায়। তুর্কমেনদের অধীনে নীল মসজিদটি নির্মাণ করা হয়।
তাবরিজ উত্তর-পশ্চিম ইরানের বৃহত্তম শিল্পোৎপাদন, বাণিজ্য ও পরিবহন কেন্দ্র। এখানে মূলত গালিচা, বস্ত্র, প্রক্রিয়াজাত খাদ্য, পাদুকা, সিমেন্ট, কৃষিযন্ত্র, মোটরযান, খনিজ তেল পরিশোধন, খনিজ তেলজাত রাসায়নিক দ্রব্য, গৃহস্থালি বৈদ্যুতিক উপকরণ ও সাবান উৎপাদন করা হয়। শহরটি এর হস্তশিল্পগুলির জন্য, বিশেষ করে হাতে বোনা মাদুর ও গহনার জন্য বিখ্যাত। তাবরিজের মিষ্টান্ন, চকোলেট, শুকানো বাদাম ও ঐতিহ্যবাহী তাবরিজি রান্না সারা ইরানে উৎকৃষ্ট মানের খাদ্য হিসেবে বিবেচিত।
তাবরিজে বহুসংখ্যক ঐতিহাসিক ভবন ও স্থাপনা বিদ্যমান, যেগুলো ইরানের প্রাচীন ইতিহাস জুড়ে দেশটির স্থাপত্যের বিবর্তনের সাক্ষী। এতে রয়েছে ১৫শ শতকে (১৪৬৫-১৪৬৬ খ্রিস্টাব্দে) নির্মিত একটি সুদৃশ্য নীল রঙের টালির তৈরি মসজিদ, যার নাম মাসজেদ-এ কাবুদ। ১৪শ শতকে (১৩২২ খ্রিস্টাব্দে) একটি পুরাতন ধ্বংসপ্রাপ্ত মসজিদের স্থানে নির্মিত। নগরদুর্গটি তার সরল নকশা, আয়তন ও চমৎকার অবস্থায় সংরক্ষিত ইটের কাজের জন্য দর্শনীয়।
আরও আছে ইরানের মঙ্গোল রাজবংশীয় শাসক মাহমুদ গাজানের ১২টি পার্শ্ববিশিষ্ট সমাধি। নতুন ভবনগুলির মধ্যে রেলস্টেশন ও ১৯৪৯ সালে প্রতিষ্ঠিত তাবরিজ বিশ্ববিদ্যালয়টি উল্লেখ্য।
২০১৫ সালে বিশ্ব কারুকলা পরিষদ তাবরিজকে বিশ্ব গালিচা বয়ন নগরী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। ২০১৮ সালে ইসলামি সহযোগিতা সংস্থা-ওআইসি এটিকে একটি দৃষ্টান্তমূলক পর্যটক নগরী মর্যাদায় ভূষিত করে।
শিরাজ

শিরাজ ইরানের ষষ্ঠ জনবহুল শহর এবং ফর্স প্রদেশের রাজধানী। এটি ইরানের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত। এর মোট আয়তন ২৪০ বর্গকিমি। ২০১১ সালের জনসংখ্যা জরিপে, এই শহরের জনসংখ্যা ছিল ১৪,৬০,৬৬৫জন এবং নির্মাণাধীন অঞ্চল "শহর-এ জাহিদ-এ সদ্র" (সদ্র নতুন শহর) আবাসস্থল ১৫,০০,৬৪৪ জন জনসংখ্যা।
শিরাজ, ইরানের একটি ঐতিহাসিক শহর, যা ইরানের এথেন্স নামেও পরিচিত। এখানে অনেক ঐতিহাসিক স্থান রয়েছে, যেমন- করিম খানের নগরদুর্গ, ভাকিল মসজিদ, হাফিজের সমাধি, নাসির ওল মোলক মসজিদ (গোলাপি মসজিদ), ইরাম গার্ডেন, শাহ চেরাঘের মাজার এবং সাদি শিরাজির সমাধি।
মাশহাদ

উত্তরপূর্ব ইরানের একটি বড় শহর মাশহাদ। বর্তমানে প্রায় ২০০ বর্গকিলোমিটার অঞ্চলের উপর বিস্তৃত এই শহর রাজাভি খোরসন প্রদেশের রাজধানী ও ইরানের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর। রাজধানী তেহরান থেকে ৮৫০ কিলোমিটার পূর্ব দিকে কাশাফ নদীর তীরে শহরটি অবস্থিত। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এর উচ্চতা মোটামুটি ৯৮৫ মিটার।
বিখ্যাত খলিফা হারুনুর রশিদের কবরস্থান এখানে অবস্থিত। মাশহাদ বিখ্যাত পার্শি কবি ও শাহনামা কাব্যগ্রন্থের লেখক ফেরদৌসীর শহর হিসেবেও পরিচিত। রেলপথ, সড়কপথ ও বিমানপথে এ’ শহর রাজধানী তেহরানের সাথে খুব ভালোভাবে যুক্ত। অর্থনৈতিকভাবেও এই শহর ইরানের অন্যতম বিকাশশীল অঞ্চল। বিশেষ করে উল ও কার্পেট শিল্পের জন্য এ শহরের খ্যাতি রয়েছে। শহরটিতে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ও আছে।