একটি দেশের পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষার জন্য ভূখণ্ডের অন্তত ২৫ শতাংশ বনাঞ্চল থাকা প্রয়োজন। কিন্তু বাংলাদেশের বিদ্যমান বনভূমির পরিমাণ দেশের আয়তনের প্রায় ১৫.৫৮ শতাংশ। তবে সামাজিক বনায়নসহ বনায়ন কার্যক্রম ও দেশব্যাপী বৃক্ষরোপণের ফলে দেশে বর্তমানে মোট বৃক্ষ আচ্ছাদিত ভূমির পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২২.৩৭ শতাংশ। এটিকে আগামী ২০২৫ সালের মধ্যে ২৪ শতাংশ করার চ্যালেঞ্জ নিয়েছে বাংলাদেশ বন অধিদফতর।

দেশে বর্তমানে বনজ সম্পদের ঘাটতি পূরণ, বন্যপ্রাণী ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ এবং সামাজিক বনায়নের মাধ্যমে গ্রামীণ জনগণের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়নে বন অধিদফতর ব্যাপকভাবে কাজ করে যাচ্ছে। যার ফলে বনায়ন কার্যক্রম, উপকূলীয় বনায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তন অভিযোজন, সামাজিক বনায়ন, বনায়ন কার্যক্রমে নারীর ক্ষমতায়নে ব্যাপক সাফল্য অর্জন করেছে।

এছাড়া বন ব্যবস্থায় প্রযুক্তিগত উন্নয়নের জন্য প্রশিক্ষণসহ বেশ কয়েকটি কার্যক্রম গ্রহণ করেছে সরকারি এ প্রতিষ্ঠানটি। তবে বন অধিদফতরের এতো সাফল্যকে খুব বেশি অর্জন হিসেবে দেখছেন না পরিবেশবিদরা। তারা বলছেন, বর্তমানে পরিবেশ আইন ও নীতি হয়েছে। পরিবেশ প্রশাসনের সব জায়গায় নতুন নতুন সংযোজন হয়েছে। তবে আগে বাংলাদেশের বন যে অবস্থায় ছিল, বর্তমানে তার চেয়ে খারাপ অবস্থায় রয়েছে।
 
এখন পর্যন্ত বন অধিদফতরের অর্জন
বন অধিদফতরের তথ্যমতে, ২০০৯-১০ থেকে ২০১৯-২০২০ অর্থবছর পর্যন্ত বাস্তবায়িত বিভিন্ন প্রকল্প এবং রাজস্ব বাজেটের আওতায় ৯৭ হাজার ৫৬৪ হেক্টর ব্লক, ২৪ হাজার ৬৩৩ সিডলিং কিলোমিটার স্ট্রিপ এবং ৫৭ হাজার ৬৪২ হেক্টর ম্যানগ্রোভ বাগান করেছে। বিক্রয় বিতরণের ১০ কোটি ৪০ লাখ চারা বিতরণ ও রোপণ করেছে। সামাজিক বনায়নে এখন পর্যন্ত ২ লাখ ৫ হাজার ৬৩ জন উপকারভোগীর মধ্যে ৩৯৯ কোটি ৭৮ লাখ ৪৪ হাজার ৬৯৫ টাকা বিতরণ করা হয়েছে।

সামাজিক বনায়নের মাধ্যমে সরকার এখন পর্যন্ত রাজস্ব আয় করেছে ৪৬৪ কোটি ৫২ লাখ ৯ হাজার ৪৪৪ টাকা। স্থানীয় জনগণকে সম্পৃক্ত করে বনায়নে সারাদেশের বৃক্ষাচ্ছাদনের পরিমাণ নিরূপণের জন্য বৃক্ষ ও বন জরিপের কার্যক্রম শেষ হয়েছে। দেশের জীববৈচিত্র্য রক্ষার জন্য সংরক্ষিত ও প্রাকৃতিক বনাঞ্চল থেকে গাছ কাটা ২০১৬ সালে ১ জানুয়ারি থেকে ২০২২ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বন্ধ রাখা হয়েছে।

সুন্দরবন

বন জরিপের ফলাফল অনুযায়ী, সুন্দরবনের কার্বন মজুদ ২০০৯ সালে ১০৬ মিলিয়ন টন থেকে ২০১৯ সালে ১৩৯ মিলিয়ন টনে বৃদ্ধি পেয়েছে, যা সুন্দরবনের মোট কার্বনমজুদের ৩১ শতাংশ।

