‘উন্নয়নের নামে প্রাকৃতিক সম্পদের লুণ্ঠন চলছে’
পরিবেশ ও বন একটি দেশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু দিনের পর দিন বাংলাদেশে উজাড় হচ্ছে বন, দূষিত হচ্ছে পরিবেশ। আগে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের অধীনে থেকে পরিবেশ ও বন নিয়ে সরকার কাজ করলেও ১৯৮৯ সালে দেশে আলাদাভাবে প্রতিষ্ঠা করা হয় ‘বাংলাদেশ বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়’।
১৯৭১-এ বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত এ ৫০ বছরে বাংলাদেশে পরিবেশ ও বন রক্ষায় তৈরি হয়েছে অনেক আইন ও নীতি। বেড়েছে পরিবেশ প্রশাসনও। সরকার কাজও করছে যথাসাধ্য। কিন্তু এতো কিছু ছাপিয়ে পরিবেশবিদরা সরকারের কাজ ও সাফল্যের সঙ্গে একমত হতে পারছেন না।
তারা বলছেন, সরকারের আইন-নীতিতে ও প্রকল্পে দেশের মানুষকে সংযুক্ত করা হয় না। যার ফলে স্বচ্ছতার অভাব রয়েছে। তাই, ৫০ বছর পরও দেশে দখল আন্দোলন করতে হয়। উন্নয়নের নামে চলে লুণ্ঠন। তবে, সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, পরিবেশবিদদের এসব বক্তব্যের সঙ্গে বাস্তবের কোনো মিল নেই।
আরও পড়ুন: বনাঞ্চল ২৪ শতাংশ করার চ্যালেঞ্জ অধিদফতরের
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর এ ৫০ বছরে দেশে পরিবেশ ও বন কতটুকু সাফল্য অর্জন করছে— এমন এক প্রশ্নের জবাবে দেশের পরিবেশবিদরা ঢাকা পোস্টের কাছে তাদের অভিমত তুলে ধরেছেন।
‘যতদিন মানুষের ক্ষমতায়ন সঠিকভাবে না হবে, ততদিন পর্যন্ত সম্পদের সঠিক ব্যবহার হবে না’
আজ থেকে ২০ বছর আগে বাংলাদেশে পরিবেশ নিয়ে কাজ শুরু করেন বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘যখন আমি পরিবেশ নিয়ে কাজ শুরু করি, তখন দেশে পরিবেশের অবস্থা এখনকার চেয়ে নিশ্চয়ই অনেক ভালো ছিল। আমাদের বন, নদ-নদী আর জলাশয় বলেন তখন সব কিছুই প্রাকৃতিক অবস্থায় ছিল। যেটা গুরুত্বপূর্ণ, সেটা হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল কেন? মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল এজন্য, যেন আমরা নিজেদের সম্পদ নিজেরা সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারি। যাতে আমাদের সম্পদ বাইরে থেকে কেউ লুণ্ঠন করে নিয়ে যেতে না পারে।
ফরেস্ট অ্যাক্ট ১৯২৭ যদি আপনি দেখেন, ফরেস্ট রেগুলেট করার জন্য ১৯২৭ সালে ব্রিটিশরা এ আইন তৈরি করেছিল। কারণ, তখন আমাদের বনের পরিমাণ ছিল ২৫ ভাগের বেশি। তারা সম্পদ নিয়ে যাওয়ার জন্য এখানে এসেছিল। আর সেজন্যই তারা আইন তৈরি করেছিল, কীভাবে ফরেস্টকে রেগুলেট করা যায়। আমরা যখন এটি রিফর্ম করতে বসলাম। এই সরকারের প্রথম মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর চারটা মিটিং করে আমাদের আর ডাকা হলো না। এখন আমরা দেখছি ফরেস্ট রিলেটেড যত ডিভিশন আছে, সবই হচ্ছে ফরেস্টকে ধ্বংস করে দেওয়ার। যে সব কর্মকাণ্ড হয়েছে এবং সেগুলো কিভাবে আইনগতভাবে বৈধতা দেওয়া যায়, তার প্রচেষ্টা। আমাদের অবজারভেশন চিন্তা করে সেটা কখনও করা হয়নি। আমরা নদীর ক্ষেত্রেও তাই দেখেছি।’
