রাত জেগে অনুশীলন, ড্রেসিংরুমে ঘুম এবং শচীনের অপরাজিত সেই ১৪৮!

অস্ট্রেলিয়ার দুরূহ কন্ডিশনে সেবার প্রথম দুটা টেস্ট দাঁড়াতেই পারেনি ভারত। খুব একটা সুবিধা করতে পারলেন না 'স্কুলবয়' শচীন টেন্ডুলকারও। সিডনিতে তৃতীয় টেস্ট শুরুর আগের রাতে না ঘুমিয়ে একা একা অনুশীলনে মগ্ন শচীন, যা চললো শেষ রাত অবধি।
সিনিয়র সতীর্থ সৌরভ গাঙ্গুলী এমন দৃশ্য দেখে চমকে গিয়েছিলেন। না ঘুমিয়ে কেন এত রাত অবধি জেগে জেগে এমন পরিশ্রম কেন, জিজ্ঞেস করতেই শচীনের জবাবটা ছিল অনেকটা এমন, 'ওদের (ম্যাকডরমেটসহ অন্যরা) কিছু ডেলিভারিতে দুর্বলতা আছে। একটু ঝালিয়ে নিচ্ছি।'
পরের দিন ড্রেসিংরুমে সেই সৌরভকে শচীন চুপিসারে বললেন, আমি হালকা একটু ঘুমিয়ে নিচ্ছি এই এখানেই। আরও একটা উইকেট পড়লে ডেকে তোলা হয় যেন। তখনো নিজ দেশের বাইরে সেভাবে বড় দল হয়ে উঠতে পারেনি ভারত। বিদেশের মাটিতে লক্ষ্যই থাকতো অনেকটা এমন যে, যতটা পারা যায় বিপর্যয় সামলে প্রতিরোধ গড়ে তোলা।
সৌভাগ্যক্রমে তৃতীয় টেস্টে ভারতের টপ-অর্ডার ভালো প্রতিরোধ গড়তে পেরেছিল সেদিন। যে কারণে শচীনও বেশ খানিকটা সময় দুই চোখ এক করার সুযোগটা পেয়ে গেলেন! দু’দণ্ড ঘুমিয়ে নিয়ে উঠেই ফ্রেশ হয়ে সাদা জার্সিটা গায়ে চাপালেন। উজ্জ্বীবিত হয়ে মাঠে নেমেই খেললেন সেই স্মরণীয় ইনিংসটা।
৫ জানুয়ারি ১৯৯২, সিডনিতে এমন দিনে অনবদ্য সেঞ্চুরিটা হাঁকিয়েছিলেন শচীন। সবচেয়ে কম বয়সে অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে সেঞ্চুরির রেকর্ডটাও গড়েছিলেন তিনি। সে সময় কাগজে-কলমে তার বয়স ছিল মোটে ১৮ বছর ২৫৬ দিন এবং প্রথমবারের মতো অস্ট্রেলিয়া সফরে গিয়েছিলেন।
দিন শেষে অপরাজিত থাকলেন ১২০ রানে। পরের দিন ব্যাট করতে নেমে ২১৫ বলে ১৪৮ রানে অপরাজিত থাকেন। অস্ট্রেলিয়ার প্রথম ইনিংসে করা ৩১৩ রানের জবাবে ভারত থেমেছিল ৪৮৩ রানে। রবি শাস্ত্রীর সঙ্গে ১৯৬ রানের জুটি গড়েন শচীন। রবি ওই ইনিংসে ডাবল সেঞ্চুরি পেয়েছিলেন। এমন টেস্টটাও শেষ পর্যন্ত জিততে পারেনি সফরকারীরা। ড্র’তেই শেষ হয়। সেই সিরিজে ৪-০ ব্যবধানে জিতে নেয় স্বাগতিক অস্ট্রেলিয়া।
সিরিজটা ভারতের জন্য দুঃস্বপ্নের মতো হয়ে থাকলেও শচীন নিজের ব্যাটিং সামর্থ্যের জানান দিতে পেরেছিলেন ঠিকই। সিডনিতে প্রায় দেড়শোর্ধ্ব রানের ইনিংসের পর মুহুর্মুহু করতালিতে সিডনির গ্যালারি বরণ করে নিয়েছিল তাকে। পিঠ চাপড়াতে ভুললেন না প্রতিপক্ষের দানব পেসাররাও। সেদিন থেকেই হয়তো লিটল মাস্টারের কাছে ভারতের পর প্রিয় মাঠ হয়ে উঠেছিল অস্ট্রেলিয়ার এই সিডনি।
শুরুতে গোল্ডেন ডাক কিংবা নাক ফেটে সাদা জার্সিটা ভিজে যাওয়ার পর প্রতিপক্ষের ক্রিকেটারদের ‘স্কুলবয় বাসায় ফিরে যাও’ স্লেজিং, আব্দুল কাদিরের তাচ্ছিল্যের জবাবে ওভারে চার ছক্কা হাঁকিয়ে জবাব দেওয়া কিংবা নিউজিল্যান্ডের মতো মৃত্যুকূপে এক বুক সাহস নিয়ে দেয়াল হয়ে দাঁড়ানো। বাইশগজে শুরুর দিককার শচীনতো ঠিক এমনই......
নিজের অটোবায়োগ্রাফিতে সেদিনের সেই মুহূর্তের স্মৃতিচারণ করে শচীন লিখেছিলেন, এখনও সময় পেলে ওই ইনিংসটার হাইলাইটস দেখেন তিনি। শচীন বলছিলেন, সিডনিতে সেঞ্চুরি করার পর ব্যাট উঁচু করতে গিয়ে অস্বস্তিতে পড়েছিলেন তিনি। সাধারণত একেকজন একেকভাবে উদযাপন করে। বিখ্যাত কারও কারও ট্রেন্ডমার্ক সেলিব্রেশনও অনেকের মনে গেঁথে আছে। কিন্তু আনাড়ি শচীন তখনো যেন এসবে অভ্যস্ত হতে পারেননি।
মাত্র ১৭ বছর বয়সে আন্তর্জাতিক অভিষেকটা হয়েছিল। সেটিও আবার চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তানের মাটিতে স্বাগতিক দলের বিপক্ষে। সেই সিরিজের শুরুতে গোল্ডেন ডাক কিংবা নাক ফেটে সাদা জার্সিটা ভিজে যাওয়ার পর প্রতিপক্ষের ক্রিকেটারদের ‘স্কুলবয় বাসায় ফিরে যাও’ স্লেজিং, আব্দুল কাদিরের তাচ্ছিল্যের জবাবে ওভারে চার ছক্কা হাঁকিয়ে জবাব দেওয়া কিংবা নিউজিল্যান্ডের মতো মৃত্যুকূপে এক বুক সাহস নিয়ে দেয়াল হয়ে দাঁড়ানো। বাইশগজে শুরুর দিককার শচীনতো ঠিক এমনই।
ক্যারিয়ারের প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরিটা এসেছিল ইংল্যান্ডের বিপক্ষে তাদের মাটিতে। তবে সবকিছুর পূর্ণতা পেয়েছিল যেন সিডনিতেই। ওই সিরিজেই পরে পার্থে আরেকটি সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছিলেন। বিশ্ব ক্রিকেটও ধীরে ধীরে জেনে গিয়েছিল আরেক কিংবদন্তী আসছে...।
[শচীন টেন্ডুলকারের জীবনী ‘My Autobiography : Playing It My Way: Sachin Tendulkar’ অবলম্বনে লেখা]
এফআই