‘৫০ ধরনের স্লোয়ার আমাকে স্কুলে শেখানো হয়েছে’

ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটের ফেরিওয়ালা তিনি, টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটের অন্যতম উদ্ভাবনী ক্রিকেটার। তবে এখনো গায়ে জড়াতে পারেননি জাতীয় দলের জার্সি। ৩৩ বছর বয়স পার করলেও স্বপ্ন দেখেন ইংল্যান্ড দলে অভিষেকের। পাওয়ার হিটিংয়ের সঙ্গে মিডিয়াম পেস, কখনো অফ স্পিনার আবার সুযোগ বুঝে হয়ে যান লেগ স্পিনার। বেনি হাওয়েল নিজের বোলিংয়ে বৈচিত্র্য আনতে অস্ত্রাগারে রেখেছেন বিভিন্ন ধরনের স্লোয়ার।
হাওয়েল এবার চতুর্থবারের মতো বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ খেলতে এসে নিজেকে নতুন করে চিনিয়েছেন। বেসবল থেকে ক্রিকেট, ৫০ ধরনের স্লোয়ার, মানসিক রোগ (এডিএইচডি) জয় আর কেনই বা তাকে ‘সিটিজেন অফ ওয়ার্ল্ড’ বলা হয়, সেসব নিয়ে কথা বলেছেন ঢাকা পোস্টের সঙ্গে।
প্রশ্ন: আপনাকে ‘সিটিজেন অফ ওয়ার্ল্ড’ বললেও নেহায়েত মন্দ বলা হবে না। মা অস্ট্রেলিয়ান, বাবা ইংলিশ। আপনি জন্ম নিয়েছেন ফ্রান্সে। আপনার স্ত্রী আর্জেন্টাইন, আবার অর্ধেক আমেরিকান। আপনি সব ছাপিয়ে ইংল্যান্ডকে বেছে নিলেন যে?
হাওয়েল: আমার স্কুল ছিল ইংল্যান্ডে। তাই আমার পরিবার পৃথিবীতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকলেও নিজেকে ইংলিশ হিসেবে পরিচয় দেই। হ্যাম্পশায়ারের সাথে আমার চুক্তি হয়, তারপর গ্লুস্টারশায়ারে যাই এবং এখনও সেখানেই আছি। তাই হ্যাঁ, আমি নিজেকে ইংলিশ হিসেবেই পরিচয় দেই।
প্রশ্ন: আপনার পরিবারের মতো আপনার ক্রিকেট ক্যারিয়ারটাও বেশ বৈচিত্র্যময়। কাকতালীয় নাকি অন্যদের থেকে আলাদা হতেই বেশি পছন্দ করেন?
হাওয়েল: কুইন্সল্যান্ডে আমি একটু ভিন্নভাবে খেলি। একই জিনিস বারবার করলে একঘেয়ে হয়ে পড়ি। তাই বৈচিত্র্য ভালো লাগে। চারদিনের ক্রিকেটে তাই মিডিয়াম পেসে বল করি। বিভিন্নভাবে বল করায় আমি দলেও বৈচিত্র্য আনতে পারি।
প্রশ্ন: আপনি একাধারে পেসার, অফ স্পিনার, লেগ স্পিনার। বাঁহাতি অর্থোডক্স আর চায়নাম্যান বোলার হতে ইচ্ছে করে না? তাহলেই তো একের মধ্যে সব...
হাওয়েল: বাঁহাতি হিসেবে দক্ষ হতে গেলে বোধহয় আরও কিছু বছর কাজ করতে হবে (হাসি)। এখনও যথেষ্ট ভ্যারিয়েশন আছে বলে মনে হয় না।
প্রশ্ন: আপনি কি আসলেই ৫০ ধরনের স্লোয়ার করতে জানেন?
হাওয়েল: ৫০ ধরনের স্লোয়ার বল আমাকে স্কুলে শেখানো হয়েছে। বিভিন্ন ধরনের স্লোয়ার বল আমি করতে পারি, পিচ, ব্যাটার ও কন্ডিশন অনুযায়ী। প্রয়োজন অনুযায়ী এগুলো ব্যবহার করব।
প্রশ্ন: স্ক্রু বল, স্প্লিট ফিঙ্গার, কার্ভ বলের মতো এমন অনেক ধরনের বল আপনার বোলিংয়ের অস্ত্র। আর কি কি ধরনের বোলিং কৌশল আপনার অস্ত্রাগারে আছে?
