ক্লাবেও খেলতে পারছেন না সাবিনা-মাসুরারা, ‘প্রশ্নবিদ্ধ’ বাটলার

ডিসেম্বর নেপালের কাঠমান্ডুতে হবে প্রথম সাফ নারী ক্লাব চ্যাম্পিয়নশিপ। গত বছর বাংলাদেশ মহিলা লিগে চ্যাম্পিয়ন হওয়া নাসরিন স্পোর্টিং ক্লাব এই টুর্নামেন্টে খেলবে। সাবিনা-মাসুরাদের জাতীয় দলে ডাকেন না কোচ পিটার বাটলার। এবার নানা ঘটনায় নাসরিন স্পোর্টিংয়ের হয়েও খেলা হচ্ছে না তাদের।
গত বছর নাসরিন স্পোর্টিংয়ের হয়ে খেলেছিলেন সাবিনা, কৃষ্ণা, ঋতুপর্ণা, রুপ্নাসহ পুরো জাতীয় দলই। এবারও সাবিনা, মাসুরাদের নিয়েই নাসরিন স্পোর্টিংয়ের দল হওয়ার কথা। শেষ পর্যন্ত তারা খেলছেন না। এ নিয়ে ফরোয়ার্ড কৃষ্ণা রাণী সরকার বলেন, 'আমরা নাসরিনের খেলার জন্য অপেক্ষায় ও প্রস্তুত ছিলাম। ক্লাব থেকে গত বার যারা খেলেছিল তাদের সকলকে নিয়েই দল গঠন করতে চেয়েছিল। জাতীয় দলের ক্যাম্পে যারা সিনিয়র রয়েছে তাদেরকে ছাড়েনি। এজন্য একেবারে জুনিয়রদের নিয়ে দল গঠন হচ্ছে। এই ক্লাব টুর্নামেন্টে অন্য দেশ থেকে ভালো দলই আসছে। জাতীয় দলের ক্যাম্পে থেকে কোচ ও ফেডারেশন কোনো খেলোয়াড় না ছাড়ায় আমরাও খেলতে যাচ্ছি না। আমরা জাতীয় দলে টানা দুই বার দক্ষিণ এশিয়ার সেরা, ক্লাব দলে জুনিয়র ও অনভিজ্ঞ খেলোয়াড়দের সঙ্গে গেলে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রাখা সম্ভব নয়।'
বিশ্ব জুড়েই ফুটবলারদের সঙ্গে চুক্তি ক্লাবের। জাতীয় দলে খেলার সময় ক্লাব থেকে ছুটি নিয়ে দেশের জন্য খেলেন ফুটবলাররা। বাংলাদেশের মহিলা ফুটবলে উল্টো। ফেডারেশন ক্লাবের জন্য খেলোয়াড় ছাড়ে না। ভালো মানের ফুটবলার না পাওয়ায় এই দলে কোচিং করাচ্ছেন না কোচ সোহেল, 'আমাকে ক্লাব থেকে বলছিল কোচিং করানোর জন্য কিন্তু তারা খেলোয়াড় দিতে পারছে না ভালো। ফেডারেশনকে চিঠিও দিয়েছিল ক্লাব থেকে। এখন যে অবস্থা কোনো রকমে অনুশীলন ছাড়া ও অনভিজ্ঞ ফুটবলার দিয়ে দল পাঠাবে। এজন্য আমি কোচিং করাব না জানিয়ে দিয়েছি। বসুন্ধরা কিংস ফুটবলার ছাড়েনি এজন্য হ্যাভিয়ের ক্যাবরেরা বয়স ভিত্তিক ফুটবলার দিয়ে ক্যাম্প চালিয়েছে, আর নারী ফুটবলে ফেডারেশ ও কোচ খেলোয়াড় ছাড়ছে না এজন্য ক্লাব বয়স ভিত্তিক ফুটবলার নিয়ে দল গড়ছে সম্পূর্ণ উল্টো চিত্র।'
