‘আমরা প্রতিদিন পাই ৪০০ টাকা, এক জোড়া বুটের দামই ১৮ হাজার’

বাংলাদেশের হকির ইতিহাস ও সংস্কৃতি বহু পুরনো। এশিয়ান পর্যায়ে অনেক জয় থাকলেও বিশ্বকাপের মঞ্চে কখনো পা রাখেনি বাংলাদেশ। আজ (মঙ্গলবার) ওমানের মাসকটে যুব এশিয়া কাপ হকিতে থাইল্যান্ডকে হারিয়ে ষষ্ঠ স্থান নিশ্চিত হওয়ায় প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ (অনূর্ধ্ব-২১) হকিতে উঠেছে বাংলাদেশ।
ইতিহাস রচনার পর অধিনায়ক মেহরাব হাসান সামিন ওমান থেকে মুঠোফোনে সাক্ষাৎকারে ঢাকা পোস্টের সিনিয়র স্পোর্টস রিপোর্টার আরাফাত জোবায়েরকে শত সীমাবদ্ধতার মধ্যেও দলকে বিশ্বকাপে নেওয়ার গল্প শুনিয়েছেন।
ঢাকা পোস্ট : অভিনন্দন। প্রথমবার বাংলাদেশ হকিতে বিশ্বকাপ খেলবে। আপনার নেতৃত্বে সেই যোগ্যতা অর্জন করল। অনুভূতি কেমন?
মেহরাব হাসান সামিন : এটা জীবনের সেরা অনুভূতি। বাংলাদেশ একটি খেলায় বিশ্বকাপে খেলবে। আমার অধিনায়কত্বে বাংলাদেশ সেই খেলা নিশ্চিত করল। এটা ক্রীড়াবিদ হিসেবে অনেক বড় সম্মানের। এর কৃতিত্ব আমার টিমমেটদের দিতে চাই। তাদের অনেক ত্যাগের কারণে এটা সম্ভব হয়েছে।
ঢাকা পোস্ট : ফুটবল, ক্রিকেটের বাইরে দেশের অন্য সকল খেলার খেলোয়াড়রা নানা প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে খেলেন। আপনাদের এই দলের ত্যাগের গল্পটা কেমন?
মেহরাব হাসান সামিন : ক্যাম্প চলাকালে আমরা হাত খরচ পাই মাত্র ৪০০ টাকা। মাসে হাজার ১২ টাকা হয়। এক জোড়া ভালো বুটের দামই ১৮ হাজার টাকা। আমার সহ-অধিনায়ক সারা মাসের টাকা জমিয়ে বুট কিনেছিল। পরে চিন্তা করে দেখল এত টাকার বুট পরবে? শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়ে বিক্রিই করে দেয়। এ রকম পরিস্থিতি আমাদের ছিল।
আমাদের বয়স এখন ২০ প্লাস। আমাদের অনেককেই পরিবারকেও সাহায্য করতে হয়। সীমিত আয়ে সেভাবে সম্ভবও হয় না। এরপরও আমাদের সকল খেলোয়াড়দের মনোযোগ খেলার দিকেই ছিল। দেশকে বিশ্বকাপের মঞ্চে নেব, প্রতিজ্ঞা ছিল, শেষ পর্যন্ত পেরেছি।
ঢাকা পোস্ট : বুট, স্টিক বা প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম তো ফেডারেশনেরই দেওয়ার কথা, সেখানে আপনাদের এগুলো কিনে খেলতে হচ্ছে...
মেহরাব হাসান সামিন : হ্যাঁ, আসলেই কষ্টের। আমরা দেশের জন্য খেলি কিন্তু তেমন অর্থ-কড়ি পাই না। হকিতে একটা ভালো মানের স্টিকের দাম দশ হাজারের বেশি, বুটের দামও এমনই। সবচেয়ে বেশি ব্যয়বহুল গোলকিপারের সরঞ্জাম। সেটাও গোলকিপারকে কিনতে হয়। আমরা অনুশীলনের সময় খুব সজাগ থাকি স্টিক যেন না ভাঙে বা সরঞ্জাম যেন নষ্ট না হয়। কারণ কিছু নষ্ট হলে আমাদেরকেই আবার কিনতে হয়। ফেডারেশন খুব কম ক্ষেত্রেই বুট বা স্টিক প্রদান করে। আমি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে খেলছি পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে অথচ মাত্র একবারই ফেডারেশন থেকে বুট পেয়েছি।
ঢাকা পোস্ট : এত কম সুযোগ-সুবিধা নিয়ে এগিয়ে থাকা দলগুলোর বিপক্ষে লড়াই করেন কীভাবে?
