একটি উড়োজাহাজের উড্ডয়নের পর থেকে নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছানোর আগ পর্যন্ত পাইলটকে বেশ কয়েকটি ধাপ পেরোতে হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও সংবেদনশীল হচ্ছে অবতরণ (ল্যান্ডিং)। এ সময় পাইলট এক মুহূর্তের জন্য মনোযোগ হারালেই ঘটতে পারে বড় দুর্ঘটনা।

ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বিমানগুলো যখন অবতরণের প্রস্তুতি নেয় তখন পাইলটদের চোখে লেজার রশ্মি পড়ছে বলে সম্প্রতি অভিযোগ উঠেছে। হঠাৎ লেজারের আলো পড়ায় পাইলটদের বিভিন্ন সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। এ নিয়ে বিরক্ত পাইলটরা বলছেন, লেজার রশ্মির কারণে ল্যান্ডিংয়ের সময় বারবার চোখ বন্ধ করতে বাধ্য হচ্ছেন তারা।

ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বিমানগুলো যখন অবতরণের প্রস্তুতি নেয় তখন পাইলটদের চোখে লেজার রশ্মি ফেলা হচ্ছে। এতে তাদের অসুবিধায় পড়তে হচ্ছে। এ নিয়ে বিরক্ত পাইলটরা বলছেন, লেজার রশ্মির কারণে ল্যান্ডিংয়ের সময় বারবার চোখ বন্ধ করতে বাধ্য হচ্ছেন তারা

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বিমান বন্দরের আশপাশের বাসিন্দাদের অনেকে মজার ছলে রাতের আকাশে উড়ন্ত প্লেনের দিকে লেজার রশ্মি নিক্ষেপ করেন। এছাড়া ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের হাতে থাকা লেজার লাইটের রশ্মিও অসাবধানতাবশত গিয়ে লাগে পাইলটের চোখে।

এদিকে দিনের বেলা ল্যান্ডিংয়ের সময় বিমানবন্দরের পাশে ল্যান্ডিং জোনে প্রায়ই দেখা যায় ঘুড়ি ওড়ানোর দৃশ্য। এটিও পাইলটদের মনোযোগে বিঘ্ন সৃষ্টি করে।

২০১৯ সালের জুন মাসে লেজার নিয়ে একটি কড়া নির্দেশনা দেয় বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক)। ওই নির্দেশনায় বলা হয়, ‘দেশের বিমানবন্দরগুলোতে প্লেন ওঠা-নামার সময় টার্গেট করে প্লেনের সামনে লেজার বিম প্রদর্শনের ঘটনা ঘটছে। এটি সিভিল এভিয়েশন অ্যাক্ট-২০১৭ অনুযায়ী একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। পাইলটের দিকে এভাবে লেজার প্রদর্শন প্লেন নিয়ন্ত্রণে সমস্যা করে, যা ফ্লাইটকে অনিরাপদ করে। তাই একটি ফ্লাইট যাতে নিরাপদে উড্ডয়ন ও অবতরণ করতে পারে সেজন্য সবাইকে লেজার বিম ছোড়া থেকে বিরত থাকতে বলা হচ্ছে।’

সম্প্রতি ঢাকা পোস্টের ক্যামেরায় ধরা পড়ে বিমানে ফোকাস লাইট ও লেজার রশ্মি ফেলার দৃশ্য। অবতরণের সময় ঢাকার রাস্তায় ট্রাফিক পুলিশের হাতে থাকা লেজার লাইটের ঝলকানিও চোখে পড়ে।

জানতে চাইলে বাংলাদেশে ১৩ বছর ধরে ফ্লাইট পরিচালনা করা একটি বেসরকারি এয়ারলাইন্সের একজন পাইলট বলেন, ‘পাইলটের জন্য সবচেয়ে সংবেদনশীল মুহূর্ত হচ্ছে প্লেন উড্ডয়ন, অবতরণ ও জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলা। এ সময়গুলোতে আমাদের বুঝে-শুনে চোখের পলক ফেলতে হয়। এক সেকেন্ডের জন্য মনোযোগ হারালেও দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। লেজার লাইট ও ফোকাস লাইটের সমস্যা বিমানবন্দরে দীর্ঘদিন ধরে দেখা যাচ্ছে। এসব লাইট অটো মুভ করতে থাকে। ল্যান্ডিংয়ের সময় দুই-একবার আমাদের চোখেও লাগে। এতে এক সেকেন্ডের জন্য হলেও আমাদের মনোযোগ নষ্ট হয়। এ বিষয়ে বারবার কর্তৃপক্ষকে বলা হচ্ছে। কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে একটি আদেশ দিলেও বিষয়টি কোনোভাবেই থামছে না।’