আরও পড়ুন: ২০৪১ সালের মধ্যে দূষণমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্য সরকারের
তিনি আরও বলেন, ‘স্বাধীনতার ৫০ বছর পরে এসে সুপ্রিম কোর্টকে বলতে হল নদী হচ্ছে জীবন্ত সত্তা। তোমরা দেশের কোন নদী মেরো না।' পৃথিবীর কোন দেশের হাইকোর্ট তো এটা বলে নাই, এর কারণ কি তাহলে? শুধু বাংলাদেশে বলছে। কারণ, বাংলাদেশের নদীগুলো এতই বেশি বিপর্যস্ত, এত বেশি দখল এবং দূষণের শিকার যে এগুলোকে বাঁচানোর জন্য সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা আদালত থেকে করা হয়েছে। এটির ত্রুটিপূর্ণ বাস্তবায়নের জন্য যতটুকু ক্ষতি হওয়ার, তার চেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে বা হচ্ছে।’
শরিফ জামিল বলেন, ‘স্বাধীনতার ৫০ বছর পরে এসে আমাদের বলতে হয় তিস্তা নদী নিয়ে সরকার বিলিয়ন ডলারের কী প্রজেক্ট করেছে, সেটা আমরা জানি না। আজকে স্বাধীনতার ৫০ বছর পরে এসে বলতে হয়, উপকূলীয় এলাকায় মিলিয়ন মিলিয়ন ডলারের উন্নয়ন প্রকল্পগুলোতে পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়নে (ইআইএ) কেন পাবলিক লেভেল নাই? আজকে স্বাধীনতার ৫০ বছর পরে এসে বলতে হয়, মেগা প্রকল্প গ্রহণে স্থানীয়দের সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুযোগ করা হোক।'
তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে সরকারের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘এদেশের মানুষের নিজের সম্পদ ব্যবহারের সক্ষমতা অর্জন করার মানসিকতায় মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল।
কিন্তু আজ ৫০ বছর পরেও দখল আন্দোলনে বলতে হয়, দেশের যে কোন নীতি আইন বা প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়নের সবাইকে যুক্ত করা হোক। কারণ, এখনও মানুষকে সংযুক্ত করে সেগুলো বাস্তবায়ন করা হয় না। যতদিন পর্যন্ত মানুষের ক্ষমতায়ন সঠিকভাবে না হবে, ততদিন পর্যন্ত সম্পদের সঠিক ব্যবহার হবে না। পরিবেশ বিপর্যয় তলানিতেই থাকবে।’
৫০ বছরে অন্যায়-অনিয়মগুলো প্রাতিষ্ঠানিক হয়েছে
যখন আমরা কাজটা শুরু করেছিলাম তখন পরিবেশ প্রশাসন, পরিবেশ আইন ও নীতি এখনকার মতো এতো সাজানো ছিল না। এখন পরিবেশ আইন ও নীতি, পরিবেশ প্রশাসনের সবখানে আমরা দেখছি নতুন নতুন সংযোজন হয়েছে। জনবল বেড়েছে, অফিস বেড়েছে, আইনের সংখ্যা বেড়েছে, বিধিমালার সংখ্যা বেড়েছে— এমনটাই বলছিলেন পরিবেশ নিয়ে কাজ করা বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান।
তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘সেই সময়ের যতোটুকু গাছ ছিল বনে, যতটুকু প্রাকৃতিক পরিবেশ ছিল তার থেকে অবস্থাটা এখন খারাপ হয়েছে। তখন নদী দখল ছিল, কিন্তু দখলের বিরুদ্ধে আওয়াজ ছিল না। এখন সে আওয়াজটা আছে। বাংলাদেশে জলাশয় হারানোর পরিমাণ বিশ্বের অন্যান্য দেশের মধ্যে সবচাইতে বেশি। বেড়েছে নদীর দূষণও। তখনও আমাদের বাতাসে দূষণ ছিল। তবে সবচেয়ে বেশি দূষিত বাতাসের নগরী হিসেবে পরিচিত ছিল না। বর্তমানে বাতাসের দূষণে সবচেয়ে বেশি দূষিত নগরী হয়েছে ঢাকা।