হাওয়েল: আমি বোলিংয়ে বৈচিত্র্য আনতে ভালোবাসি। আগেই বলেছি, আমি অনেক ধরনের স্লোয়ার ব্যবহার করতে পারি।
প্রশ্ন: বোলিং নিয়ে তো অনেক কথা হলো। এবার আপনার ক্রিকেটে আসার গল্পটা শোনা যাক...
হাওয়েল: আমার বাবা একজন ক্রিকেটার ছিলেন। আমি যে স্কুলে পড়তাম সেখানে তিনি হেড কোচ হিসেবে ছিলেন। ডায়মন্ড খেতাব অর্জন করে আমি দ্রুতই স্কুল ত্যাগ করি। আমি সবসময় বাইরে যেতে চেয়েছিলাম। রাগবি ও অন্যান্য খেলাও খেলেছি। শেষমেশ ক্রিকেটই বেশি ভালোবেসেছি।
প্রশ্ন: বিশ্বজুড়ে ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেট খেলেন। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট আপনার সঙ্গে মানানসই, আপনার ব্র্যান্ড ক্রিকেট বলা যায়। অথচ ক্যারিয়ারের শুরুতে দল থেকে বাদ পড়েন আপনার ব্যাটিংয়ের ধরন ঠিক টি-টোয়েন্টিসুলভ ছিল না বলে। এরপর বিশ্বজুড়ে নিজেকে চেনালেন কিভাবে?
হাওয়েল: টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট শুরু করার সময় আমি ছিলাম স্পেশালিষ্ট ব্যাটসম্যান। ইংল্যান্ডে তখন ১৪০-১৫০ রান হাই স্কোর। এখন তা চলে গেছে ১৮০-তে। একসময় ব্যাটিংয়ের পাশাপাশি বোলিংয়ের সিদ্ধান্ত নিলাম। এটা শুধু মূল্যই বাড়ায় না, একই সাথে মাঠে আমার একঘেয়েমিও কাটায় (হাসি)। আমি চেয়েছি বল আমার হাতেও থাকুক। এভাবেই বোলিংয়ের শুরু। এরপর টি-টোয়েন্টিতে সাফল্য ধরা দিতে থাকে।
প্রশ্ন: আপনি বেসবল খেলতেন। বেসবল থেকে ক্রিকেটে আসার কারণ?
হাওয়েল: মেলবোর্নে আমি ক্লাব বেসবল খেলেছি। ফ্লোরিডায় মেজর লিগ গেম দেখে প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম। বেসবলে ব্যাটসম্যানদের কাজ হলো রানের জন্য ছুটতে থাকা। এজন্য তাদের স্মার্ট হতে হয়, অনেকক্ষণ পরিশ্রম করতে হয়। এসব দেখে বেসবলে আগ্রহী হয়ে উঠি। তখন নাকল বল, স্প্লিট ফিঙ্গার, স্লাইড এসব শিখি। বেসবলের এসব জ্ঞান ক্রিকেটে কাজে লাগিয়েছি।
প্রশ্ন: এবার বিপিএলে আসা যাক। খুলনা, রংপুরের পর এবার চট্টগ্রামের হয়ে বিপিএল খেলতে এলেন। সব মিলিয়ে এ নিয়ে চতুর্থবার বিপিএল খেলতে বাংলাদেশে। এখানকার ক্রিকেট কতটা উপভোগ করেন?
হাওয়েল: আমি ক্রিকেট খেলতে ভালোবাসি। এখানে খেলতে এসেছি কারণ বাংলাদেশে সবাই ক্রিকেট ভালোবাসে। তারা অনেক প্যাশনেট। এটা আপনাকে খেলার এনার্জি এনে দেয়। এখানে খেলা অনেক চ্যালেঞ্জিং। এই চ্যালেঞ্জ আমি ভালোবাসি। এজন্য এখানে খেলতে আসি। বাংলাদেশে আমার দিনগুলো উপভোগ করছি।
প্রশ্ন: এর আগে নিরাপত্তাজনিত কারণে বিপিএল খেলার উপর আপনাদের নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল ব্রিটিশ সরকার। সে সব উপেক্ষা করে আপনি বাংলাদেশে এসেছেন। এমনকি এর জন্য আর্জেন্টিনায় অনুশীলন করেছেন। সেই গল্পটা বলবেন আমাদের?
