নবম ও দশম শ্রেণির বাংলা দ্বিতীয় পত্র : প্রবন্ধ রচনা (২য় পর্ব)
সুপ্রিয় নবম ও দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী বন্ধুরা, শুভেচ্ছা নিয়ো। আজ তোমাদের বাংলা দ্বিতীয় পত্রের আরো ১টি প্রবন্ধ রচনা নিয়ে আলোচনা করব। প্রবন্ধ রচনায় বেশি নম্বর পেতে তোমরা কবিতার লাইন, কোটেশন দিতে পারো। তবে পরীক্ষায় প্রবন্ধ রচনা প্রাসঙ্গিক ও যথাযথ বক্তব্যে লিখলে ভালো।
তোমার প্রিয় লেখক বা কবি /জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম
ভূমিকা : থাকব নাকো বদ্ধ ঘরে
দেখব এবার জগৎটাকে,
কেমন করে ঘুরছে মানুষ
যুগান্তরের ঘূর্ণিপাকে।”
- (সংকল্প: কাজী নজরুল ইসলাম)
রবীন্দ্র প্রতিভার সুদূরব্যাপ্ত ইন্দ্রজাল থেকে মুক্ত হয়ে বিংশ শতকের যে কয়েকজন কবি আপন প্রতিভার মৌলিক স্বাক্ষরে বাংলা সাহিত্যে স্থায়ী আসন দখল করেছিলেন, কাজী নজরুল ইসলাম তাঁদের মধ্যে অন্যতম। ‘বলাকার যুগে’ কবিগুরু যখন অমর যৌবনের অজর, দৃপ্ত সঙ্গতি সাধনে অবুঝ-বৃদ্ধ ও জরার বিলুপ্তির জন্যে চিরসবুজের আবাহন করেছিলেন, ঠিক তখনই সর্বনাশা এক প্রলয়ঙ্করী ঝড়ের উম্মাদনাকে বক্ষে ধারণ করে বিজয় কেতন উড়িয়ে, ‘অট্টহাসে আকাশ জুড়ে’ বাংলাসাহিত্যের রঙ্গমঞ্চে নজরুলের আবির্ভাব। চিরপুরাতনকে চুরমার করে দিয়ে তিনি তারুণ্যের উগ্রসুরা রসে বাংলা সাহিত্যকে এক নতুন সম্ভাবনাময় সঞ্জীবিত করলেন। আর তাইতো তিনি আমাদের বিদ্রোহ কবি, মানবতার কবি, প্রেমের কবি ও জাতীয় কবি।
কবির জন্ম পরিচয় : ১৮৯৯ সালের ২৪ মে (১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ জ্যৈষ্ঠ) পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম কাজী ফকির আহমদ এবং মাতার নাম জায়েদা খাতুন। ছেলেবেলায় নজরুলের নাম ছিল দুখু মিয়া।
কবির শিক্ষাজীবন : ছোট থেকেই নজরুলই ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী। গ্রামের মক্তব থেকে তিনি প্রাইমারি পাস করেন। এরপর তিনি ময়মনসিংহ ত্রিশালের দরিরামপুর হাইস্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে কিছুকাল পড়ালেখা করেন। তারপর তিনি ভর্তি হন বর্ধমান জেলার রানীগঞ্জ সিয়ারসোল রাজ হাইস্কুলে। এখানে দশম শ্রেণির ছাত্র থাকা অবস্থায় তিনি ৪৯ নম্বর বেঙ্গল রেজিমেন্ট সৈনিক হয়ে প্রথম মহাযুদ্ধে যোগদান করেন। নজরুলের প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনার এখানেই ইতি ঘটে।
কবির কর্মজীবন : নজরুল বারো বছর বয়সে লেটোর গানের দলে যোগ দেন। সেখানে থেকে তিনি সামান্য কিছু রোজগার করতেন। এরপর তিনি আসানসোলের এক রুটির দোকানে মাসিক এক টাকা বেতনে চাকরি নেন। বাঙালি পল্টন সৈনিক হিসেবে কিছুকাল অতিবাহিত করার পর কাব্যসাধনায় তিনি পুরোপুরি নিয়োজিত হন। সাংবাদিক হিসেবেও তিনি যথেষ্ট কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় নবযুগ, লাঙল ও ধূমকেতু পত্রিকা। পত্রিকাগুলো যথেষ্ট জনপ্রিয় হয়েছিল।
