২০২২-২০২৩ অর্থবছরের জন্য ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকার প্রস্তাবিত বাজেট পেশ করা হয়েছে। প্রস্তাবিত বাজেটের মূল প্রতিপাদ্য– ‘কোভিডের অভিঘাত পেরিয়ে উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় প্রত্যাবর্তন’। প্রস্তাবিত বাজেটের আকার চলতি ২০২১-২০২২ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের তুলনায় ৭৪ হাজার ৩৮৩ কোটি টাকা বেশি। আর সংশোধিত বাজেটের তুলনায় ৮৪ হাজার ৫৬৪ কোটি টাকা বেশি। প্রস্তাবিত বাজেট নিয়ে নানা মহলে চলছে আলোচনা-সমালোচনা। 

৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকার প্রস্তাবিত বাজেট নিয়ে কী ভাবছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা— তা তুলে ধরেছেন ঢাকা পোস্টের বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবেদক মাহমুদ তানজীদ

১৩তম ব্যাচের শিক্ষার্থী মাহমুদুল হাসান তামিম

প্রস্তাবিত বাজেট বিশ্লেষণ করলে দেখতে পাই, বেশ কিছু ইতিবাচক খাতে বাজেট বরাদ্দের পরিমাণ বেড়েছে। যেমন সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে। অপরদিকে স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ ১৪ দশমিক ২২ শতাংশ করা হয়েছে। এ খাতে বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে, বিষয়টি ইতিবাচক। রপ্তানিমুখী প্রতিষ্ঠানের করপোরেট কর কমানো হয়েছে। এর ফলে রপ্তানিতে ইতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।

পাশাপাশি ব্যাংকে ৫ কোটি টাকার বেশি জমার ওপর আবগারি শুল্ক বাড়ানো হয়েছে। সরকারের এ উদ্যোগটি প্রশংসনীয়। কারণ এতে ধনীদের  ওপর অতিরিক্ত কর আরোপ করা হবে। বাজেটের যেসব সিদ্ধান্ত নেতিবাচক মনে হয়, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে পরিচালন ব্যয় বিপুল পরিমাণে বৃদ্ধি করা হয়েছে, যা জিডিপির ৮ দশমিক ৪ শতাংশ। এ খাতে ব্যয় কমিয়ে, উন্নয়ন খাতে ব্যয় বৃদ্ধি করলে দেশে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পেত।

এছাড়া মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সুনির্দিষ্ট কোনো কর্মপরিকল্পনা বাজেটে না থাকায়, ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমে যাওয়ার প্রভাব পড়বে সাধারণ মানুষের ওপর। দেশের জন্য অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি খাত হলো আইসিটি। এ খাতে অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করা হয়েছে, যা নতুন উদ্যোক্তাদের চাপের মধ্যে ফেলবে। যারা ইতোমধ্যে ব্যবসা করছে তাদের নতুন উদ্যোগ গ্রহণ এবং বাস্তবায়ন করতে নিরুৎসাহিত করবে। সর্বোপরি আমার কাছে মনে হয় বিশ্বব্যাপী মুদ্রাস্ফীতি বৃদ্ধির এ সময়ে সরকারের জন্য এ বাজেট বাস্তবায়ন করা অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং হবে।

১৫তম ব্যাচের শিক্ষার্থী নাজিমুন আক্তার সুমাইয়া

এবারের প্রস্তাবিত বাজেটে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ভর্তুকি ও প্রণোদনাসহ কয়েকটি খাতে বরাদ্দ  বাড়ানো হয়েছে, যা যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত। তবে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের থাবা মোকাবিলায় এ বাজেট কতটুকু সফল হবে, তা নিয়ে সংশয় আছে। আশা করা হচ্ছে, এ বাজেট কোভিড-ক্ষতিগ্রস্ত এবং রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধে বাধাগ্রস্ত অর্থনীতির পুনরুদ্ধারে যথেষ্ট ভূমিকা রাখবে। যুদ্ধ বন্ধ হয়ে গেলে হয়তো এ আশা বাস্তব রূপ লাভ করবে। তবে,রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ শীঘ্রই বন্ধ হবে কি না এবং যদি বন্ধ না হয় তবে আমাদের কর্মপরিকল্পনা কতটা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে তার ওপর লক্ষ্য রাখতে হবে।

ইতোমধ্যে জ্বালানি তেলের সরবরাহ সংকটের প্রভাব বাংলাদেশেও পড়েছে। এছাড়া, বাংলাদের গম আমদানির অন্যতম উৎস ইউক্রেন হওয়ায় আমাদের আমদানি খরচ বেড়ে গেছে এবং গম থেকে উৎপাদিত সকল পণ্যের দাম বেড়েছে। অন্যদিকে, যুদ্ধ চলতে থাকলে বাংলাদেশের রপ্তানি আয় আরও কমে যাবে। কারণ বাংলাদেশের রপ্তানির বিরাট একটি অংশ আসে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশ থেকে। ফলে আমরা বেশি মাত্রায় মূল্যস্ফীতির মুখোমুখি হব।

মূল্যস্ফীতির আরও একটি সূচক ফরেন এক্সচেঞ্জ রিজার্ভ। ফরেন এক্সচেঞ্জ রেট বাড়ায় ইতোমধ্যেই যার পরিমাণ বাংলাদেশে লক্ষণীয়ভাবে কমেছে। এ ফরেন এক্সচেঞ্জ রিজার্ভ নিয়ন্ত্রণের জন্য বর্তমান বাজেটে সরকার ‘পাচার করা টাকা’ বৈধতার সুযোগ দিচ্ছে, যা  মধ্যবিত্তদের ওপর করারোপের বিষয়ের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এতে নিয়মিত করদাতারা কর প্রদানে নিরুৎসাহিত হতে পারেন এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) নির্ধারিত আয় অর্জনে ব্যর্থ হবে। ফলে বাজেট ঘাটতি বেড়ে যাবে।আমদানিকৃত পণ্যের দাম বৃদ্ধি করে দেশজ পণ্যের দাম কমিয়ে জনগণকে দেশীয় পণ্য ব্যবহারে আকৃষ্ট করার চেষ্টা করা হয়েছে এ বাজেটে।