বাংলাদেশ নারী ফুটবল দল ১ মার্চ অস্ট্রেলিয়ায় এশিয়া কাপে খেলবে। ঐ টুর্নামেন্টের আগে সাফ ক্লাব চ্যাম্পিয়নশিপে জাতীয় দলের ফুটবলাররা খেললে ভালো প্রস্তুতি হতো বলে মনে করেন কোচ সোহেল, 'এখানে ভারতের ইস্ট বেঙ্গল, নেপাল ও ভুটানের ভালো দল আসছে। যারা সবাই জাতীয় দলের এখানে বাংলাদেশের জাতীয় ফুটবলাররা খেলতে পারলে অবশ্যই ভালো প্রস্তুতি হতো এশিয়া কাপের জন্য কিন্তু কোচ বাটলার ও ফেডারেশন হয়তো অন্য রকম পরিকল্পনা করছে।'
নাসরিন স্পোর্টিংয়ে ঋতুপর্ণা ও অন্য ফুটবলারদের খেলার ইচ্ছে ছিল। সাবিনা-কৃষ্ণারা নাসরিনের খেলবেন এজন্য কোচ পিটার বাটলার চান না তাদের সংস্পর্শে থাকুক ঋতুপর্ণা-রুপ্নারা। ফুটবলাঙ্গনের খবর, সাবিনাদের নাম নাসরিনের তালিকায় দেখার পরই পিটার বাটলার জাতীয় ফুটবলারদের না ছাড়ার জন্য বেকে বসেছেন। নাসরিন দলটি নারী সংগঠক নাসরিন আক্তার বেবীর। সাফ ক্লাব চ্যাম্পিয়নশীপে দল গঠন নিয়ে উদ্ভট সংকট নিয়ে কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি। দলটি বেবীর হলেও মূলত বাফুফের নারী উইংয়ের প্রধান মাহফুজা আক্তার কিরণের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ফুটবলাঙ্গনে সবারই জানা। কোচের কারণে কিরণও নতজানু। এই গ্যাড়াকলে জাতীয় দলের পর ক্লাব পর্যায়েও বাংলাদেশের হয়ে খেলা হচ্ছে না সাবিনাদের।
সম্প্রতি থাইল্যান্ডের বিপক্ষে দুই ম্যাচে আট গোল হজম করেছিল বাংলাদেশ। ডিফেন্সের দুর্বলতা ছিল চোখে পড়ার মতো। তাই গতকাল সংবাদ সম্মেলনে পরীক্ষিত ডিফেন্ডার মাসুরা পারভীনের প্রসঙ্গ এসেছিল। কোচ পিটার বাটলার সরাসরি বলেছেন, ‘নো’ আবার তিনি সাংবাদিকদের এ নিয়ে প্রশ্ন করতেও বারণ করেছেন।
কোচ বাটলারের এমন মন্তব্যে বেশ ব্যথিত হয়েছেন মাসুরা। তিনি দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, ‘একজন কোচ এভাবে বলতে পারেন, ‘নো’? অন্য সবার কথা বলতে পারব না, আমি তো অবশ্যই দলে খেলার মতো। তিনি তো আমার ফিটনেস-পারফরম্যান্স দেখলেন না, ট্রায়ালও নিলেন না কিভাবে বলে দিলেন নো।’
এক দশকের বেশি সময় বাংলাদেশের ডিফেন্স সামলেছেন মাসুরা। বাটলারের হাই লাইন ডিফেন্সে সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ অনেক গোল হজম করছে। এ নিয়ে বেশ উদ্বিগ্ন তিনি, ‘যখন দেখি ডিফেন্স লাইনের এই (খারাপ) অবস্থা খুব খারাপ লাগে। এত উপরে ডিফেন্স করে প্রতিপক্ষের গতিশীল ফুটবলারদের কাভার করার সামর্থ্য আমাদের রয়েছে কি না সেটা দেখতে হবে। নেপালের সঙ্গে সাফে আমি হাই লাইন খেলিনি কারণ সাবিত্রা ভান্ডারী অনেক ফাস্ট খেলোয়াড়। আমাকে এমন অবস্থায় থাকতে হবে যেন বিট না হই আর বিট হলেও যেন দ্রুত কাভার করতে পারি।’