২০১৬-১৯ সালের বৃক্ষজরিপ অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে বন ও বৃক্ষের মোট কার্বনমজুদের পরিমাণ ১২৭৬ মিলিয়ন টন। বন ও বন্যপ্রাণী সঠিকভাবে ব্যবস্থাপনার জন্য ১৪টি ম্যানেজমেন্ট প্ল্যান, ২টি অ্যাকশন প্ল্যান, ২টি ম্যানেজমেন্ট স্ট্র্যাটেজি ও বাংলাদেশ ওয়াইল্ড-লাইফ কনজারভেশন মাস্টার প্ল্যান অনুমোদিত হয়েছে। ১৯৮০ সাল থেকে অখ্যাকামি ১৮টি জাতীয় উদ্যান, ২৪টি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য, ১টি উদ্ভিদ উদ্যান, ৩টি ইকোপার্ক, ১টি মেরিন প্রটেক্টেড এরিয়া এবং ২টি বিশেষ জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ এলাকা ঘোষণা করা হয়েছে। বর্তমানে দেশে রক্ষিত এলাকার সংখ্যা ৪৯টি। ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে সুন্দরবনেই ৭৬ হাজার ৯৯ কিলোমিটার এবং অন্যান্য রক্ষিত এলাকায় স্মার্ট টহল পরিচালনা করা হয়েছে। স্মার্ট টহল পরিচালনার পর থেকে সুন্দরবনে বন্যপ্রাণী হত্যা, পাচার এবং বন অপরাধ অনেকাংশে হ্রাস পেয়েছে।

২০১০-১১ হতে ২০১৯-২০২০ অর্থবছর পর্যন্ত বাঘ, হাতি ও কুমিরের আক্রমণে নিহত ব্যক্তির পরিবারকে ১ লাখ ও আহত ব্যক্তির পরিবারকে ৫০ হাজার করে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া ৯৬১ জনকে প্রায় ৩ কোটি ৭১ লাখ ৯ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছে। ২০০৯-২০১০ হতে ২০১৯-২০ আর্থিক সাল পর্যন্ত উপকূলীয় এলাকায় ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে ক্ষয়ক্ষতি কমানোর জন্য উপকূলীয় সবুজ বেষ্টনি সৃজন এবং সমুদ্র ও নদী মোহনা এলাকায় জেগে ওঠা নতুন চর স্থায়ীকরার জন্য ৫৭ হাজার ৬৪২ হেক্টর বাগান তৈরি করা হয়েছে। পাহাড়ি ও শালবন এলাকার বনাঞ্চলে বনায়ন-যোগ্য এলাকা নির্ণয়ের জন্য 'সাইট স্পেসিফিক প্ল্যান' বানানোর জন্য 'ওয়েব-বেইজড মডিউলে'র মাধ্যমে উপাত্ত সংগ্রহ ও মানচিত্র তৈরির কাজ চলছে।

এদিকে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীকে স্মরণীয় করে রাখতে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় সারা দেশে জনসাধারণের মধ্যে বিনামূল্যে এক কোটি বৃক্ষের চারা বিতরণ ও রোপণ করেছে। মন্ত্রণালয়ের সার্বিক নির্দেশনায় বন অধিদফতর, জেলা প্রশাসন ও উপজেলা প্রশাসন মাঠ পর্যায়ে এই কর্মসূচি বাস্তবায়ন করেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০২০ সালের ১৬ জুলাই গণভবন থেকে এই কর্মসূচির উদ্বোধন করেন। এ উপলক্ষে দেশের প্রতিটি উপজেলায় ২০ হাজার ৩২৫টি করে বনজ, ওষুধী ও ফলজ বৃক্ষের চারা জনসাধারণের মধ্যে বিনামূল্যে বিতরণ করা হয়েছে।
 

বাংলাদেশের বন
বন অধিদফতরের ২০১৮-১৯ সালের হালনাগাদ তথ্য অনুসারে সরকার নিয়ন্ত্রিত বনভূমির পরিমাণ ২৫ লাখ ৭৫ হাজার ১৯৬.০১ হেক্টর। যা দেশের মোট আয়তনের প্রায় ১৭.৪৫ শতাংশ। অন্যদিকে বন অধিদফতর নিয়ন্ত্রিত ভূমির পরিমাণ ১৮ লাখ ৮০ হাজার ৪৯৩.৭৩ হেক্টর। এটি দেশের আয়তনের প্রায় ১২.৭৪৩ শতাংশ। দেশের ভৌগলিক অবস্থান কোন জলবায়ুর তারতম্যের কারণে বিভিন্ন ধরনের বনাঞ্চল রয়েছে বাংলাদেশে। তথ্য অনুসারে বর্তমানে দেশে পাহাড়ি বনের পরিমাণ ১৩ লাখ ৭৭ হাজার হেক্টর, যা দেশের আয়তনের ৯.৩৩ শতাংশ। শালবনের পরিমাণ ১ লাখ ২০ হাজার হেক্টর, যা দেশের আয়তনের ০.৮১ শতাংশ।

