বাংলাদেশে প্রাইভেট এয়ারলাইন্সের ইতিহাস অনেকটা অম্ল-মধুর। প্রায় ২৬ বছরের যাত্রায় ৮ থেকে ৯টি এয়ারলাইন্স বন্ধ হয়ে ইতিহাসের পাতায় চলে গেছে। অনেক স্বপ্ন নিয়ে শুরু করা একেকটি এয়ারলাইন্স নিজেদের ব্র্যান্ড পরিচিতি পাওয়ার আগেই বন্ধ করে দিতে হয়েছে। যা বাংলাদেশের এভিয়েশন সঠিক পথে পরিচালিত হতে বাধাগ্রস্ত হয়েছে বারবার। 

ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের যাত্রা শুরুর পর থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত অন-টাইম ফ্লাইটের রেকর্ড ৯০ শতাংশের অধিক। যা গত দশ বছর যাত্রাপথে ইউএস-বাংলাকে যাত্রীদের আস্থা অর্জনে ভূমিকা রেখেছে। এগিয়ে যাওয়ার পথকে করেছে সুগম। ২০১৪ সালের ১৭ জুলাই ঢাকা থেকে যশোর রুটে ড্যাশ৮-কিউ৪০০ এয়ারক্রাফট দিয়ে ফ্লাইট পরিচালনার মাধ্যমে যাত্রা শুরু করে।

একটি এয়ারলাইন্সের এয়ারক্রাফটের গড় বয়স তার ব্যবসায়িক আয় ব্যয়ের ওপর সরাসরি প্রভাব সৃষ্টি করে। ব্যবসায়িক প্রবৃদ্ধি ও পরিচালন ব্যয় নির্ধারণেও বিরাট ভূমিকা পালন করে। এয়ারলাইন্সে ভ্রমণের ক্ষেত্রে যাত্রীদের পছন্দ নির্ধারণে এয়ারক্রাফটের গড় বয়স অন্যতম সহায়ক হিসেবে কাজ করে। যাত্রীরা নিরাপত্তার ক্ষেত্রে থাকে অনেকটাই নির্ভার।

বাংলাদেশের বিমান সংস্থাগুলো বিশেষ করে প্রাইভেট এয়ারলাইন্সগুলো যাত্রার পর থেকেই তাদের ব্যবহৃত উড়োজাহাজগুলোর গড় বয়স ছিল অনেক বেশী। যার ফলে উড়োজাহাজের রক্ষণাবেক্ষণ খরচ বাবদ বেশী ব্যয় করতে হতো। পাশাপাশি অনেক বেশী টেকনিক্যাল সমস্যায় পড়তে হতো, ফলে ফ্লাইট সিডিউলে বিপর্যয় ঘটত। এ অবস্থা শুধু প্রাইভেট এয়ারলাইন্সের ক্ষেত্রেই ঘটত তা নয়, জাতীয় বিমান সংস্থার ক্ষেত্রেও একই চিত্র দেখা গেছে। 

সর্বশেষ এক দশকে বাংলাদেশের এভিয়েশনে জাতীয় বিমান সংস্থার সাথে যুক্ত হয়েছে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স, নভো এয়ার ও সর্বশেষ এয়ারএ্যাস্ট্রা। তেমনি বাংলাদেশের এভিয়েশন মার্কেট থেকে বিচ্যুতি ঘটেছে জিএমজি এয়ারলাইন্স, ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ ও রিজেন্ট এয়ারওয়েজ। গত প্রায় দু’যুগ ধরে আরও কয়েকটি এয়ারলাইন্স বাংলাদেশের আকাশসীমায় জ্বলজ্বল করছিল। সেগুলো হচ্ছে এ্যারো বেঙ্গল, এয়ার পারাবাত, বেস্ট এয়ার ও এভিয়ানা এয়ারওয়েজ। 

