বঙ্গবন্ধুর অবমাননা ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতির ঘটনায় চাকরিচ্যুত হয়েও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক ভবনে বিএনপিপন্থি সাদা দলের সাবেক আহ্বায়ক অধ্যাপক মোর্শেদ হাসান খানের বসবাস নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

তবে মোর্শেদ হাসান খানের দাবি, চাকরি থেকে অব্যাহতি পেলেও তার বিষয়টি আদালতে আইনি লড়াই প্রক্রিয়াধীন। আদালত যে সিদ্ধান্ত দেবে সেটা তিনি মেনে নেবেন।

এদিকে অধ্যাপক মোর্শেদ হাসান খানকে অবিলম্বে বাসা থেকে উচ্ছেদের দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ। গত বৃহস্পতিবার (২৩ জুন) এক বিবৃতিতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে ২৪ ঘণ্টার সময় বেঁধে দিয়েও দাবি বাস্তবায়ন না হওয়ায় ‘কঠোর’ কর্মসূচির হুঁশিয়ারি দিয়েছে সংগঠনটি।

২০২০ সালের ৯ সেপ্টেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের অধ্যাপক মোর্শেদ হাসান খানকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেট। পরে তিনি আদালতের দ্বারস্থ হন এবং তাকে চাকরি থেকে অপসারণের আদেশ কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করে হাইকোর্ট। পরে এনিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আইনি লড়াইয়ে গেলে বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।

এদিকে চাকরি থেকে অব্যাহতির পর বেতন-ভাতাসহ সব ধরনের সুযোগ সুবিধা বন্ধ হলেও অধ্যাপক মোর্শেদ বিশ্ববিদ্যালয়ের উত্তর ফুলার রোডের ৩৭ নম্বর আবাসিক ভবনের দ্বিতীয় তলায় ২৮০০ বর্গফুটের বাসায় বাস করছেন।

গত ১৯ জুন বিএনপিপন্থি শিক্ষকনেতা অধ্যাপক ড. এবিএম ওবায়দুল ইসলামের আমন্ত্রণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাবে যান বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। সেখানেও মোর্শেদ হাসানকে দেখা যায়। ক্লাবে গভীর রাত পর্যন্ত তাদের অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে, ‘প্রকৃত ঘটনা’ জানতে ক্লাবের পক্ষ থেকে একটি তথ্যানুসন্ধান কমিটি করা হয়েছে।

একটি জাতীয় দৈনিকের স্বাধীনতা দিবস সংখ্যায় তার লেখা ‘জ্যোতির্ময় জিয়া’ শিরোনামে এক নিবন্ধে বঙ্গবন্ধুর অবমাননা, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্পর্কে ঔদ্ধত্যপূর্ণ বক্তব্যের অভিযোগ আনে ছাত্রলীগ

মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের সাধারণ সম্পাদক আল মামুন বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধকে কটূক্তির অপরাধে চাকুরিচ্যুত শিক্ষক ও বিএনপি নেতা মোর্শেদ হাসান খান অবৈধভাবে এখনো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক ভবনের বাসায় বসবাস করছেন যা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন পরিপন্থি। অবিলম্বে তার বাসা বরাদ্দ বাতিল করতে হবে। এখনও পর্যন্ত কেন মোর্শেদ হাসান খানকে বাসা থেকে বের করা হয়নি তার জবাব বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে দিতে হবে।’

মোর্শেদ হাসান খানের বাসা বিএনপির ‘অঘোষিত কার্যালয়ে’ পরিণতি হয়েছে দাবি করে আল মামুন বলেন, ‘প্রতিদিন সন্ধ্যার পর সেখানে বিএনপি ও ছাত্রদলের নেতাকর্মীদের আনাগোনা হয়, গোপন বৈঠক হয়। আমরা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে বৃহস্পতিবার ২৪ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দিয়েছিলাম। আমাদের দাবির বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এখন কোনো সাড়া দেয়নি। আমরা শিগগিরই কঠোর কর্মসূচি ঘোষণা করব।’

এবিষয়ে জানতে চাইলে অধ্যাপক মোর্শেদ হাসান খান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমাকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়ার বিষয়টি নিয়ে মামলা চলছে। তাই আমি এ বিষয়ে ব্যাখ্যা করতে পারব না। আদালত যা বলবে আমি তাই করব।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক ভবনে শিক্ষকদের বাসা বরাদ্দ দিয়ে থাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের এস্টেট কার্যালয়। এস্টেট কার্যালয়ে বাসা বরাদ্দ কমিটির প্রধান হলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক মমতাজ উদ্দিন আহমেদ।

তিনি বলেন, চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়ার পর উনি বাসায় থাকতে পারবেন কি না, এই বিষয়ে কোনো কাগজপত্র এস্টেট অফিসে পাঠানো হয়নি। স্ব-উদ্যোগে তো এস্টেট অফিস কারও বাসা বরাদ্দ বাতিল করতে পারে না।

‘উনি চাকরিচ্যুত হয়েছেন, এ বিষয়ে অ্যাকাউন্টসে কাগজে এসেছে, যেহেতু উনি চাকরিচ্যুত উনার বেতন বন্ধ হয়েছে। উনার কাগজ গেছে বিজনেস ফ্যাকাল্টির ডিন অফিসে, বিভাগের চেয়ারম্যানের কাছে। উনি যে চাকরিচ্যুত হলেন ওই কাগজের একটা কপি এস্টেট অফিসে আসা উচিত ছিল। সেটা আসেনি।’

এবিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. আখতারুজ্জামান ঢাকা পোস্টকে বলেন, সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্তের কাগজপত্র বিভিন্ন জায়গায় যাওয়ার কথা। এস্টেট অফিস নাকি পায়নি। এস্টেটকে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

চাকরিচ্যুত হয়ে বাসায় থাকতে পারেন কি না জানতে চাইলে অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান বলেন, ‘চাকরি না থাকলে বাসায় থাকবে কেন! নিয়ম অনুসরণ করে নোটিশ দিয়ে বাসা ক্যান্সেল করতে হয়। সেটা আরও আগেই নিশ্চিত করা উচিত ছিল। এস্টেট না জানার কারণে সেটি হয়নি। দ্রুত ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে।’

২০১৮ সালের ২৬ মার্চ একটি জাতীয় দৈনিকের স্বাধীনতা দিবস সংখ্যায় তার লেখা ‘জ্যোতির্ময় জিয়া’ শিরোনামে এক নিবন্ধে বঙ্গবন্ধুর অবমাননা, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্পর্কে ঔদ্ধত্যপূর্ণ বক্তব্যের অভিযোগ আনে ছাত্রলীগ।

এ ঘটনায় তাকে বরখাস্ত করার দাবিতে আন্দোলনের পাশাপাশি উপাচার্যের কাছে স্মারকলিপি দেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতিও ওই লেখার নিন্দা ও প্রতিবাদ জানায়।

উদ্ভূতপরিস্থিতিতে ওই বছরের ২ এপ্রিল বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ মোর্শেদ হাসান খানকে বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাডেমিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রম থেকে সাময়িকভাবে অব্যাহতি দিয়ে উপ-উপাচার্য মুহাম্মদ সামাদকে আহ্বায়ক করে পাঁচ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে।

তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের পর শাস্তি সুপারিশ করতে প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনাল করে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট। ট্রাইব্যুনালের সুপারিশ অনুযায়ী ২০২০ সালের ৯ সেপ্টেম্বর সিন্ডিকেটের সভায় মোর্শেদ হাসানকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতার চাকরি থেকে স্থায়ীভাবে অব্যাহতির সিদ্ধান্ত হয়।

এইচআর/এসএম