ক্রীড়াসঙ্গীত আছে, ক্রীড়াসঙ্গীত নেই!
![ক্রীড়াসঙ্গীত আছে, ক্রীড়াসঙ্গীত নেই!](https://cdn.dhakapost.com/media/imgAll/BG/2023August/new-project-90-20230814145448.jpg)
বিশ্বের অনেক দেশেই নেই ক্রীড়াসঙ্গীত। ক্রীড়াপ্রেমী দেশ বাংলাদেশে অবশ্য নিজস্ব ক্রীড়াসঙ্গীত রয়েছে। যা সাধারণ মানুষ তো বটেই, ক্রীড়াঙ্গনের অনেকেরই অজানা। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের নতুন ভবনের নবম তলা আর পুরাতন ভবনের নিচ তলার বারান্দায় দুটি সবুজ বোর্ডে টাঙানো আছে ক্রীড়াসঙ্গীত লেখা একটি বোর্ড। কালের বিবর্তনে এখন এটি স্রেফ সাইনবোর্ড সর্বস্ব সঙ্গীত হয়ে পড়েছে।
১৯৭৭ সালে বাংলাদেশ জাতীয় ক্রীড়া নিয়ন্ত্রণ বোর্ড (এখন জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ) জাতীয় প্রেরণা ও খেলোয়াড়ি মনোভাব প্রকাশের জন্য ক্রীড়াসঙ্গীতের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। ক্রীড়া নিয়ন্ত্রণ বোর্ডের তৎকালীন সচিব এমএ রশিদ ক্রীড়াসঙ্গীতের জন্য ’৭৭ সালের আগস্ট মাসে দুটি ইংরেজি (বাংলাদেশ অবজারভার, বাংলাদেশ টাইমস) ও দুটি বাংলা (দৈনিক বাংলা, ইত্তেফাক) পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেন। ৭ সেপ্টেম্বর নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ১৮ ব্যক্তি ক্রীড়াসঙ্গীতের জন্য গান লিখে পাঠান।
ক্রীড়াসঙ্গীত নির্বাচনের জন্য পাঁচ সদস্যের বিচারক কমিটি করেছিলেন জাতীয় ক্রীড়া নিয়ন্ত্রণ বোর্ডের তৎকালীন চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। পাঁচ সদস্যের কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন বাংলাদেশ রেডিও’র প্রোগ্রাম প্ল্যানিংয়ের পরিচালক আলিমউদ্দিন চৌধুরি। বিচারক কমিটির অন্য চার সদস্য হলেন- চলচ্চিত্র পরিচালক খান আতাউর রহমান, সঙ্গীত পরিচালক খন্দকার নুরুল আলম, মীর আলী মনসুর ও ক্রীড়াজগতের কার্যনির্বাহী সম্পাদক তওফিক আজিজ খান।
পাঁচজনের এ বিচারক প্যানেল ১৯৭৭ সালের ১৮ নভেম্বর সর্বসম্মতিক্রমে সেলিমা রহমানের ‘বাংলাদেশের দুরন্ত সন্তান আমরা দুর্বার দুর্জয়’ গানটি প্রথম এবং নারায়ণগঞ্জের লোকমান হোসেন ফকির রচিত ‘আমরা নবীন কিশোর প্রবীণ’ গানটি দ্বিতীয় হিসেবে চূড়ান্ত করে। সেলিমা রহমানের গান প্রথম হওয়ায় তিনি ৫০০ টাকা পুরস্কার পেয়েছিলেন।
বিচারকদের রায়ে প্রথম হওয়া সেলিমা রহমানের গানটিকে জাতীয় ক্রীড়া নিয়ন্ত্রণ বোর্ড ক্রীড়াসঙ্গীত হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। ওই গানে সুর দেন খন্দকার নুরুল আলম। যদিও প্রাথমিক প্রস্তাবনায় খান আতাউর রহমানের নাম ছিল। জাতীয় ক্রীড়া নিয়ন্ত্রণ বোর্ড থেকে বাংলাদেশ বেতার ও বাংলাদেশ টেলিভিশনে এ গানের রেকর্ড ও শুটিংয়ের জন্য চিঠি প্রদান করা হয়।
১৯৭৮ সালের ১৯-২২ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ সফর করেন বিংশ শতাব্দীর সেরা ক্রীড়াবিদ মোহাম্মদ আলী। তার আগমনকালে বাংলাদেশে ক্রীড়াসঙ্গীত প্রথমবার বাজানো হয়। ওই ক্রীড়াসঙ্গীতে কণ্ঠ দিয়েছিলেন প্রখ্যাত শিল্পী খুরশিদ আলম, আবিদা সুলতানাসহ অনেকে। কণ্ঠশিল্পীদের কেউ ৩০০, কেউ ৪০০ টাকা সম্মানী পেয়েছিলেন। যন্ত্রশিল্পীরা পেয়েছিলেন ২০০-২৫০ টাকা করে। গানটির সুরকার খন্দকার নুরুল আলমকে ১০০০ টাকা সম্মানী প্রদান করে বাংলাদেশ ক্রীড়া নিয়ন্ত্রণ বোর্ড।