সরকার বিদ্যমান সংকট কাটাতে বিদ্যমান চাহিদার প্রবৃদ্ধি কমিয়ে সরবরাহ বাড়ানোকে একটি কৌশল হিসেবে নিয়েছে। এতে দেশীয় ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানগুলো লাভবান হবে। পাশাপাশি স্টার্টআপ নেওয়া ব্যবসায়ীরাও পাচ্ছেন সুবর্ণ সুযোগ। অর্থাৎ এবারের বাজেট ভর্তুকি ও প্রণোদনার মাধ্যমে কিছুটা নিম্নবিত্ত শ্রেণিবান্ধব, বিরাটভাবে ব্যবসায়ীবান্ধব হলেও মধ্যবিত্তরা হয়েছেন উপেক্ষিত। তাদের জন্য বিশেষ কোনো বরাদ্দের ব্যবস্থা তো নেই। মূল্যস্ফীতির এ দুঃসময়েও বাড়ানো হয়নি করমুক্ত আয়ের সীমা।

১২তম ব্যাচের শিক্ষার্থী মোহাম্মদ ফয়সাল

বাংলাদেশের অর্থনীতি বর্তমানে বেশ অস্থিতিশীল সময় পার করছে। বৈশ্বিক অর্থনীতির নানা অস্থিরতা বাংলাদেশকে ক্রমশ গ্রাস করছে। লাগামহীনভাবে বেড়েই চলেছে মুদ্রাস্ফীতি, ক্রমাগত ডলারের বিপরীতে টাকার দরপতন ঘটছে, প্রতিনিয়ত চাপ বাড়ছে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে এবং কোনোভাবেই জীবনযাত্রার ক্রমবর্ধমান ব্যয়কে নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। এরকম একটি প্রেক্ষাপটে জাতীয় সংসদে ঘোষিত হল ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট। প্রতিবারের মতো এবারেও বাজেট নিয়ে ছিল বেশ কিছু প্রত্যাশা। সর্বস্তরের মানুষের আকাঙ্ক্ষা ছিল, এ বাজেটে ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধার এবং মুদ্রাস্ফীতির লাগাম টেনে ধরার জন্য বেশ কিছু নির্দেশনা থাকবে। কিন্তু গত ৯ জুন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল কর্তৃক জাতীয় সংসদে প্রস্তাবিত বাজেটে মুদ্রাস্ফীতি মোকাবিলায় তেমন উল্লেখযোগ্য কোনো দিকনির্দেশনা চোখে না পড়লেও ব্যবসাবান্ধব বেশ কিছু পদক্ষেপ দেখা গেছে।

স্থানীয় শিল্পকে উৎসাহিত করতে এবং ফরেন রিজার্ভের ওপর চাপ কমাতে বৈদেশিক বিলাসবহুল দ্রব্য ওপর কর আরোপ করা হয়েছে, উৎপাদকের কাঁচামাল সরবরাহের ওপর উৎসে কর ৭ শতাংশ থেকে ৪ শতাংশ এবং ব্যবসায়িক পণ্যের সরবরাহে উৎসে কর ৭ শতাংশের পরিবর্তে ৫ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে। পাশাপাশি করপোরেট কর ২ দশমিক ৫ শতাংশ হারে কমানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, যার ফলে বিনিয়োগ উৎসাহিত হবে এবং কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পাবে।

এ বাজেটের অন্যতম সুখবর হচ্ছে বহুল কাঙ্ক্ষিত সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালুর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে এবং এর ফলে সরকারি চাকরিজীবীদের বাইরেও দেশের সাধারণ জনগণকে পেনশন ব্যবস্থার আওতায় আনা হচ্ছে। তাছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে পশুখাদ্যের মূল্য অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে, যার প্রভাব পড়েছে মাছ, মাংস, ডিম ও দুধের বাজারে। এ অর্থবছরের বাজেটে পশুখাদ্য আমদানির ওপর কর অব্যাহতি দেওয়ার প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী, যার ফলে এসব বাজারে দ্রব্যমূল্য হ্রাস পাবে এবং সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে আসবে।

এ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট বেশ কিছু কারণে বেশ সমালোচনার সৃষ্টি করেছে। যেমন দেশের উচ্চ মূল্যস্ফীতির এ সময়ে করমুক্ত আয়ের সীমা অপরিবর্তিত রাখার সিদ্ধান্তটি বেশ সমালোচিত হয়েছে। তাছাড়া উক্ত বাজেটে বিদেশে পাচারকৃত অর্থ বিনা প্রশ্নে বৈধ করার সুযোগ নানা মহলে বিতর্কের সৃষ্টি করেছে। অর্থনীতিবিদদের মতে, এ সুযোগের মাধ্যমে অর্থ পাচারকারীদের সুরক্ষা দেওয়া হবে এবং এক অর্থে পুরস্কৃত করা হবে। অথচ যারা বৈধ উপার্জন করছে তাদেরকে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। সবকিছুকে ছাপিয়ে মুদ্রাস্ফীতি কমানোর মাধ্যমে কীভাবে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি করা যায়, বাজেট অধিবেশনে সেটাই প্রধান আলোচ্য বিষয় হওয়া উচিত।

এমটি/আরএইচ