মেহরাব হাসান সামিন : মাঠে যখন নামি তখন আসলে সুযোগ-সুবিধা, নিজেদের ঝুঁকি এসব নিয়ে ভাবি না। ভালো খেলতে হবে, দেশকে জেতাতে হবে এটাই থাকে একমাত্র লক্ষ্য। এজন্য আমরা সবাই এক হয়ে নিজেদের সেরাটা দেওয়ার চেষ্টা করি। বলতে পারেন, আর্থিক বা নানা সুযোগ-সুবিধা কম হলেও মানসিকতাই আমরা অন্যদের চেয়ে এগিয়ে থাকার চেষ্টা করি। কোচ-কর্মকর্তারাও এটি অনুধাবন করে আমাদের সবসময় উদ্দীপ্ত রাখেন।
ঢাকা পোস্ট : হকি অত্যন্ত চোট প্রবণ খেলা। ফেডারশন প্রয়োজনীয় সরঞ্জামই দিতে পারে না আপনাদের সেখানে চোটে পড়লে কীভাবে নিজেরা ফিরে আসেন?
মেহরাব হাসান সামিন : এটা খুবই দুঃখজনক বিষয়, দেশের হয়ে একজন হকি খেলোয়াড় লড়েন। খেলতে গিয়ে বা অনুশীলনে চোটে পড়লে অধিকাংশ ক্ষেত্রে নিজের খরচে চিকিৎসা নিতে হয়। ফেডারেশন ছোট-খাটো বিষয়ে সাহায্য করলেও অপারেশন বা দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়ায় নিজেকেই খরচ বহন করতে হয়। এক্ষেত্রে যারা সার্ভিসেস বাহিনীতে থাকেন তারা কিছুটা সহযোগিতা পান সেই সংস্থা থেকে। আর যারা কোনো সংস্থাই নেই তাদের পরিস্থিতি হয় ভয়াবহ। অনেক খেলোয়াড় তার সেরা ফর্ম হারিয়েছেন ইনজুরির জন্য, আবার অনেকে একেবারে হকি থেকেই ছিটকে গেছেন।
ঢাকা পোস্ট : আপনারা দেশের জন্য খেলেন। এত কম সুযোগ-সুবিধা এবং প্রতিবন্ধকতা, স্বীকৃতিও কম, কষ্ট লাগে না?
মেহরাব হাসান সামিন : আমাদের ফেডারেশনের আর্থিক সঙ্কট। কোনো স্পন্সর নেই, আবার সরকারও তেমন অর্থ দেয় না। আমাদের ক্যাম্পই চালায় অনেক কষ্ট করে ফলে তাদের কাছ থেকে আমরা আর্থিকভাবে খুব বেশি কিছুর প্রত্যাশা করি না। আমাদের প্রত্যয় ছিল একটা ভালো ফলাফল করার যাতে সবাই হকির দিকে আকৃষ্ট হয় এবং পৃষ্ঠপোষকতা আসে। আমরাও আর্থিক এবং সামাজিক আরও মর্যাদা পাই। বিশ্বকাপ নিশ্চিতের মাধ্যমে আশা করি সেটা সম্ভব হবে।
ঢাকা পোস্ট : জুনিয়র এশিয়া কাপের আগের পর্ব ছিল এএইচএফ কাপ। সিঙ্গাপুরে সেই টুর্নামেন্টে আপনারা আবাসন, খাবার অনেক সমস্যার মধ্যে ছিলেন...
মেহরাব হাসান সামিন : অনেক কষ্টের মধ্যেও ফেডারেশন আমাদের সিঙ্গাপুর পাঠিয়েছিল। আমরাও অনেক কষ্ট করেছি। এক রুমে ছয়-সাতজন ছিলাম। একটির ওপর আরেকটি বেড। খাওয়াতেও কষ্ট ছিল। অনেক দিন তিন বেলা খেতে পারিনি। দেশে অনুশীলনের সময় আমাদের পকেট মানি চারশ টাকা আর বিদেশে আসলে সেটা মাত্র এক হাজার টাকা দেওয়া হয়।
ঢাকা পোস্ট : এএইচএফ কাপের পর জুনিয়র এশিয়া কাপের আগে আপনাদের কোচ বদলেছে। এতে আপনাদের খেলায় কোনো প্রভাব পড়েছে কি?
মেহরাব হাসান সামিন : কোচ নিয়ে আমাদের কোনো সমস্যা নেই। যেই আসুক আমাদের খেলা আমাদেরই খেলতে হবে। কাকে কোচ করবে সেটা ফেডারেশনের বিষয়, আমাদের নয়। আমরা দুই কোচের অধীনেই নিজেদের সেরাটা দিয়েছি।
ঢাকা পোস্ট : সিঙ্গাপুরে যখন এএইচএফ কাপ খেলতে যান। তখন কি ভেবেছিলেন শেষ পর্যন্ত বিশ্বকাপ নিশ্চিত করতে পারবেন?