আরেকটি বেসরকারি এয়ারলাইন্সের পাইলট ঢাকা পোস্টকে বলেন, পাইলটের চোখে সরাসরি লেজার পড়লে তার মনোযোগে বিচ্যুতি ঘটে। ফ্লাইংয়ের সবচেয়ে ক্রিটিক্যাল টাইম হচ্ছে ল্যান্ডিং। ল্যান্ডিংয়ের সময় যদি তাকে অন্যমনস্ক করা হয়, তিনি ভুল করতে পারেন। এতে ক্র্যাশও হতে পারে। অনেকগুলো জীবনহানির কারণ হতে পারে।

গতকাল (১১ আগস্ট) থেকে ঢাকার মোবাইল গ্রাহকদের এ বিষয়ে সচেতনতামূলক এসএমএস পাঠাচ্ছে সরকার। গভ. ইনফো থেকে পাঠানো এসএমএসে বলা হচ্ছে, ‘আকাশে উড্ডয়নরত বিমানকে লক্ষ্য করে লেজার রশ্মি নিক্ষেপ না করার জন্য অনুরোধ করা হলো। এটি বিমানের নিরাপত্তার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ এবং বিপজ্জনক।’

কোন এলাকা থেকে বেশি মারা হয় লেজার

পাইলট ও এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলার বিভাগের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সাধারণত (অস্বাভাবিক পরিস্থিতি না থাকলে) ঢাকায় অবতরণ করা বিমানগুলো টঙ্গি-কোনাবাড়ি-উত্তরা এবং বাইপাইল-আশুলিয়া-উত্তরা হয়ে বিমানবন্দরে নামে। উড্ডয়নের সময় নিকুঞ্জ-গুলশান-বাড্ডার ওপর দিয়ে বিভিন্ন গন্তব্যে যায়। অধিকাংশ সময় টঙ্গি ও নিকুঞ্জে লেজার বা লাইট বিম দেখা যায়। অনেক সময় ইচ্ছাকৃতভাবে লেজার বিমানের দিকে মারা হয়। আবার লেজার বিমের অটো মুভমেন্টও পাইলটের চোখে লাগে।

হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের পরিচালক ক্যাপ্টেন তৌহিদ-উল আহসান ঢাকা পোস্টকে জানান, রাতে সাধারণত এ ধরনের ঘটনা বেশি ঘটে থাকে। উত্তরা ও বাউনিয়া থেকে এসব লেজার লাইট বেশি মারা হয়। আমরা বিভিন্ন স্পট নির্দিষ্ট করেছি। সেসব এলাকার পুলিশের সঙ্গে কথা বলেছি। ওয়ার্ডভিত্তিক নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করা হয়েছে। এ ধরনের ঘটনা দেখলেই আমরা সংশ্লিষ্ট থানাকে জানাই। তবে কাউকেই হাতেনাতে ধরা যায় না।

তিনি আরও বলেন, ব্যবস্থা নেওয়ার পাশাপাশি আমরা বিমানবন্দরের আশপাশের এলাকায় মাইকিং করিয়েছি। এলাকার লোকজনকে লেজার লাইটের ভয়াবহতা সম্পর্কে অবহিত করছি। উত্তরা এলাকার ক্যাবল অপারেটরদের মাধ্যমেও সচেতনতামূলক স্ক্রল দেওয়া হচ্ছে।

বেবিচক চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল এম. মফিদুর রহমান বলেন, দীর্ঘদিন আগেই এটা বন্ধে ব্যবস্থা নিতে সার্কুলার জারি করা হয়েছিল। সংশ্লিষ্টরা এটা বন্ধে কাজ করছেন।

ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থানা পুলিশ জানায়, হাতেনাতে ধরা যায় না বলে এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত কাউকে গ্রেফতার করা যায়নি।

বিমানবন্দর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) বি এম ফরমান আলী ঢাকা পোস্টকে বলেন, বিমানবন্দরের ল্যান্ডিং জোনের আশপাশে যাতে কেউ লেজার লাইট নিক্ষেপ না করেন এবং দিনের বেলায় ঘুড়ি না ওড়ান সেজন্য আমরা সবসময় সচেষ্ট থাকি। আমাদের একটি টিম আশপাশের লোকজনকে সচেতন করতে কাজ করে। এছাড়া এসব এলাকার ট্রাফিক পুলিশের ব্যবহৃত লেজার লাইট যাতে অসাবধানতাবশত ওপরের দিকে তাক না করা হয় সে বিষয়েও আমরা সচেতন করছি।

এআর/এসএসএইচ/এনএফ/জেএস