নতুন জাতের উচ্চ ফলনশীল ‘ফাতেমা ধান’/ ছবি: ঢাকা পোস্ট

কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলায় নতুন জাতের উচ্চ ফলনশীল ধান উদ্ভাবন করেছেন এক কৃষক। তিনি এ ধানের নাম দিয়েছেন ‘ফাতেমা ধান’। গেল বোরো মৌসুমে মাত্র এক বিঘা তিন কাঠা জমিতে উদ্ভাবিত ধানের চাষ করে ৪২ মণ ধান উৎপাদন করেছেন তিনি। এ ধান উৎপাদন করে অল্প সময়ে বেশ ভালো সুনাম কুড়িয়েছেন কৃষক মিলন উদ্দিন। তার উদ্ভাবিত ধানের বীজ সংগ্রহ করতে ব্যাপক আগ্রহ দেখা গেছে। আশপাশের এলাকাসহ কয়েকটি জেলার কৃষকরা তার কাছে আসছেন বীজ নিয়ে যেতে। 

দুই বছর আগে ব্রি ধান ৪৯ জাতের ধানের বীজের মধ্যে উচ্চ ফলনশীল এ জাতের ধান গাছ পান কৃষক মিলন উদ্দিন। তারপর এক কাঠা জমির চার ভাগের এক ভাগে এই ধান চাষ করে সাফল্য পান তিনি। মিলন বলেন, আস্তে আস্তে উৎপাদন বাড়িয়ে আজ আমি এ পর্যন্ত পৌঁছেছি। ধান গবেষণার জন্য ধান গবেষণা ইন্সটিটিউটে পাঠাইনি। আগামী মৌসুমে ধান পর্যবেক্ষণ করবেন বলে আমাকে কৃষি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। এ ধান আরও উন্নত করে কৃষকদের হাতে হাতে পৌঁছে দিতে বা সারাদেশে ছড়িয়ে দিতে সরকারের কাছে অনুরোধ জানান মিলন।

কৃষক মিলন উদ্দিন কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার সদর ইউনিয়নের চক গ্রামের হাটপাড়া এলাকার মৃত জমির উদ্দিনের ছেলে। তিনি এইচএসসি পাস করেছেন। পরিবারের অভাব-অনটনের কারণে পরে আর পড়াশোনা করতে পারেননি। সরকারি আমলা কলেজে ডিগ্রিতে ভর্তি হয়েও তা চালাতে পারেননি। প্রথম বর্ষেই পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায়। তারপর থেকেই কৃষিকাজ করছেন মিলন। মাত্র চার বছর বয়সে বাবাকে হারিয়েছেন তিনি।

দরিদ্র পরিবারের একমাত্র সন্তান মিলন চাষাবাদ করে অনেক কষ্টে সংসার চালিয়েছেন। কয়েকবছর টাকা জমিয়ে একটি মুদি দোকান দেন তিনি। কৃষি কাজ আর মুদি ব্যবসায় ভালোই চলছিল তার সংসার। হঠাৎ স্বপ্ন দেখলেন বিদেশে গিয়ে অনেক টাকা উপার্জন করবেন। সে কারণে সবকিছু বিক্রি ও দোকানটি লিজ দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু দালালের খপ্পরে পড়ে দুবাই যাওয়ার ১৫ দিনের মধ্যে আবার দেশে ফিরে আসেন।

এমন দুঃখ-দুর্দশার সময় আশার আলোর দেখা পেয়েছেন মিলন। নতুন জাতের ধানে তার কপাল খুলেছে। এরই মধ্যে প্রায় ৬০ হাজার টাকার ধানের বীজ বিক্রি করেছেন তিনি। ৩৫ বছর বয়সী এ যুবক এক ছেলে ও এক মেয়ের বাবা।

উচ্চ ফলনশীল নতুন জাতের ধানের উদ্ভাবক কৃষক মিলন উদ্দিন বলেন, অন্যান্য জাতের একটি ধানের শীষে ১৮০ থেকে ২০০টি ধান থাকে। আর আমার উদ্ভাবিত ধানের একটি শীষে ৬০০ থেকে সাড়ে ৮০০টি ধান থাকে। দুই বছর ধরে এই ধানটি উৎপাদন করছি। প্রথমে একটি গাছে এই জাতের ধান দেখি। তারপর আস্তে আস্তে দুই বছরে এই ধানের উৎপাদন বাড়াতে থাকি। গেল মৌসুমে আমি ২৩ কাঠা (এক বিঘা তিন কাঠা) জমিতে ধান লাগিয়েছিলাম। ওই ২৩ কাঠা জমিতে ৪২ মণ ধান উৎপাদন হয়েছে। গেল মৌসুমে ধান রোপণ করেছিলাম পৌষ মাসের দিকে। গত ৪০ দিন আগে কেটেছি। রোপণ থেকে কাটা পর্যন্ত সময় লেগেছে ১৪৫ থেকে ১৫৫ দিন।