প্রাকৃতিক ম্যানগ্রোভ বনের পরিমাণ ৬ লাখ ১ হাজার ৭০০ হেক্টর, যা দেশের মোট আয়তনের ৪.০৭ শতাংশ। জলাভূমির বনের পরিমাণ ২০৪.২৫ হেক্টর, যা দেশের আয়তনের ০.০১ শতাংশ এবং সৃজিত উপকূলীয় বনভূমির পরিমাণ প্রায় ২ লাখ হেক্টর, যা দেশের আয়তনের ১.৩৬ শতাংশ। অন্যদিকে সুন্দরবনের ৩টি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যের ১ লাখ ৩৯ হাজার ৭০০ হেক্টর বনাঞ্চলকে ইউনেস্কো ১৯৯৭ সালে বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে ঘোষণা করেছে।

বন অধিদফতর দাবি করছে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বন ব্যবস্থাপনায় বেশ কিছু পরিবর্তন এসেছে। যুক্ত হয়েছে নতুন কিছু ধারণাও। এগুলো হচ্ছে- কৃষি বনায়ন, বসতবাড়ি বনায়ন, রাস্তার ধারে বনায়ন, জবরদখল করা জমিতে অংশগ্রহণমূলক বনায়ন, উপকূলীয় এলাকায় জেগে ওঠা চরে ম্যানগ্রোভ বনায়ন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় বনভূমির অবক্ষয় হ্রাসকরণ এবং বন্যপ্রাণী ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় সংরক্ষিত এলাকা ব্যবস্থাপনা।

মধুপুর বনাঞ্চল

বন অধিদফতর আসলে কতটুকু সাফল্য অর্জন করেছে- এমন এক প্রশ্নের জবাবে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান ঢাকা পোস্টকে বলেন, 'যখন আমরা পরিবেশ নিয়ে কাজ শুরু করেছিলাম তখন পরিবেশ প্রশাসন, পরিবেশ আইন ও নীতি এখনকার মতো এতো সাজানো ছিল না। এখন পরিবেশ আইন ও নীতি, পরিবেশ প্রশাসনের সবখানে আমরা দেখছি নতুন নতুন সংযোজন হয়েছে। জনবল বেড়েছে, অফিস বেড়েছে, আইনের সংখ্যা বেড়েছে, বিধিমালার সংখ্যা বেড়েছে। কিন্তু সেই সময়ের যতোটুকু গাছ ছিল বনে, যতটুকু প্রাকৃতিক পরিবেশ ছিল তার থেকে এখন অবস্থাটা খারাপ হয়েছে।'

তিনি আরও বলেন, '১৯৭১ সাল থেকে আজ পর্যন্ত ৫০ বছরে বাংলাদেশ খুব অল্প সময় পরিবেশের দিকে মনোনিবেশ করেছিল। ১৯৮৯ থেকে ২০০২-০৩ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের রিমার্কেবল কিছু অর্জন আছে। যেমন পলিথিন ব্যান করা, পরিবেশ আদালত স্থাপন করা, জলাশয় আইন করা ইত্যাদি। কিন্তু এগুলোর আগে অথবা পরে কখনোই বাংলাদেশের সার্বিক সরকার পরিচালনায় পরিবেশ প্রাধান্য পায়নি। প্রাধান্য পেয়েছে প্রাকৃতিক সম্পদ লুটেপুটে খাওয়া।'

বন অধিদফতরের সাফল্য সম্পর্কে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন বলেন, 'বনের জন্য বিশ্ব ব্যাংকের একটা সুফল প্রকল্প আমরা নিয়েছি। সেই প্রকল্পের কাজ ২০২৪-২৫ সাল পর্যন্ত চলবে। সেই প্রকল্পে আমরা কোস্টাল এরিয়াতে কাজ করছি বেশি। যেখানে যেখানে চর জেগে উঠছে, সেখানে বনায়ন করা হচ্ছে। এছাড়া বনভূমির যেখানে যেখানে গাছ নেই, সেখানে সেখানে আমরা গাছ লাগানোর ব্যবস্থা করছি। আমরা সামাজিক বনায়নও বাড়ানো চেষ্টা করছি। সব মিলিয়ে আমাদের টার্গেট আমরা ২৪-২৫ শতাংশ বনায়ন করতে পারবো। বন বিভাগের এ যাবৎকালের কর্মকাণ্ডে আমি সন্তুষ্ট।'

এমএইচএন/এসএম