দীর্ঘদিন পর প্রাণ ফিরেছে গাজার ঐতিহাসিক ওমরি মসজিদে

ইসরায়েলি হামলায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির পর প্রায় দুই বছরের বেশি সময় নীরব থাকার পর আবারো আজান ও জুমার নামাজে মুখর হয়ে উঠেছে গাজার প্রাচীনতম ওমরি মসজিদ। আবেগ, অশ্রু ও দোয়ার আবহে পুনরায় খুলে দেওয়া হয়েছে গাজা নগরের ধর্মীয় ও ঐতিহাসিক এই গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা।
গাজার পুরোনো নগরকেন্দ্রে অবস্থিত এই মসজিদটি শুধু শহরের পুরোনো মসজিদই নয়, বরং বিশ্বের প্রাচীনতম মসজিদগুলোর একটি। ইসরায়েলি হামলায় মিনার, দেয়াল ও ছাদ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় দীর্ঘ সময় বন্ধ ছিল মসজিদটি। সংস্কার শেষে শুক্রবার প্রথম জুমার নামাজ আদায়ের মধ্য দিয়ে মসজিদটি আনুষ্ঠানিকভাবে খুলে দেওয়া হয়।
মসজিদকে কেন্দ্র করে যে পুরোনো গাজা শহর যেন নতুন করে প্রাণ ফিরে পেয়েছে এদিন। প্রথম জুমার নামাজে বিপুলসংখ্যক মুসল্লির সমাগম হয়। আল জাজিরা মুবাশিরের ক্যামেরায় ধরা পড়ে সেই আবেগঘন মুহূর্ত, যেখানে দোয়ার জন্য ওঠে অসংখ্য হাত, মুখে মুখে ধ্বনিত হয় জিকির ধ্বনি। ধ্বংস আর ক্ষতের মধ্যেও নিজেদের পবিত্র স্থান আঁকড়ে বেঁচে থাকার দৃঢ়তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে গাজাবাসীর মাঝে।
মুসল্লিদের একজন আবেগভরা কণ্ঠে আল্লাহর সান্নিধ্য ও অন্তরের প্রশান্তির কথা স্মরণ করিয়ে দেন। চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে এক ধরনের প্রশান্তি। দেখে মনে হয় মসজিদটি তার হারানো স্মৃতি ও প্রাণ ফিরে পাচ্ছে একসঙ্গে।
গাজার ইতিহাসের নীরব সাক্ষী
ওমরি মসজিদ শুধু নামাজের স্থান নয়, ইতিহাসের জীবন্ত দলিল। মুসল্লিদের ভাষ্যে, পুরোনো শহরের কেন্দ্রবিন্দু এই মসজিদ চারপাশের ইসলামী স্থাপত্য ও নিদর্শনের সঙ্গে মিলেমিশে এক অনন্য ঐতিহ্য গড়ে তুলেছে। সারা বছর ধর্মীয় আয়োজনের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে পরিচিত এই মসজিদে রমজানের রাতগুলো বিশেষ তাৎপর্য বহন করে, যা ফিলিস্তিন ও গাজার গভীর ইতিহাসের কথা মনে করিয়ে দেয়।
এক মুসল্লি জানান, নতুন বছরের শুরুতে মসজিদ পুনরায় চালু হওয়া বিশেষ বার্তা বহন করে। তার মতে, ওমরি মসজিদ গাজার সবচেয়ে বড় ও প্রাচীন মসজিদগুলোর একটি এবং এই ভূমিতে মুসলমানদের শিকড়ের গভীরতার প্রমাণ। দখলদারিত্ব ও গাজা মুছে ফেলার সব প্রচেষ্টার আগে থেকেই মসজিদটি বিদ্যমান ছিল।
আরেক মুসল্লি বলেন, মসজিদের পুনর্নির্মাণ এক বরকতময় উদ্যোগ। ওমরি মসজিদ গাজা ও ফিলিস্তিনের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এর পুনর্জীবন শুধু ইবাদতের জায়গা হিসেবে নয়, বরং পরিচয় ও স্মৃতির প্রতীক হিসেবেও গাজাবাসীর জন্য গভীর অর্থ বহন করে।
দীর্ঘ পথচলার ইতিহাস
গাজা থেকে আল জাজিরাকে দেওয়া বক্তব্যে ওমরি মসজিদের সংস্কার তদারকির দায়িত্বে থাকা আওকাফ বিভাগের পর্যবেক্ষক শায়খ তারেক হানিয়া জানান, মসজিদটি ইতিহাসের ছয়টি গুরুত্বপূর্ণ পর্যায় অতিক্রম করেছে। এক সময় মসজিদটি ছিল পৌত্তলিক উপাসনালয়, পরে বিভিন্ন যুগে গির্জা হিসেবে ব্যবহৃত হয়। খলিফা হজরত ওমর ইবনুল খাত্তাবের শাসনামলে এটি মসজিদে রূপান্তরিত হয়।
তিনি আরও বলেন, ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে ক্রুসেডার, বাইজেন্টাইনসহ নানা শক্তির হাতে মসজিদটি একাধিকবার ধ্বংস হয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতেও এটি হামলা ও ক্ষতির শিকার হয়েছে। তবে সব প্রতিকূলতার মধ্যেও মসজিদটি টিকে আছে মুসল্লি ও স্থানীয়দের দৃঢ়তায়, যারা যুদ্ধ ও কঠোর বাস্তবতার মাঝেও একে আঁকড়ে ধরে রেখেছেন।
তারেক হানিয়ার মতে, ওমরি মসজিদের ইতিহাস এই ভূমির জন্য চলমান সংঘাতের প্রকৃত রূপ তুলে ধরে। আজ এর পুনরায় উদ্বোধন শুধু স্থাপত্যগত সাফল্য নয়, বরং স্পষ্ট বার্তা যে গাজায় আত্মিক জীবন কোনোভাবেই নিঃশেষ করা যাবে না। অবরোধ ও আগ্রাসন যতই কঠিন হোক, আল্লাহর ঘর মানুষের উপস্থিতিতেই সমুজ্জ্বল হয়ে থাকবে।
সূত্র: আল জাজিরা
এনটি