মেহরাব হাসান সামিন : এটা আসলে লম্বা জার্নি। যুব বিশ্বকাপ খেলতে দুটি টুর্নামেন্টের দুটি ধাপ পার হতে হয়েছে। আমাদের সবারই স্বপ্ন ছিল বিশ্বকাপে খেলার। তবে দুই টুর্নামেন্টের শুরুতে ঐ টুর্নামেন্ট নিয়েই প্রাথমিক পরিকল্পনা ছিল। অনেক কষ্টের মধ্যেও আমরা লক্ষ্য থেকে বিচলিত হইনি।

ঢাকা পোস্ট : ওমানে প্রথম ম্যাচে স্বাগতিকদের হারিয়ে শুরু করলেন। পরের ম্যাচে পাকিস্তানের বিপক্ষে ৬-০ গোলের হার। এরপর আবার ঘুরে দাঁড়ালেন কীভাবে?
মেহরাব হাসান সামিন : পাকিস্তান অনেক ভালো দল। সিনিয়র দলের কয়েকজন রয়েছে এই দলেও। আমরা বড় ব্যবধানে হারের পর স্বাভাবিকভাবেই মন খারাপ ছিল। আমাদের ফিরে আসার সামর্থ্য রয়েছে এটা সবার মনে ছিল। এজন্য পরের ম্যাচই মালয়েশিয়াকে রুখে দিয়েছি। মালয়েশিয়া অত্যন্ত ভালো দল। চীনের ম্যাচটি আমাদের জয় পাওয়া উচিত ছিল।
ঢাকা পোস্ট : বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো যুব হকির বিশ্বকাপ খেলছে, এটা ক্রীড়াঙ্গনের অত্যন্ত গর্বের ও আনন্দের। বাংলাদেশের যুব পর্যায়ে হকির মান উন্নয়ন হয়েছে নাকি আন্তর্জাতিক হকি ফেডারেশন এশিয়ার কোটা বৃদ্ধি পাওয়ায় বাংলাদেশ সুযোগ পেল?
মেহরাব হাসান সামিন : বাস্তবিক ও যৌক্তিক প্রশ্ন। আমার দৃষ্টিতে দুটিই। এশিয়ার কোটা বৃদ্ধি অবশ্যই আমাদের জন্য অত্যন্ত ইতিবাচক। পাশাপাশি আমাদের খেলোয়াড়দের মানও ভালো। ওমান হকিতে অনেক বিনিয়োগ করছে। স্বাগতিক দেশ, তাদের আমরা হারিয়েছি। চীন, মালয়েশিয়ার বিপক্ষে ড্র আমাদের খেলোয়াড়দের মান নির্দেশ করে।
ঢাকা পোস্ট : আব্দুস সাদেক, মামুনর রশীদ, মাহবুব হারুন, জামাল হায়দারের মতো তারকা ও কিংবদন্তীরা যুব বিশ্বকাপে খেলতে পারেনি। আপনারা সেদিক থেকে নিজেদের সৌভাগ্যবান বলবেন?
মেহরাব হাসান সামিন : তারা অবশ্যই কিংবদন্তী। আমাদের অনেকেরই তারা আইডল, আইকন এবং গুরুও। আমরাও নিজেদের সেরাটা দিয়ে দেশকে সর্বোচ্চ সম্মান দিতে চাই।
ঢাকা পোস্ট : সম্প্রতি নারী ফুটবল দল সাফ চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। সরকার, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান অনেক আর্থিক পুরস্কার প্রদান করেছে। আপনারা কী প্রত্যাশা করছেন?
মেহরাব হাসান সামিন : অবশ্যই আমরা সংবর্ধনা প্রত্যাশা করছি। যুব বিশ্বকাপে প্রথমবার খেলা নিশ্চিত করা ক্রীড়াঙ্গনের বিশেষ অর্জন। এর স্বীকৃতি পেলে আমরা আরও বেশি উদ্বুদ্ধ হব।
ঢাকা পোস্ট : আগামী বছর ডিসেম্বরে যুব হকির বিশ্বকাপ। এক বছর কীভাবে প্রস্তুতি নিতে চান।
মেহরাব হাসান সামিন : আমাদের ক্যাম্প যেন তাড়াতাড়ি শুরু হয়। এই এশিয়া কাপের আগে প্রস্তুতি ম্যাচ পাইনি। বিশ্বকাপ খেলবে ইউরোপের অনেক দেশই। তাদের সম্পর্কে ধারণা নেই। ইউটিউবে খেলা দেখা এক রকম আর নিজেরা খেলা আরেক রকম। আমরা চাই বিশ্বকাপের আগে বিদেশে গিয়ে প্রস্তুতি ও অনেক ম্যাচ খেলার সুযোগ। পাশাপাশি আমাদের সুযোগ-সুবিধাও বৃদ্ধির অনুরোধ থাকবে।
ঢাকা পোস্ট : ফেডারেশনে নতুন কমিটি এসেছে। নতুন কমিটিকে আপনারা সাফল্য উপহার দিলেন। তাদের কাছে প্রত্যাশা কী?