তিনি আরও বলেন, আমার উদ্ভাবিত এই ধানের ফলন খুবই ভালো। অন্য জাতের ধানের সর্বোচ্চ ফলন হলেও প্রতি বিঘা জমিতে ২৫ মণের বেশি হবে না। কিন্তু আমার এই ধান থেকে তারচেয়ে প্রায় দ্বিগুণ উৎপাদন হবে। অন্য গাছের তুলনায় এ গাছ বেশ শক্ত, লম্বা ও মোটা। রোগ ও পোকামাকড়ের হার তুলনামূলক কম। এই জাতের ধান যদি সম্প্রসারণ করা হয়, সারাদেশে যদি এই জাতের ধান চাষ করা শুরু করা হয়, তাহলে ব্যাপক ফলন হবে। সরকারকে আমার উদ্ভাবিত ধানের জাতের সম্প্রসারণের অনুরোধ জানাচ্ছি। 

মিলন বলেন, স্থানীয়ভাবে আশপাশের এলাকাসহ বিভিন্ন জেলার অনেক কৃষক আমার কাছ থেকেই বীজ সংগ্রহ করেছেন। আগামী মৌসুমে তারা নতুন জাতের ধান রোপণ করবেন। মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা ও ঝিনাইদহ জেলার অনেক কৃষকের আমার কাছে থেকে ধানের বীজ কিনে নিয়ে গেছেন। গেল মৌসুমে উৎপাদিত ধান বীজ হিসেবে বিক্রি করছি। প্রতি কেজি ধানের বীজ ১০০ টাকা থেকে ২০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করছি। এ পর্যন্ত প্রায় ২০ মণ ধান বিক্রি ও উপহার হিসেবে বিতরণ করেছি। প্রায় ৬০ হাজার টাকার ধানের বীজ বিক্রি করেছি।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমি প্রায় ১০ কেজির মতো ধান সিদ্ধ করে চাল করেছিলাম। সেই চাল থেকে রান্না করা ভাত খেয়েছি। ভাতটা খুবই ভালো মানের,  সুস্বাদু এবং রান্না করলে ভাতও বেশি বাড়ে। খুব চিকন চাল। আমি কাছের অনেক মানুষকে এই ধান উপহার দিয়েছি। ভাত খাওয়ার পর সবাই বলছে খুব ভালো।

চক গ্রামের কৃষকরা বলছেন, কয়েকবছর ধরেই ধান নিয়ে গবেষণা করছেন মিলন। নতুন জাতের ধান তিনি এ অঞ্চলের কৃষকদের মধ্যে ছড়িয়ে দিচ্ছেন। এখন অনেক কৃষক তার কাছে থেকে ১৫০ থেকে ২০০ টাকা কেজি দরে বীজ কিনেছে। আসছে মৌসুমে তারা ধান রোপণ করবেন। এখন অনেক কৃষক তা আবাদ করতে আগ্রহী। ওই ধানের ভাতও খুব সুস্বাদু। উৎপাদনও হয় অন্য জাতের চেয়ে দ্বিগুণ। এজন্য বিভিন্ন জেলা থেকে অনেকে তার কাছে বীজ নিতে আসছেন। অল্প সময়েই মিলন এই ধান উদ্ভাবনের জন্য ব্যাপক সুনাম কুড়িয়েছেন।

ওই এলাকার কৃষক আজগর আলী বলেন, মিলন ধানের নতুন জাত উদ্ভাবন করেছে। অনেক কৃষক তার উদ্ভাবিত নতুন জাতের ধান চাষ করার উদ্যোগ নিয়েছে। অনেকে তার কাছ থেকে ধানের বীজ সংগ্রহ করছেন। কম খরচে ও স্বল্প সময়ে দুই গুণ ধান উৎপাদন হবে। কৃষকরা কম খরচে এবং স্বল্প সময়ে অধিক ফসল ঘরে তুলতে আগ্রহী, তাই নতুন জাতের ধানের বীজ সংগ্রহ করছেন তারা।