পরিবেশে পারফরম্যান্সের বিচারে পৃথিবীতে যত দেশ আছে, তাদের মধ্যে আমার দেশ হচ্ছে নিচের দিক থেকে দুই নম্বর। কাজেই আমি বলব, অন্যায়-অনিয়মগুলো প্রাতিষ্ঠানিক হয়েছে। শুধুমাত্র নদী দখলমুক্ত করা, আর দূষণকারীদের বিরুদ্ধে অকেশনাল কিছু অভিযান পরিচালনা করা ছাড়া বাকি সব ক্ষেত্রেই দূষণকারীরা শিখেছে আইন কিভাবে ফাঁকি দিতে হয়। তবে নদী দখল, এক্ষেত্রে বলবো আমি রিমার্কেবল প্রগ্রেস হচ্ছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘পৃথিবীতে যত বন উজাড় হয় তার একটা গড় মাত্রা আছে। সেটি হচ্ছে ১.৩ শতাংশ হারে বন উজাড় হওয়া। কিন্তু বাংলাদেশে বন উজাড়ের পরিমাণ হল ২.৬ শতাংশ। গ্লোবাল হাইয়েস্টের দিক থেকে আমরা ডাবল। সুতরাং উপকূল বনায়নে কয়টা গাছ লাগালো এবং সামাজিক বনায়নে কয়টা গাছ লাগালো, তা দিয়ে বন ফেরত আসবে কিনা সেটা বোঝা যাচ্ছে না। বন হচ্ছে একটা প্রাকৃতিক সিস্টেম এবং প্রাণ ব্যবস্থা। সে (বন অধিদপ্তর) যদি এখন রেললাইনে গাছ লাগিয়ে বলে বন সৃষ্টি করেছি— সে বাগান সৃষ্টি করতে পারে। কিন্তু বন সৃষ্টি করতে পারে না।’
তিনি উদাহরণ টেনে বলেন, ‘সামাজিক বনায়নের বিষয়টা হচ্ছে, নির্দিষ্ট সময় পর গাছ কেটে আপনি উপকারভোগীদের টাকা দিয়ে দেবেন। তাহলে আর বন কীভাবে ফেরত আসবে ওই জায়গায়? শালগাছের জায়গায় সে (বন অধিদপ্তর) তাল গাছ লাগাচ্ছে। এতদিন সে ইউক্যালিপটাস গাছ লাগিয়েছে, হাইকোর্ট বলেছে এখন ইউক্যালিপটাস গাছ লাগানো যাবে না, তাই তাল গাছ লাগাচ্ছে। সে গাছের সংখ্যা বাড়াতে পারে। আপনার বাসার তালগাছ, আমার বাসার বটগাছ, তার বাসার তালগাছ সবগুলো এখন তার গণনায় ধরে। সেগুলো বন না। সেগুলো গাছ এবং বাগান।’
বাংলাদেশের প্রশাসনে পরিবেশ কখনোই প্রাধান্য পায়নি জানিয়ে সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘১৯৭১ সাল থেকে আজ পর্যন্ত ৫০ বছরে বাংলাদেশ খুব অল্প সময় পরিবেশের দিকে মনোনিবেশ করেছিল। ১৯৮৯ থেকে ২০০২-০৩ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের রিমার্কেবল কিছু অর্জন আছে। যেমন: পলিথিন নিষিদ্ধ করা, পরিবেশ আদালত স্থাপন করা, জলাশয় আইন করা ইত্যাদি। কিন্তু এগুলোর আগে অথবা পরে কখনোই বাংলাদেশের সার্বিক সরকার পরিচালনায় পরিবেশ প্রাধান্য পায়নি। প্রাধান্য পেয়েছে প্রাকৃতিক সম্পদ লুটেপুটে খাওয়া। উন্নয়নের নামে প্রাকৃতিক সম্পদের লুণ্ঠন এবং অবক্ষয় চলছে। যদি তাই না হতো, তবে বুড়িগঙ্গাকে বাঁচাতে হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি সরিয়ে সাভার নিয়ে ধলেশ্বরী নদীকে দূষিত করা হতো না। যার ফলে বাংলাদেশের প্রশাসনে পরিবেশ কখনোই প্রাধান্য পায়নি খুব অল্প কয়েকটা বছর ছাড়া।’
এখন কত শতাংশ বন আছে?