কবির কাব্যপ্রতিভা : ১৯২০ সাল থেকে নজরুল পুরোপুরি সাহিত্য রচনায় মনোনিবেশ করেন। তাঁর প্রথম প্রকাশিত কবিতার নাম ‘মুক্তি’। কিন্তু যে কবিতা তাঁকে খ্যাতি এনে দেয় তার নাম ‘বিদ্রোহী’। ঐ কবিতায় তিনি লিখেছেন-
“মহাবিদ্রোহী রণক্লান্ত,
আমি সেইদিন হবো শান্ত
যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দনরোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না।
অত্যাচারের খড়গ কৃপাণ ভীম রণ ভূমে রণিবে না
মহাবিদ্রোহী রণক্লান্ত,
আমি সেইদিন হবো শান্ত।”
পরবর্তীকালে তিনি ‘বিদ্রোহী কবি’ হিসেবে সমধিক পরিচিতি লাভ করেন। ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ কবিতাটি রচনা করে তিনি ব্রিটিশ শাসকদের ব্যঙ্গ করেছিলেন। এ কারণে তাঁকে কারাবরণও করতে হয়েছে। তিনি বজ্রকণ্ঠে লিখেছেন-
‘কারার ঐ লৌহ কপাট
ভেঙ্গে ফেল করবে লোপাট
---------------------
লাথি মার ভাঙরে তালা
যত সব বন্দীশালায়
আগুন জ্বালা।’
সাহিত্যকীর্তি : কাজী নজরুল ইসলাম খুব অল্প সময় সাহিত্য সাধনার সুযোগ পেয়েছিলেন। তার মধ্যেই তিনি রচনা করেছিলেন অগ্নিবীণা, বিষের বাঁশী, চক্রবাক, দোলনচাঁপা, ফণিমনসা প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থ এবং কুহেলিকা, মৃত্যুক্ষুধা প্রভৃতি উপন্যাস। তিনি প্রায় তিন হাজারের মতো গান রচনা করেছেন। যেমন- তিনি রণসঙ্গীতে লিখেছেন,
“চল্ চল্ চল্!
ঊর্ধ্ব গগনে বাজে মাদল,
নিম্নে উতলা ধরণীতল
অরুণ প্রাতের তরুণ দল
চলরে চলরে চল।”
এভাবে তাঁর প্রতিটি গানের সুরের বৈচিত্র্য আমাদের মুগ্ধ করে। মানুষ এখনও শ্রদ্ধা সহকারে তাঁর গানগুলো শোনে ও চর্চা করে।
স্বদেশপ্রেম : নজরুল দেশকে ভালোবেসেছেন অন্তর দিয়ে। ব্রিটিশদের প্রচণ্ড অত্যাচার সহ্য করেছেন, তবু জন্মভূমির এতটুকু অসম্মানও সহ্য করেননি। স্বদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য রূপমুগ্ধ কবির লেখনীতে ফুটে উঠেছে-
“একি অপরূপ রূপে মা তোমায় হেরিনু পল্লি-জননী,
ফুলে ও ফসলে কাদা মাটি জলে ঝলমল করে লাবণী।”
আবার তিনি স্বদেশেপ্রেমে জাগ্রত হয়ে জীবনের শেষ প্রবন্ধে ‘বাঙালির বাংলা’য় লিখেছেন- ‘বাংলা বাঙালির হোক! বাংলার জয় হোক। বাঙালির জয় হোক।”
সাম্যবাদ ও মানবতাবোধ : নজরুলকে বলা হয় সাম্যের কবি, মানবতার কবি। তাঁর চোখে নারী-পুরুষ ছিল সমান। নারী-পুরুষের সাম্য নিয়ে তিনি ‘নারী’ কবিতায় লিখেছেন-
“সাম্যের গান গাই
আমার চোক্ষে পুরুষ-রমণী কোনো ভেদাভেদ নাই!
বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির –কল্যাণকর,
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।”
এছাড়াও সাম্যবাদী চেতনায় জাগ্রত হয়ে তিনি ‘কুলি-মজুর’ কবিতায় লিখেছেন-
‘এমনি করে কি জগৎ জুড়িয়া মার খাবে দুর্বল? ’
কবি নজরুল ইসলাম অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি হিন্দু-মুসলমানকে সমান চোখে দেখতেন এবং এই দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে অটুট মৈত্রী কামনা করতেন। ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে হিন্দু-মুসলমান সাম্পদায়িক বিরোধ ও দাঙ্গার বিরুদ্ধে তাঁর শক্তিশালী কলমকে হাতিয়ার করেন। তিনি লিখলেন ‘কাণ্ডারী হুঁশিয়ার’, ‘পথের দিশা’, ‘হিন্দু-মুসলিম যুদ্ধ’ ইত্যাদি সাম্প্রদায়িক বিরোধী কবিতা। তাঁর বলিষ্ঠ লেখনী থেকে বেরিয়ে এলো চিরন্তন সত্য-
“অসহায় জাতি মরিছে ডুবিয়া, জানে না সন্তরণ,
কাণ্ডারী! আজ দেখিব তোমার মাতৃমুক্তিপণ।
‘হিন্দু না ওরা মুসলিম?’ ওই জিজ্ঞাসে কোন জন?
কাণ্ডারী! বল ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মার।’
- (কাণ্ডারী হুঁশিয়ার: কাজী নজরুল ইসলাম)
আবার তিনি ‘মানুষ’ কবিতায় একই সুরে লিখেছেন-
“গাহি সাম্যের গান-
মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান
নাই দেশ-কাল-পাত্রের ভেদ, অভেদ ধর্মজাতি,
সব দেশে সব কালে ঘরে-ঘরে তিনি মানুষের জ্ঞাতি।”
সংবর্ধনা, সম্মাননা ও পুরস্কার : ১৯২৯ সালে কলকাতা অ্যালবার্ট হলে নজরুলকে জাতির পক্ষ থেকে সম্মাননা জানানো হয়। ১৯৩৮ সালে কলকাতায় অনুষ্ঠিত বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সম্মেলনে নজরুলকে সভাপতির পদে সমাসীন করে সম্মান দেখানো হয়। ১৯৪৫ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় নজরুলকে ‘জগত্তারিণী স্বর্ণপদক’ প্রদান করে। ১৯৬০ সালে ভারত সরকার তাঁকে ‘পদ্মভূষণ’ উপাধি দেয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৭৫ সালে তাঁকে ডি.লিট. উপাধি প্রদান করা হয়। ১৯৭৬ সালে তিনি একুশে পদক লাভ করেন।
কবির বাংলাদেশে আগমন : ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রচেষ্টায় অসুস্থ কবিকে ঢাকায় আনা হয়। তাঁকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদান করা হয় এবং জাতীয় কবির মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করা হয়।
কবির অসুস্থতা ও মৃত্যু : ১৯৪২ সালে কবি মস্তিষ্কের পক্ষাঘাত রোগে আক্রান্ত হয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাঁকে চিকিৎসার জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পাঠানো হলেও সুস্থ হননি তিনি। এরপর থেকে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি ছিলেন নির্বাক। বাংলাদেশে অবস্থানকালে ১৯৭৬ সালে ২৯ আগস্ট কবি মৃত্যুবরণ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদ প্রাঙ্গনে তাঁকে পূর্ণ সামরিক মর্যাদায় দাফন করা হয়। প্রতিবছরই তাঁর জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁর সমাধিতে সবাই শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে থাকে।
উপসংহার : বাঙালির গর্ব নজরুল। বাঙালির প্রিয় কবি নজরুল। তিনি তাঁর সৃষ্টির দ্বারাই বাংলা সাহিত্যে অমরত্ব পেয়েছেন। বাঙালি জাতি চিরকাল তাঁকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে। তাঁর সাহিত্য যুগ যুগ ধরে অন্যায়ের বিরদ্ধে প্রতিবাদ করতে আমাদের প্রেরণা জোগাবে। নজরুল শুধু একটি সময়ের কবি নন। তিনি সব সময়ের সব মানুষের কবি। আমাদের অস্তিত্বের সাথে এ নামটি আজ মিলে মিশে একাকার হয়ে গেছে। তাই ইংরেজ কবি Shelly-র ভাষায় বলতে ইচ্ছা করছে- True love in the differs from gold and clay
That to divide is not to take away.
এমকে