বন্ধ হওয়া সবগুলো এয়ারলাইন্সের ব্যবহৃত এয়ারক্রাফটগুলো ছিল অনেক পুরোনো ও সঠিক সময়ে রক্ষণাবেক্ষণ না করা ছিল প্রধান দুর্বলতা। রক্ষণাবেক্ষণের জন্য অতিরিক্ত খরচ সময় মতো রক্ষণাবেক্ষণ না করার প্রবণতা তৈরি করে। বাংলাদেশের এভিয়েশনে প্রথমবারের মতো অভ্যন্তরীণ রুটে ব্র্যান্ডনিউ এয়ারক্রাফট দিয়ে ফ্লাইট পরিচালনা করছে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স। যা যাত্রী সেবায় অনন্য নজির স্থাপন করেছে। বর্তমানে ইউএস-বাংলার বহরে মোট ১৯টি এয়ারক্রাফট রয়েছে, যার মধ্যে ৮টি ব্র্যান্ডনিউ এটিআর ৭২-৬০০ এয়ারক্রাফট। 

ইউএস-বাংলা কিংবা এয়ারএ্যাস্ট্রা ব্যতীত বাংলাদেশে চালু কিংবা বন্ধ হওয়া সব বেসরকারি এয়ারলাইন্সের গড় বয়স ১৯ বছরের অধিক। পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স খুব শিগগিরই এয়ারক্রাফটগুলোর গড় বয়স ১০ বছরের মধ্যে নিয়ে আসবে, যা বাংলাদেশের প্রাইভেট এয়ারলাইন্সের ইতিহাসে সর্বনিম্ন। যাত্রী নিরাপত্তায় নতুন এয়ারক্রাফটের কোনো বিকল্প নেই। 

স্বাধীনতার পর গত একান্ন বছরে জাতীয় বিমান সংস্থা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সসহ বিভিন্ন বেসরকারি এয়ারলাইন্স চীনের বিভিন্ন প্রদেশে ফ্লাইট পরিচালনার পরিকল্পনা নিয়েছে। কিন্তু বাস্তব সত্য ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সই বাংলাদেশি প্রথম কোনো বিমান সংস্থা হিসেবে ২০১৮ সালের ২৬ এপ্রিল থেকে চীনের গুয়াংজুতে ফ্লাইট পরিচালনা করছে। অন্য এয়ারলাইন্সগুলো যেখানে এখনো স্বপ্ন দেখেছে চীনে ফ্লাইট পরিচালনার সেখানে ইউএস-বাংলা গত প্রায় পাঁচ বছর যাবৎ অবিরাম ফ্লাইট পরিচালনা করছে।

দেশের একটি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক রোগী চিকিৎসাসেবা নেওয়ার জন্য ভারতের চেন্নাই ভ্রমণ করে থাকে। বাংলাদেশ থেকে কোনো দেশি কিংবা ভারতীয় কোনো বিমান সংস্থা ঢাকা অথবা চট্টগ্রাম থেকে সরাসরি চেন্নাইতে ইতঃপূর্বে ফ্লাইট পরিচালনা করেনি। ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সই একমাত্র বিমান সংস্থা, যারা প্রায় চার বছরের অধিক সময় চেন্নাই সরাসরি ফ্লাইট পরিচালনা করছে। ফলে চেন্নাইতে চিকিৎসাসেবা নেওয়ার জন্য যারা যাচ্ছেন তাদের সময় ও অর্থ দুটোই সাশ্রয় হচ্ছে। 

দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম গন্তব্য মালদ্বীপের রাজধানী মালের সৌন্দর্য উপভোগের জন্য ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স সরাসরি ফ্লাইট পরিচালনা শুরু করেছে। যার ফলে ভারত মহাসাগরের নীলাভ সৌন্দর্য দর্শনে পর্যটকরা ঢাকা থেকে মালে ভ্রমণ করছে। বিভিন্ন ধরনের প্যাকেজ সুবিধা নিয়ে মালদ্বীপের আকর্ষণীয় দ্বীপগুলোতে ভ্রমণ করছে। 

