সাশ্রয়ী ও ভোগান্তি কম, তাই আকাশপথের অভ্যন্তরীণ রুটে মানুষের আগ্রহ বেড়েছে

বহু বছরের বঞ্চনা, জনম জনমের প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে স্বাধীনতার দূত শুনিয়েছিলেন মুক্তির গান। ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম’। মুক্তির সেই মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে পুনর্জন্ম হয়েছে একটি জাতির। রক্তবন্যা পেরিয়ে ধ্বংসস্তূপ থেকে শুরু হওয়া শাপমুক্তি পথের বাঁকে বাঁকে ছিল ষড়যন্ত্র আর চক্রান্ত। কিন্তু মুক্তিপাগল বাঙালিকে থামানো যায়নি, অমঙ্গলের বিষদাঁত ভেঙে ঘুরে দাঁড়িয়েছে নতুন সূর্য হাতে, ছড়িয়েছে নতুন আলো বিশ্বভুবনে। জীবনমান, অর্থনীতি, অবকাঠামোসহ বহু খাতে পেছনে ফেলেছে প্রতিবেশীদের। ঢাকা পোস্টের ধারাবাহিক উন্নয়নের গল্পগাথায় আজ থাকছে এভিয়েশন খাতের সার্বিক চিত্র…

আশির দশকে দেশের অভ্যন্তরীণ রুটে ফ্লাইট পরিচালনা করত শুধুমাত্র বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স। শুরুতে আকাশপথের টিকিটের দামও ছিল সাধারণের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে। তবে নব্বইয়ের দশকের পর এ চিত্র দ্রুত পাল্টে যেতে থাকে। ওই সময় কয়েকটি বেসরকারি এয়ারলাইন্স অভ্যন্তরীণ রুটে ফ্লাইট পরিচালনা শুরু করে। প্রতিযোগিতামূলক বাজারে কমতে থাকে টিকিটের দামও। আকাশপথে টিকিটের দাম নাগালের মধ্যে আসায় বাড়তে থাকে যাত্রীর সংখ্যা। ফলে অভ্যন্তরীণ রুটের ফ্লাইটের টিকিট পাওয়া এখন সোনার হরিণে পরিণত হয়েছে।

প্রতিটি ঈদযাত্রায় জীবনবাজি রেখে এভাবে ঘরে ফেরেন মানুষ

বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) তথ্য অনুযায়ী, ২০১০-১১ সালে ৫০ হাজার থেকে দেড় লাখ যাত্রী আকাশপথে যাতায়াত করতেন। ২০২১ সালে এ সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২০ লাখে। আকাশপথে অভ্যন্তরীণ রুটে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স, ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স ও নভোএয়ার ফ্লাইট পরিচালনা করছে।

২০১০-১১ সালে ৫০ হাজার থেকে দেড় লাখ যাত্রী আকাশপথে যাতায়াত করতেন। ২০২১ সালে এ সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২০ লাখে। আকাশপথে অভ্যন্তরীণ রুটে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স, ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স ও নভোএয়ার ফ্লাইট পরিচালনা করছে

বেসরকারি এয়ারলাইন্সগুলো বলছে, একসময় সবার ধারণা ছিল আকাশপথে ভাড়া অনেক বেশি। তবে বেসরকারি এয়ারলাইন্সগুলোর ব্যবসা শুরুর পর সেই ধারণা বদলে যায়। এয়ারলাইন্সগুলো ফ্লাইটের ভাড়া একটি উন্নতমানের বাসের কাছাকাছি নির্ধারণ করে। সময় বাঁচাতে এখন অধিকাংশ যাত্রী আকাশপথে ঝুঁকছেন। বর্তমানে এয়ারলাইন্সগুলো বিভিন্ন রুটে প্রতিদিন ঢাকা থেকে প্রায় ৫০টি ফ্লাইট পরিচালনা করছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ফ্লাইট ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বর্তমানে আকাশপথ এতটা জনপ্রিয় যে প্রতি বছর ঈদের ২-১ মাস আগ থেকেই শেষ হয়ে যায় অভ্যন্তরীণ ফ্লাইটের টিকিট। এছাড়া আগে অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট শুধুমাত্র ঢাকাকেন্দ্রিক ছিল। তবে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স প্রথমবারের মতো চট্টগ্রাম থেকে সিলেট রুটে অভ্যন্তরীণ ফ্লাইটও চালু করেছে।

ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স করোনাকালীন এবং এর পরের সময়ে স্বাস্থ্যবিধি ও বেবিচকের সব নির্দেশনা মেনে ফ্লাইট পরিচালনা করছে। যাত্রীদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। অভ্যন্তরীণ রুটে আমরা অনেক যাত্রী পাচ্ছি। দিনদিন এ রুটে ফ্লাইট সংখ্যাও বাড়ছে

মো. কামরুল ইসলাম, মহাব্যবস্থাপক (জনসংযোগ), ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স

অভ্যন্তরীণ রুটে যাত্রীদের আগ্রহের বিষয়ে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের মহাব্যবস্থাপক (জনসংযোগ) মো. কামরুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স করোনাকালীন এবং এর পরের সময়ে স্বাস্থ্যবিধি ও বেবিচকের সব নির্দেশনা মেনে ফ্লাইট পরিচালনা করছে। যাত্রীদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। অভ্যন্তরীণ রুটে আমরা অনেক যাত্রী পাচ্ছি। দিনদিন এ রুটে ফ্লাইট সংখ্যাও বাড়ছে।

 যাত্রীদের আরও বেশি সেবা দিতে ইউএস-বাংলার বহরে যুক্ত হচ্ছে এটিআর ৭২-৬০০ এর মতো অত্যাধুনিক এয়ারক্রাফট

এদিকে, অধিকসংখ্যক যাত্রীর চাহিদা মেটাতে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স তার বহরে যোগ করেছে একটি ব্র্যান্ড নিউ এটিআর ৭২-৬০০ এয়ারক্রাফট। নতুন যুক্ত হওয়া এয়ারক্রাফটটি পরিবেশবান্ধব ও অত্যাধুনিক সুযোগ-সুবিধা সমৃদ্ধ। যাত্রীরা এতে স্বাচ্ছন্দ্যে ও আরামে ভ্রমণ করতে পারবেন। সংস্থাটি জানায়, নতুন নতুন এয়ারক্রাফট সংযোজনের মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ বিমান পরিবহনকে আরও শক্তিশালী নেটওয়ার্কের আওতায় নিয়ে আসার পরিকল্পনা রয়েছে তাদের।

৫০ বছরে এসেছে অনেক বেসরকারি এয়ারলাইন্স

স্বাধীনতার পর অনেক এয়ারলাইন্সকে ফ্লাইট চলাচলের লাইসেন্স দিয়ে দেশে প্রতিযোগিতামূলক বাজার সৃষ্টি করে বেবিচক। এর মধ্যে ১৯৯৩ সালে এয়ার পারাবত, ১৯৯৭ সালে জিএমজি এয়ারলাইন্স, ২০০০ সালে এয়ার বাংলা, ২০০৭ সালে ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ ও বেস্ট এয়ার, ২০০৮ সালে রয়েল বেঙ্গল এয়ারলাইন্স, ২০১০ সালে রিজেন্ট এয়ারওয়েজ, ২০১৩ সালে নভোএয়ার, ২০১৪ সালে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স ফ্লাইট পরিচালনা শুরু করে। তবে নানা প্রতিকূলতার কারণে বর্তমানে কেবলমাত্র ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স ও নভোএয়ার তাদের ফ্লাইট চালু রেখেছে। সাময়িকভাবে ফ্লাইট বন্ধ রেখেছে রিজেন্ট এয়ারওয়েজ। ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছে বাকির।

বাংলাদেশের মতো ছোট রাষ্ট্রে এতগুলো বেসরকারি এয়ারলাইন্স থাকা নিঃসন্দেহে বড় অর্জন। তবে এগুলো টিকে থাকলে দক্ষিণ এশিয়ায় ফ্লাইট পরিচালনায় এগিয়ে থাকত বাংলাদেশ

খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশের মতো ছোট রাষ্ট্রে এতগুলো বেসরকারি এয়ারলাইন্স থাকা নিঃসন্দেহে বড় অর্জন। তবে এগুলো টিকে থাকলে দক্ষিণ এশিয়ায় ফ্লাইট পরিচালনায় এগিয়ে থাকত বাংলাদেশ।

স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করে পরিচালিত হচ্ছে বিমানের অভ্যন্তরীণ রুটের সকল ফ্লাইট

বর্তমানে টিকে থাকা এয়ারলাইন্সগুলো বলছে, বাংলাদেশে জিএমজি এয়ারলাইন্স, ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ ও রিজেন্ট আন্তর্জাতিকভাবে ফ্লাইট পরিচালনার জন্য স্বীকৃতি পায়। তারা খুব ভালোভাবেই ব্যবসা করছিল। তবে ব্যবসায়িক কৌশল ও পরিকল্পনায় ভুল থাকায় বড় লোকসানে পড়ে তারা। বন্ধ হওয়া অন্য এয়ারলাইন্সগুলোর কারণও একই। তবে বেসরকারি এয়ারলাইন্সগুলোকে টিকিয়ে রাখতে বেবিচকের ভূমিকা আরও জোরদার করা উচিত।

একটি বেসরকারি এয়ারলাইন্সের দায়িত্বশীল কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে ঢাকা পোস্টকে বলেন, এয়ারলাইন্সকে ফ্লাইট পরিচালনার দায়িত্ব দেয় বেবিচক। তার ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে সব ধরনের সহযোগিতা করার দায়িত্বও তাদের। আমরা অনেকক্ষেত্রেই দেখি অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের অ্যারোনটিক্যাল চার্জ বেশি। ২৫ বছর ধরে বাংলাদেশে চলা বেসরকারি এয়ারলাইন্সগুলোর জন্য আলাদা হ্যাংগার সুবিধা নেই বিমানবন্দরে। এছাড়া জেট পেট্রোলের দামও অন্যান্য দেশের চেয়ে বেশি। তাই যাত্রীবান্ধব বেসরকারি এয়ারলাইন্সকে টিকিয়ে রাখতে বেবিচকের দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।

আমরা সবসময় এয়ারলাইন্সগুলো টিকিয়ে রাখতে সময়োপযোগী প্রণোদনা দেই। করোনাকালেও আমরা প্রণোদনা দিয়েছি। নির্দিষ্ট কয়েক মাসের অ্যারোনটিক্যাল ও নন-অ্যারোনটিক্যাল চার্জ মওকুফ করা হয়েছে।

এম. মফিদুর রহমান, চেয়ারম্যান, বেবিচক

এ বিষয়ে বেবিচক চেয়ারম্যান এম. মফিদুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা সবসময় এয়ারলাইন্সগুলো টিকিয়ে রাখতে সময়োপযোগী প্রণোদনা দেই। করোনাকালেও আমরা প্রণোদনা দিয়েছি। নির্দিষ্ট কয়েক মাসের অ্যারোনটিক্যাল ও নন-অ্যারোনটিক্যাল চার্জ মওকুফ করা হয়েছে।

সাধ্যের মধ্যে থাকায় বিয়ে করতেও এখন ভাড়া নেওয়া হচ্ছে হেলিকপ্টার

জনপ্রিয় হচ্ছে হেলিকপ্টার সার্ভিস

বিমানে নিজ গন্তব্যে যাওয়ার পাশাপাশি হেলিকপ্টারে চড়ার প্রবণতা বেড়েছে বাংলাদেশিদের মধ্যে। বর্তমানে দেশে শিকদার গ্রুপের আর অ্যান্ড আর এভিয়েশন, ইম্প্রেস এভিয়েশন, উইনাক্স এভিয়েশন, পারটেক্স এভিয়েশনসহ বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান হেলিকপ্টার সার্ভিস দিচ্ছে।

প্রতিষ্ঠানগুলো জানিয়েছে, গত কয়েক বছর ধরে ঘোরাঘুরি ও গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানে যোগদানের জন্য ঢাকায় হেলিকপ্টারের ব্যবহার বেড়েছে।

এআর/এসকেডি/এমএআর/এমএমজে