গত বছর নেপালের কাঠমান্ডু সাফের মাঝ পর্যায়ে বাটলার ও সিনিয়র ফুটবলারদের দূরত্ব প্রকাশ্যে আসে। এক পর্যায়ে ফুটবলাররা বাটলারের উপর বিদ্রোহ ঘোষণা করেন আবার বাটলারও কয়েক জন ফুটবলারকে না ডাকার পণ করেন। দফায় দফায় আলোচনার পর দুই পক্ষ নমনীয় হয়। ফুটবলাররা নমনীয় হলেও কোচ রাগ পুষেই রয়েছেন মনে করছেন, 'ভুটান যাওয়ার আগে আমরা তার অধীনে অনুশীলন করেছি কয়েক দিন। ভুটান লিগে আমাদের পারফরম্যান্সও ভালো। এরপরও তিনি আমাদের ডাকছেন না। কেন ডাকছেন না এটা তিনিই ভালো বলতে পারবেন। তিনি না ডাকলেও আমরা সব সময় বাংলাদেশ দলের প্রতি সব সময় শুভকামনাই করি’, বলেন কৃষ্ণা রানী সরকার।
বাফুফের সঙ্গে কৃষ্ণা-সাবিনাদের চুক্তি রয়েছে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত। চুক্তি থাকার পরও তারা ফেডারেশনের ক্যাম্পে থাকার সুযোগ পান না। এজন্য বাড়িতেই থাকতে হচ্ছে। বাটলার যত দিন আছেন ততদিন তাদের জাতীয় দলের দরজা এক প্রকার বন্ধই, এখন নানা গ্যাড়াকলে ক্লাব পথও অনেকটা রুদ্ধ হওয়ায় ফুটবল ক্যারিয়ারই সংকটের মুখে।
মাসুরা-সাবিনারা ভূটানের লিগে খেলেছিলেন। সেখানে তাদের প্রস্তাব ছিল খেলার। বাংলাদেশের নাসরিনের হয়ে খেলবেন এজন্য সেখানে নাম লেখাননি, ‘ভুটানের ক্লাব অনেক অনুরোধ করেছিল খেলার জন্য, নাসরিনে খেলব এজন্য খেলিনি। এখন এই অবস্থায় নাসরিনে খেলা হচ্ছে না, অন্য জায়গাও খেলার সুযোগ নেই’, বলেন কৃষ্ণা ও মাসুরা।
২২ বছর পর বাংলাদেশ ভারতকে হারিয়েছে শেখ মোরসালিনের গোলে। যে মোরসালিনের শৃঙ্খলাজনিত অনেক অভিযোগ ছিল। এরপরও তাকে ফেডারেশন অ-২৩ দলের অধিনায়কত্ব দিয়েছে। জাতীয় দলের স্পেনিশ কোচ ক্যাবরেরা তাকে নিয়মিত দলে নিয়েছেন। সাদ উদ্দিন বসুন্ধরা কিংসের হয়ে আবাহনীর ম্যাচে অশোভন আচরণ করায় বড় শাস্তি পেয়েছিলেন জাতীয় দলের ম্যাচের আগে ডিসিপ্লিনারি কমিটি আবার শাস্তি পুর্নবিবেচনা করেছে। না হলে তার জাতীয় দলে খেলা হতো না। পুরুষ ফুটবলে যখন এই চর্চা সেখানে নারী ফুটবলে সাবিনা-মাসুরাদের মতো ফুটবলাররা সুনির্দিষ্ট কোন অপরাধে এতটাই ব্রাত্য সেই প্রশ্ন জোরালোভাবে ঘুরপাক খাচ্ছে ফুটবলাঙ্গনে। সমর্থক-পাঠকদের চাহিদা মেটানোর দায়িত্ব সাংবাদিকদের। বাটলার কালকের প্রেস কনফারেন্সে সাংবাদিকদের সাবিনাদের নিয়ে প্রশ্ন করাও বারণ করেছেন!
এজেড/এইচজেএস