বর্তমানে নীতিনির্ধারকরাও পরিবেশকে সুরক্ষার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছে। অন্যদিকে পরিবেশ দূষণের মাত্রা আগের চাইতে অনেক বেশি বেড়েছে। যদিও সরকার অনেক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, মানুষ অনেক সচেতন হয়েছে। কিন্তু তারপরেও নীতিনির্ধারকরা যেভাবে এটাকে পরিচালনা করা দরকার, সেভাবে পরিচালনা করতে পারছে না। এটাই হচ্ছে বাস্তবতা— পরিবেশ নিয়ে বলতে গিয়ে এমনটাই ঢাকা পোস্টকে বলছিলেন ২৬ বছর ধরে পরিবেশ নিয়ে কাজ করা পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা) চেয়ারম্যান আবু নাসের খান।
তিনি বলেন, ‘আমাদের যে আগে বনের পরিমাণ ছিল সেটি এখন অনেকাংশে কমেছে। বর্তমানে বনের জমি আছে, কিন্তু বন নেই। একই সঙ্গে গাছপালার সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। গাছপালা এবং বন এক জিনিস না। বনের মধ্যে নানা ধরনের ছোট বড় গাছ, ঘাস, বন্যপ্রাণী, পাখিসহ আরও নানা কিছু থাকে। একটা সময় বাড়ির পেছনে ছোটখাটো ঝোপঝাড় থাকতো। যা পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করত। এগুলো এখনো বিলীন হয়ে গেছে। এটা আমাদের জন্য খুবই দুঃখজনক। দেশে বাস্তবে ২৫ শতাংশ বন থাকার কথা। কিন্তু এটা এখন ৭-৮ শতাংশ আছে কিনা সেটাও বলা মুশকিল। আমি আবারও বলছি, বনের জমি আছে, কিন্তু বন নেই।’
৫০ বছরে বাংলাদেশের অর্জন কতটুকু এসেছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আগে মানুষের জীবনযাত্রার মান কম ছিল। এখন মানুষের আয় বেড়েছে, জীবনযাত্রার মান বেড়েছে। সেইসঙ্গে তার ভোগের পরিমাণটা অনেক বেশি বেড়েছে। গাজীপুরে এখন অনেক ইন্ডাস্ট্রি হয়েছে। মানুষের কর্মসংস্থান বেড়েছে, তা ঠিক আছে। কিন্তু একই সঙ্গে পরিবেশের অনেক ক্ষতি হয়েছে। আমরা অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধি লাভ করলেও জীবনমান উন্নয়নের বিষয়টা এখনও খুবই উপেক্ষিত রয়ে গেছে। কারণ, পরিবেশ ভালো না থাকলে আমরাও ভালো থাকবো না।’
তবে পরিবেশবিদদের এসব বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন বিরোধিতা করে ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘যার যার মতো করে দেখলে তো হবে না। বাস্তবতা হচ্ছে অন্য জিনিস। অন্তত আজ থেকে ১০ বছর আগের অবস্থা ও আজকের অবস্থা চিন্তা করতে হবে। ১০ বছর আগে কী ছিল, এখন ১০ বছর পরে এসে আমরা কী করতে পেরেছি না পেরেছি এসব দেখতে হবে। তারা যদি সঠিকভাবে চিন্তা করে এসব বলতো, তাহলে আমরা মেনে নিতাম। কল্পকাহিনী তৈরি করে অনেকে অনেক কিছু বলতে পারে। কিন্তু সেটা বাস্তবতার সঙ্গে মিল নেই।’
এমএইচএন/এসএম