হাওয়েল: নিরাপত্তার জন্য বাইরে না যেতে বলেছে। তবে একবার সুযোগ পেলে হাতছাড়া করব না। এখানে আসার আগে আর্জেন্টিনায় আমার স্ত্রীর পরিবারের কাছে গিয়েছিলাম। ওখানে অনুশীলনের জন্য নেট ফ্যাসিলিটি ছিল না। তখন স্থানীয় ফুটবল মাঠে চলে যাই। আর্জেন্টিনায় ক্রিকেট অনেক বেশি খেলা হয় না। আমাকে তাই সবাই অবাক হয়ে দেখছিল। কিছু প্রশ্নও জিজ্ঞেস করেছে যা আমি বুঝতে পারিনি। তবে ভিন্ন পরিস্থিতিতে অনুশীলনের বিষয়টি দারুণ এক অভিজ্ঞতা ছিল।
প্রশ্ন: ফুটবলের দেশে ক্রিকেটের অনুশীলন! আর্জেন্টিনা ডিয়েগো ম্যারাডোনা বা লিওনেল মেসির মতো কিংবদন্তির দেশ। তাদের কারো সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছে কখনো?
হাওয়েল: না ম্যারাডোনা বা লিওনেল মেসি- তাদের সঙ্গে আমরা কখনোই দেখা হয়নি।
প্রশ্ন: বাংলাদেশে তো ভালো মানের পাওয়ার হিটার নেই। এই ঘাটতি কিভাবে পূরণ করা যায় বলে মনে করে?
হাওয়েল: এটা আমার জন্য কঠিন প্রশ্ন।
প্রশ্ন: একই উইকেটে স্থানীয়রা যেখানে রান বের করতে সংগ্রাম করছে, সেখানে আপনি প্রায় প্রতি ম্যাচেই ২০০+ স্ট্রাইক রেটে ব্যাট করছেন। অনায়াশে বল সীমানা ছাড়া করছেন। রহস্যটা বলবেন?
হাওয়েল: আমার মনেহয় এটি পরিস্থিতি চাহিদা মেটানোর উপর নির্ভরশীল।
প্রশ্ন: আপনার আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ক্যারিয়ার দিয়ে ইতি টানতে চাই। কাউন্টিতে বেশ ধারাবাহিক পারফরম্যান্স আপনার। তবে এখনো ইংল্যান্ড জাতীয় জার্সি গায়ে ওঠেনি। একবার তো বিশ্বকাপ স্কোয়াডের খুব কাছে থেকেও বাদ পড়ে গেলেন। ইংল্যান্ডের হয়ে খেলার স্বপ্ন বা আশা ছেড়ে দিয়েছেন কি?
হাওয়েল: ইংল্যান্ডের হয়ে খেলা এখনও আমার স্বপ্ন। সুযোগ পেলে নিজেকে নিংড়ে দিব। আমি পরিশ্রম করে যাচ্ছি। আশা রাখি… একদিন হয়ত খেলব।
প্রশ্ন: আপনি ছোট বেলা থেকেই এডিএইচডি (অ্যাটেনশন ডেফিসিট হাইপারঅ্যাক্টিভিটি ডিসঅর্ডার) নামক ব্যাধিতে ভুগছেন। এই রোগটা মাইকেল ফেলিপ থেকে শুরু করে বিশ্বের অনেক কিংবদন্তি খেলোয়াড়ের আছে। রোগটা আসলে কি? কিভাবে মানিয়ে চলেন?
হাওয়েল: আমি এডিএইচডি নিয়েই বেড়ে উঠেছি। মস্তিষ্ককে পরিষ্কার রাখার জন্য প্রচুর পরিমাণে ওষুধ সেবন করেছি সঙ্গে মেডিটেশন করেছি। আমার মনে হয় অসুস্থতা কোনো সমস্যা নয়।
টিআইএস/এটি/এনইউ