![](https://cdn.dhakapost.com/media/imgAll/BG/2023August/-20230814144441.jpg)
বাংলাদেশ অ্যাথলেটিক্স ফেডারেশনের বর্তমান নির্বাহী সদস্য ফারুকুল ইসলাম ১৯৭৮ সালে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের সহকারী ক্রীড়া পরিচালক ছিলেন। ক্রীড়াসঙ্গীতের অতীত ও বর্তমান নিয়ে বর্ষীয়ান এ ক্রীড়া সংগঠক বলেন, ‘বাংলাদেশে প্রথম মাল্টিস্পোর্টস গেমস (এখন বাংলাদেশ গেমস, পূর্বেকার বাংলাদেশ অলিম্পিকস) হয় ১৯৭৮ সালে। সেই গেমসে এ সঙ্গীত বাজানো হয়। ১৯৮৫ সালে ঢাকা সাফ গেমসেও বেজেছে ক্রীড়াসঙ্গীত। আশির দশকের পুরোটা সময় নানা ক্ষেত্রে ক্রীড়াঙ্গনে এটি বেজেছে।’
‘নব্বইয়ের দশক থেকে এর প্রচলন কমতে থাকে ধীরে ধীরে। ফলশ্রুতিতে গত দুই দশকে এ সঙ্গীত আর বাজতে শোনা যায় না’- বলেন ফারুকুল। আশির দশকের ক্রীড়াবিদ শফিকুল ইসলাম মানিক, গাজী আশরাফ হোসেন লিপুসহ অনেকে এ গান শুনেছেন বলে জানিয়েছেন।
আসাদুজ্জামান কোহিনূর তিন দশক ধরে বাংলাদেশ হ্যান্ডবল ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক পদে আছেন। ক্রীড়াসঙ্গীতের ব্যবহার সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘হ্যান্ডবলে কখনো এ গান বাজেনি। বেশ কয়েক বছর এ গান শুনি না, আগে স্টেডিয়াম এলাকায় প্রায়ই বাজত।’
নড়াইল জেলা ক্রীড়া সংস্থার সম্পাদক ও জেলা-বিভাগীয় ক্রীড়া সংগঠক পরিষদের মহাসচিব আশিকুর রহমান মিকু। তৃণমূলের নেতৃত্ব দেয়া এ সংগঠক ক্রীড়াসঙ্গীতের ব্যবহার নেই বলে জানান। তিনি বলেন, ‘আমার নড়াইল জেলায় এ গান কখনো বাজানো হয়নি। অনেক জেলায় খেলা উদ্বোধন, সমাপনীসহ নানা অনুষ্ঠানে গিয়েছি। জেলা পর্যায়ে এ গান শুনেছি বলে মনে পড়ে না।’
এসএ গেমসে স্বর্ণজয়ী সাতারু মাহফুজা খাতুন শিলা ক্রীড়াঙ্গনে প্রায় দুই দশক। ক্রীড়া সঙ্গীতের ব্যবহার না হওয়ায় খানিকটা হতাশই তিনি,' এনএসসিতে আসলে ক্রীড়া সঙ্গীত চোখে পড়ে। মাঝে মধ্যেই ভাবি এটা কেমন সঙ্গীত কখনো শুনলাম না। এসএ গেমস বা ফুটবল,ক্রিকেট দল যখন দেশের বাইরে খেলতে যায় ফটোসেশনের পাশাপাশি এই সঙ্গীত উদ্দীপনামূলক হিসেবে বাজতেই পারে।'
শিলা ক্রীড়াসঙ্গীত না শুনলেও তার চোখে পড়েছে তিনি অন্তত জানেন ক্রীড়াসঙ্গীত রয়েছে। ফুটবলারদের জাতীয় ক্রীড়া পরিষদে যাতায়াত নেই । তাই অনেকেই জানেন না ক্রীড়াসঙ্গীত সম্পর্কে, 'আমাদের কোনো ক্রীড়াসঙ্গীত আছে এটা জানতাম না। জানব কিভাবে কখনো গানও শুনিনি এমনকি কোনো আলোচনাতেও না ' বলেন জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক জাহিদ হাসান এমিলি। ফুটবলার এমিলির মতো বর্তমান প্রজন্মের অনেক ক্রীড়াবিদের কাছেই ক্রীড়াসঙ্গীত একেবারে অজানা বিষয়।
![dhakapost](https://cdn.dhakapost.com/media/imgAll/BG/2024May/krira-song-document-20240514212826.jpg)
দেশের ক্রীড়াঙ্গনের নিয়ন্ত্রক সংস্থা জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ স্বীকৃত ক্রীড়াসঙ্গীত ফেডারেশন ও জেলা ক্রীড়া সংস্থা ব্যবহার করছে না। এজন্য জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের তদারকির অভাব ও ক্রীড়াসঙ্গীতের আইনগত দুর্বলতা দেখছেন বিশিষ্ট ক্রীড়া সংগঠক ফারুকুল ইসলাম। বলেন, ‘ক্রীড়াসঙ্গীতের ব্যবহার নিয়ে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের সুনির্দিষ্ট কোনো সার্কুলার নেই। ফলে এর ব্যবহার অনেকটা ঐচ্ছিক। কেউ বাজিয়েছে, আবার কেউ বাজায়নি।’
জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের বর্তমান সচিব পরিমল সিংহ দেড় বছরে ক্রীড়াঙ্গনের বেশ কয়েকটি অচলায়তন ভেঙেছেন। ক্রীড়াসঙ্গীতের বিষয়টিও নজরে পড়েছে তার। বলেন, ‘ক্রীড়াসঙ্গীত দেশের ক্রীড়াসংস্কৃতিও বহন করে। আমাদের জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের একটি ক্রীড়াসঙ্গীত রয়েছে। যা অনেক দিন ব্যবহৃত হচ্ছে না। সঙ্গীতটি নিয়ে আমরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষসহ ক্রীড়াসংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনা-পর্যালোচনা করে একটি পদক্ষেপ গ্রহণ করব।’ উল্লেখ্য, জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ-ফেডারেশন কারও কাছেই ক্রীড়াসঙ্গীতের রেকর্ড সংরক্ষিত নেই। বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বেতারই কেবল ভরসা।
জীবন্ত সঙ্গীত থেকে সাইনবোর্ড সর্বস্ব হওয়ার পেছনে অনেক বিষয়ের পাশাপাশি রাজনৈতিক পটপরিবর্তনও একটি কারণ বলে মনে করেন ক্রীড়াসংশ্লিষ্ট অনেকে। ১৯৭৮ সালে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের চেয়ারম্যান থাকাবস্থায় ক্রীড়াসঙ্গীতের প্রচলন হয়। তার মেয়াদকালেই (এনএসসি চেয়ারম্যান এবং দেশের রাষ্ট্রপতি থাকাবস্থায়) এ সঙ্গীতের ব্যবহার ছিল সর্বাধিক। নব্বই দশকের পর থেকে ক্রমেই কমতে থাকে এর ব্যবহার। এখন আর ব্যবহারই হয় না।
ক্রীড়াঙ্গনে অনেক গানের রচয়িতা সিনিয়র সাংবাদিক শহিদুল আজমের পর্যবেক্ষণ, ‘গান একটি সময়কে ধারণ করে লেখা হয়। অনেক ক্ষেত্রে সেই সময়ে নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে সংমিশ্রণ করে গানকেও রাজনীতিকরণ বা মেরুকরণের আওতায় ফেলা হয়। ফলে অনেক গান হারিয়ে যায়। দুই দশক আগে লেখা ক্রিকেট নিয়ে অনেক গান যেমন ক্রিকেট বোর্ড এখন বাজায় না।’
![](https://cdn.dhakapost.com/media/imgAll/BG/2023August/new-project-88-20230814143509.jpg)
ক্রীড়াসঙ্গীত থেকেও প্রয়োগ নেই, সেখানে ফেডারেশন বা ক্লাবের আলাদা সঙ্গীত না থাকাটাই স্বাভাবিক। সাংবাদিক শহিদুল আজম ব্যক্তিগত উদ্যোগে মোহামেডান, আরচ্যারি, ব্যাডমিন্টন, হকি নিয়ে গান লিখেছেন। গানগুলো সংশ্লিষ্ট ফেডারেশন বা ক্লাব সেভাবে সংরক্ষণ করেনি।
সাবেক ক্রীড়াবিদ ও বাংলাদেশের ক্রীড়া সাংবাদিকতার অন্যতম পথিকৃৎ মুহাম্মদ কামরুজ্জামান এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘এনএসসির সঙ্গীতটি ভালোই ছিল। সেটি তারা পুনরায় ব্যবহার করতে পারে অথবা চাইলে যুগোপযোগী করতে পারে। বাংলাদেশের একটি ক্রীড়াসঙ্গীত ব্যবহার করা উচিত। পাশাপাশি আবাহনী, মোহামেডানের মতো ক্লাবগুলোও নিজেরা সঙ্গীত রচনা করতে পারে। যা সমর্থকরা গাইবেন। এতে সুন্দর ক্রীড়াসংস্কৃতি তৈরি হবে।’
জাতীয় ক্রীড়া পরিষদে দুই মেয়াদে সচিবের দায়িত্ব পালন করা আখতার হোসেন খান ক্রীড়াসঙ্গীতের ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তা দেখছেন আরও তৃণমূল পর্যায় থেকে। বলেন, ‘ক্রীড়াসঙ্গীত স্কুল-কলেজের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায়ও বাজতে পারে। তাহলে শিক্ষার সঙ্গে ক্রীড়াসংস্কৃতি নিয়ে বেড়ে উঠবে শিশু-কিশোররা।'
এজেড/জেএ