ভাব-সম্প্রসারণ : ভোগে সুখ নাই, ত্যাগেই প্রকৃত সুখ
সুপ্রিয় নবম ও দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী বন্ধুরা, শুভেচ্ছা নিয়ো। আজ তোমাদের বাংলা দ্বিতীয় পত্রের নির্মিত অংশ থেকে আরো দু’টি ভাব-সম্প্রসারণ নিয়ে আলোচনা করব। পরীক্ষায় ভাব-সম্প্রসারণে বেশি নম্বর পেতে মূল ভাব অংশে প্রদত্ত বিষয়টির প্রকৃত অর্থ তুলে ধরবে। এটি বেশি বড় করবে না।
ভোগে সুখ নাই, ত্যাগেই প্রকৃত সুখ।
ভাব-সম্প্রসারণ : ভোগ বিলাসিতায় প্রকৃত সুখ পাওয়া যায় না। প্রকৃত সুখ আসে আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে। আর ত্যাগ মানুষের মধ্যে মনুষ্যত্বে বিকাশ ঘটায়।
ভোগ ও ত্যাগ মানবের আত্মাবনতি ও আত্মমুক্তির রক্তাক্ত দলিল। ভোগাকাঙ্ক্ষা মানবের সীমাহীন দুঃখের কারণ। ত্যাগ মানুষকে রিক্ত করে না; বরং পূর্ণতাই এনে দেয়। অপরের হিতার্থে যিনি নিজের জীবন অকাতরে বিলিয়ে দেন, মৃত্যুর পরে তিনি আরও বড় মানুষ হিসেবে অমর হয়ে থাকেন। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায় ‘‘নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান, / ক্ষয় নাই তার ক্ষয় নাই।” আমরা যখন ভোগের জীবন-যাপন করি তখন শুধু নিজের জন্য বাঁচি। এ বাঁচা মৃত্যুর সাথে সবাই শেষ হয়ে যায়। যখন ত্যাগের জীবন-যাপন করি, তখন পরের জন্যেও বাঁচি। জীবনের ত্যাগ থাকলে জীবন অর্থবহ হয়। ত্যাগের মনোভাব মানুষকে মহৎ করে তোলে, অন্তরকে অপার আনন্দে পূর্ণ করে দেয়। অসহায়, বিপন্ন ও দুর্দশাগ্রস্থ মানুষের কল্যাণে তাদের পাশে দাঁড়াতে পারলে অন্তরে অনির্বচনীয় শান্তি ও সুখের ফল্গুধারা বয়ে যায়। তাই ত্যাগ আমাদের চরিত্রের সর্বোচ্চ আদর্শ হওয়া উচিত। ত্যাগের মাধ্যমে সৃষ্টির সর্বশ্রেষ্ঠ প্রাণি মানুষ অমরত্ব লাভ করতে পারে। ত্যাগ মহাশক্তি। অপরদিকে, ভোগ হচ্ছে লক্ষ ফণা সাপ। তাকে পদদলিত করা আমাদের কর্তব্য। ভোগাকাঙক্ষার নিবৃত্তি না হওয়া পর্যন্ত আমরা সার্থক মানুষ হিসেবে নিজেদের পরিচয় দিতে পারব না। যে ত্যাগ করতে জানে ভোগের অধিকার তারই জন্মে। এ জীবনের পরম শান্তি দেবে আর নেবে মিলাবে মিলিবের মধ্য দিয়ে।
নিঃস্বার্থভাবে অপরের জন্য জীবন বিলিয়ে দেয়ার মাঝেই জীবনে আসে চরম সার্থকতা। তাই ভোগকে পরিহার করে ত্যাগকে স্বাগত জানানো উচিত।
স্বদেশের উপকারে নাই যার মন,
কে বলে মানুষ তারে? পশু সেই জন।
ভাব-সম্প্রসারণ : স্বদেশপ্রেম মানুষের একটি মহৎ গুণ। স্বদেশ ও স্বজাতির উপকার সাধন মানুষের অন্যতম কর্তব্য। কিন্তু যার মধ্যে স্বদেশপ্রীতি নেই, সে মানুষ হলেও পশুতুল্য।
দেশপ্রেম মানুষের একটা সহজাত প্রবৃত্তি। এটি মানুষের চরম ও পরম সম্পদ। দেশপ্রেম ছাড়া মানুষের মধ্যে মা, মাটি এবং মানুষকে ভালোবাসার মতো মহৎ মানবিক চেতনা সৃষ্টি হয় না। তাই মনীষীকুল জন্মভূমিকে মায়ের মতো বলে বর্ণনা করেছেন। মায়ের রক্ত, মাংস, অস্থি, মজ্জা যেমন- সন্তানের অণু-পরমাণুর সাথে মিশে থাকে, তেমনি মিশে থাকে জন্মভূমির আলো, বাতাস, রূপ, রস, গন্ধ তাদের আপাদমস্তকে। সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ মানব হয়রত মুহাম্মদ (সা.) দেশপ্রেম সম্পর্কে বলেছেন, ‘স্বদেশপ্রেম ঈমানের অংশ’। স্বদেশের প্রতি গভীর ভালোবাসার পরিচয় ফুটে উঠেছে কবি গোবিন্দচন্দ্র দাস রচিত ‘জন্মভূমি’কবিতার প্রতিটি ছত্রে ‘জননীগো জন্মভূমি তোমারি পবন / দিতেছে জীবন মোরে নিঃশ্বাসে নিঃশ্বাসে।” যাঁরা দেশকে ভালোবাসে এবং দেশ ও জাতির কল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত রাখেন, প্রকৃতপক্ষে তাঁরাই মানুষ নামের যোগ্য। জগতের মহামানবদের প্রত্যেকেই ছিলেন স্বদেশভক্ত ও দেশের উপকারে নিবেদিত প্রাণ। বীরপুরুষেরা দেশের জন্য প্রাণ দিতেও কুণ্ঠাবোধ করেন না। তাঁরা দেশের জন্য অকাতরে নিজের জীবনকে উৎসর্গ করে থাকেন। এরূপ ইচ্ছে যে ব্যক্তির নেই, সে মানুষ অযোগ্য। নিজ মাতৃভূমিকে যে ভালোবাসে না, স্বদেশের জন্য যার কোনো অবদান নেই, মানুষ নামের জীব হয়েও সে বিবেক-বুদ্ধিহীন পশুতুল্য। সমাজের চোখে সে ঘৃণার পাত্র। মধ্যযুগের কবি আবদুল হাকিম তাঁর ‘বঙ্গবাণী’ কবিতায় মাতৃভাষা বাংলা বিদ্বেষীদের কটাক্ষভাবে ব্যঙ্গ করেছেন। তাদেরকে এ জন্মভূমি ছেড়ে কবি অন্যত্রে চলে যেতে বলেছেন।
দেশপ্রেম মানবজীবনের একটি শ্রেষ্ঠ গুণ ও অমূল্য সম্পদ। দেশমাতৃকার কল্যাণে যিনি আত্মোৎসর্গ করেন, তিনিই প্রকৃত মানুষ। পক্ষান্তরে, দেশের ভালোবাসায় যার মন নেই, সে পশুতুল্য।
শিক্ষক (বাংলা), আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, মতিঝিল, ঢাকা
এমকে