বিদেশ থেকে আগমনি যাত্রীদের লাগেজ ডেলিভারি পেতে দীর্ঘসময় পর্যন্ত এক বিভীষিকাময় ইতিহাস ছিল বিমানবন্দরে। ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স আন্তর্জাতিক রুটের যাত্রীদের কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিল ফ্লাইট অবতরণের ১৫ মিনিটের মধ্যে প্রথম লাগেজ বেল্টে আসবে। যাত্রীরা লাগেজের জন্য অপেক্ষা করবে না, লাগেজ যাত্রীর জন্য অপেক্ষা করবে। যা আজ অবধি একই ধারাবাহিকতা রয়েছে। ইউএস-বাংলার পথ অনুসরণ করে অন্যান্য এয়ারলাইন্সও এখন স্বল্পতম সময়ে লাগেজ ডেলিভারি দেওয়ার চেষ্টা করছে।

ধন-সম্পদ থাকলেই যেমন লক্ষ্যে পৌঁছানো যায় না, তেমনি অনেক মেধাবী শিক্ষার্থীও পর্যাপ্ত মেধা থাকা সত্ত্বেও সুযোগের অভাবে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারে না। ওড়ার ইচ্ছে অনেকের আছে কিন্তু উড়তে পারছে ক’জন? শৈশবকালে বাচ্চাদের যদি জিজ্ঞেস করা হয়, বড় হয়ে তুমি কি হতে চাও? কয়েকটি কমন উত্তরের মধ্যে উল্লেখযোগ্য তিনটি হচ্ছে- কেউ ডাক্তার, কেউ ইঞ্জিনিয়ার আবার কেউ পাইলট হতে চায়। মেধাবী হলেই সরকারের শিক্ষানীতির কারণে ডাক্তার কিংবা ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার পথটা কিছুটা সুগম হয়। কিন্তু পাইলট? মেধাবী হলেই হয়ে ওঠে না। সাথে প্রয়োজন অর্থ-বিত্তের। পর্যাপ্ত অর্থ-বিত্ত না থাকার কারণে অনেক মেধাবীর পাইলট হওয়ার স্বপ্ন, দুঃস্বপ্ন হয়েই থেকে যায়।  

সামাজিক দায়বদ্ধতার অংশ হিসেবে নানাবিধ কাজ ছাড়াও দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে দক্ষ জনশক্তি তৈরিতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে ইউএস-বাংলা। ক্রমবর্ধমান চাহিদার বিপরীতে পাইলট সংকটে পতিত হচ্ছে বিশ্বের প্রায় সব বিমান সংস্থা। আর এই সংকট থেকে উত্তরণের জন্য ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স পরিকল্পনামাফিক মেধাবী শিক্ষার্থীদের মধ্য থেকে পাইলট তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে। পাইলট তৈরির পাশাপাশি ক্যাডেট ইঞ্জিনিয়ার প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করছে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স।

সময়ের পরিক্রমায় ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স এগিয়ে যাচ্ছে আপন গতিতে ও স্বমহিমায়। দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর করে তুলছে। যাত্রীসেবায় অনন্য নজির স্থাপন করে বাংলাদেশি যাত্রীদের কাছে আস্থার প্রতীক হয়ে উঠছে। ব্যতিক্রমধর্মী সেবা অন্য এয়ারলাইন্স থেকে ইউএস-বাংলাকে এগিয়ে রাখছে। ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা আর বাস্তবায়নকে সাথে নিয়ে দেশের পতাকাকে সমুন্নত রেখে অগ্রসর হচ্ছে ইউএস-বাংলা। দেশের শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের পাশাপাশি এশিয়ার অন্যতম সেরা এয়ারলাইন্সের মুকুট অর্জনই ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের ভবিষ্যৎ স্বপ্ন। 

লেখক : মহাব্যবস্থাপক-জনসংযোগ, ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স