একই উপজেলার আমলা সদরপুর এলাকার কৃষক হাবিবুর রহমান নতুন জাতের ধানের বীজ কিনেছেন মিলন উদ্দিনের কাছ থেকে। আসছে মৌসুমে তিনি এই জাতের ধান চাষ করবেন। হাবিবুর বলেন, এই জাতের ধানে অন্যান্য সাধারণ জাতের চেয়ে দ্বিগুণ বেশি উৎপাদন হয়। তাই আমি ধানের বীজ ১৮০ টাকা কেজি দরে সংগ্রহ করেছি।

মিরপুর উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা ইমরান বিন ইসলাম বলেন, কৃষক মিলন নিজ প্রচেষ্টায় নতুন জাতের ধান উদ্ভাবন করেছেন বলে দাবি করেছেন। আমরা ধান রোপণ থেকে শুরু করে ঘরে তোলা পর্যন্ত বিষয়টি এখনও পর্যবেক্ষণ করে দেখিনি। আমরা উদ্যোগ নিয়েছি আগামী মৌসুমে চারা রোপণ থেকে শুরু করে ধান কাটা পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করব। পর্যবেক্ষণের পর অন্যান্য জাতের ধানের সঙ্গে নতুন জাতের ধানের পার্থক্য বোঝা যাবে। আমরা নতুন জাতের ধানের ফলন ও অন্যান্য বিষয় যাচাই-বাছাই করব। এরপর যদি মনে হয় উৎপাদন ভালো, জাত হিসেবে ভালো, তাহলে আমরা ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটে ধানটি পাঠাব। এরপর যদি মনে হয় ধানটি উচ্চ ফলনশীল। তাহলে কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে অবশ্যই সম্প্রসারণের ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আমি ওই কৃষকের মুখ থেকে শুনেছি এবং ইউনিয়ন উপ-সহকারী কৃষি অফিসারের কাছ থেকে জেনেছি নতুন জাতের ধানটির ফলন ভালো।
 
সদরপুর ইউনিয়ন উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা নাঈম রেজা বলেন, প্রতিটি ধানের শীষে ৫৫০ থেকে সাড়ে ৭৫০টি ধান উৎপাদন হয়। অন্যান্য জাতের ধানের শীষে ১৮০ থেকে ২২০টি ধান হয়। ধানের গাছগুলোও অনেক লম্বা এবং শক্ত। প্রত্যন্ত অঞ্চলে তার চাষাবাদ করে। এজন্য আমরা প্রথমে জানতে পারিনি। পরে কৃষক মিলন উদ্দিন আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে। উপজেলা কৃষি অফিসে ধানের শীষ নিয়ে যান তিনি। পরে আমি তার জমিতে গিয়ে দেখি অন্য ধানের চেয়ে তার উদ্ভাবিত ধানের ফলন ভালো হয়েছে। অন্যান্য ধান ২২ থেকে ২৩ মণ এক বিঘায় উৎপাদন হয়। আর মিলনের ধান এক বিঘায় প্রায় ৩৫ থেকে ৪০ মণ উৎপাদন হবে। আসছে মৌসুমে পর্যবেক্ষণ করে সঠিক তথ্য পাওয়া যাবে।

তিনি আরও বলেন, মিলনের এই ধানের উৎপাদন ভালো হওয়ায় অনেক কৃষক বীজ নেওয়ার জন্য তার বাড়িতে ভিড় করছেন। মিলন ১০০ থেকে ২০০ টাকার মধ্যে ওই ধানের বীজ বিক্রি করছেন। আমরা প্রাথমিকভাবে ধারণা করছি, তার উদ্ভাবিত ধানটি উচ্চ উৎপাদনশীল। কিন্তু এখনও পর্যন্ত তার নতুন জাতের ধানটি ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটে পাঠানো হয়নি। আমরাও পুরোপুরি পর্যবেক্ষণ করে বিষয়টি দেখতে পারিনি। শুনেছি ২৩ কাঠা জমিতে মিলন ধান পেয়েছে ৪২ মণ। এছাড়া ধানের শীষের পার্থক্য খুঁজলেও অন্য ধানের চেয়ে মিলনের উদ্ভাবিত ধানের উৎপাদন ভালো দেখা গেছে।

এ বিষয়ে কথা বলতে কুষ্টিয়া জেলা কৃষি সম্প্রসারণ উপ-পরিচালক শ্যামল কুমার বিশ্বাসের সঙ্গে ফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করলেও তাকে পাওয়া যায়নি।

রাজু আহমেদ/এসএসএইচ