মেহরাব হাসান সামিন : আমাদের হকি লিগ অনিয়মিত। আমরা চাই লিগটি নিয়মিত হোক। সিনিয়রদের সঙ্গে খেললে আমরা আরো বেশি অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারব।
ঢাকা পোস্ট : খেলোয়াড় হিসেবে আপনার ক্যারিয়ার নিয়ে কী স্বপ্ন আছে?
মেহরাব হাসান সামিন : আমার স্বপ্ন বাংলাদেশ যেন অলিম্পিকেও খেলতে পারে। আমরা একবার যুব অলিম্পিকে ফাইভ এ সাইডে খেলেছি। স্বপ্ন দেখি মূল অলিম্পিকে খেলার।
ঢাকা পোস্ট : মূল অলিম্পিকের আগে সিনিয়র দলের হকি বিশ্বকাপের স্বপ্নটা আরও বাস্তবিক নয়?
মেহরাব হাসান সামিন : আমরা যেমন পেরেছি, আমাদের সিনিয়র দলেরও সামর্থ্য রয়েছে বিশ্বকাপে খেলার। কিন্তু তারা খেলার মধ্যেই থাকে না। এশিয়ান গেমসের পর খেলা নেই। খেলা না থাকলে আনফিট থাকবে, পারফরম্যান্স খারাপ হবে। আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে ফলাফল খারাপ হলে র্যাকিংও নিচে নামবে।
ঢাকা পোস্ট : ক্রিকেটে অধিনায়কের যেমন ভূমিকা, ফুটবল বা হকি মাঠে তেমন নয়। এরপরও আপনার দায়িত্ব এবং চাপ কেমন ছিল?
মেহরাব হাসান সামিন : হকিতে মাঠে কোচই সিদ্ধান্ত নেন। অধিনায়ক মূলত খেলোয়াড়-কোচ-অফিসিয়ালের সেতুবন্ধন। খেলোয়াড়রা অনেক চাহিদার কথা আমাকে জানালে আমি কোচ, ম্যানেজারকে জানাই। আবার অনেক সময় কোচও আমাকে বাড়তি কাজ দেন। আমাদেও কোচিং স্টাফ স্বল্প। তাই স্যার অনেক সময় আমাকে ডিফেন্সের বিষয়টি দেখতে বলেছে। যতটা পেরেছি সহযোগিতার চেষ্টা করেছি। ওমানে একটি ম্যাচে ম্যান অফ দ্য ম্যাচও হয়েছি।
ঢাকা পোস্ট : হকিতে আসলেন কীভাবে?
মেহরাব হাসান সামিন : আমার বাবা ফুটবল খেলতেন। আমার পরিবারে খেলাধূলা পেশা হিসেবে নেওয়া আমিই প্রথম। ২০১৪ সালে বিকেএসপিতে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই পথচলা শুরু। ২০২১ সালে বিকেএসপি পর্ব শেষ হয়েছে। এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শন নিয়ে পড়ছি।
ঢাকা পোস্ট : বিশ্বকাপ নিশ্চিত করার পর এখন নিশ্চয়ই ক্যাম্পাসে আপনার তারকাখ্যাতি বাড়বে!
মেহরাব হাসান সামিন : সত্যিকার অর্থে হকিকে সেভাবে মূল্যায়ন করা হয় না। এতে খারাপ তো কিছুটা লাগেই। এখন আশা করি এর কিছু পরিবর্তন হবে।
ঢাকা পোস্ট : আগামীকাল আবার চীনের বিপক্ষে পঞ্চম স্থানের ম্যাচ। কী ভাবছেন...
মেহরাব হাসান সামিন : গ্রুপ পর্যায়ে হারাতে পারিনি, আগামীকাল চীনকে হারিয়ে পঞ্চম হয়ে দেশে ফিরতে চাই। সবাই দোয়া করবেন আমাদের জন্য।
এজেড/এফআই/জেএস
