১৯২১ সালের ১ জুলাই যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যাত্রা শুরু করে সেসময় বিশ্ববিদ্যালয়ে মোট শিক্ষার্থী ছিলেন ৮৪৭ জন, যাদের মধ্যে ছাত্রী ছিলেন একজন। তবে নারী শিক্ষক ছিলেন না একজনও। ১৯৩৫ সালে প্রথম নারী শিক্ষক পায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। সেসময় বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে সহকারী লেকচারার হিসেবে যোগ দেন করুণাকণা গুপ্ত।

বর্তমানে রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারণী বিষয় থেকে খেলাধুলা, সামরিক বাহিনী থেকে বিমানচালনা— সব ক্ষেত্রেই নারীর অংশগ্রহণ বাড়ছে। বাংলাদেশের অগ্রগতির ধারাবাহিকতায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বছরের পর বছর ধরে নারীদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পেয়েছে। ছাত্রী ও নারী শিক্ষকের সংখ্যা পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। সংখ্যার দিক দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নারীরা এগিয়েছেন। তবে নেতৃত্বের জায়গায় নারীরা এখনও পিছিয়ে আছেন।

২০১৯ সালে অনুষ্ঠিত সর্বশেষ সমাবর্তনের সময় প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট শিক্ষার্থী সংখ্যা ৪৩ হাজার ৩৯৬ জন। এর মধ্যে ছাত্রী সংখ্যা ১৩ হাজার ১৯৫ জন। মোট ১৯৯২ জন শিক্ষকের মধ্যে এখন নারী শিক্ষকের সংখ্যা ৬৬৮ জন। গত দুই বছরে এই সংখ্যা আরও বেড়েছে বলে জানিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।

নারী শিক্ষকদের অংশগ্রহণ বাড়লেও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও সর্বোচ্চ ফোরামগুলোতে নেতৃত্বে বেশ পিছিয়ে আছেন নারীরা। বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, উপ-উপাচার্য, রেজিস্ট্রার, কোষাধ্যক্ষ, ডিন পদে নেই কোনো নারী। বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০০ বছরের ইতিহাসেও নেই কোনো নারী উপাচার্য, উপ-উপাচার্য ছিলেন দুজন এবং ডিন ছিলেন পাঁচ জন নারী। প্রশাসনিক পদে উপরে ওঠার সিঁড়ি খ্যাত শিক্ষক সমিতিতেও নারীদের সংখ্যা হাতেগোনা। বর্তমানে শীর্ষ পাঁচ পদের মধ্যে আছেন একজন নারী শিক্ষক।

নারী শিক্ষকরা বলছেন, সংখ্যা বাড়লেও নারীদের নেতৃত্ব নিয়ে অসামঞ্জস্যতা রয়েছে। সংখ্যা বাড়াটা যেমন ইতিবাচক, তেমনি নেতৃত্বে সংকটও হতাশাজনক। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের মূল নেতৃত্বে আসার পথটা নারীদের জন্য সহজ নয়। এক্ষেত্রে শিক্ষক রাজনীতিকে বড় একটি ফ্যাক্টর বলে মনে করছেন নারীরা।  তারা বলছেন, রাজনীতিতে পুরুষদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে উঠে আসা অনেক চ্যালেঞ্জিং। এখনও পর্যন্ত দেশে নারীবান্ধব সামাজিক প্রেক্ষাপট তৈরি না হওয়াকেও দায়ী করছেন নারী শিক্ষকরা।

উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. সোমা দে ঢাকা পোস্টকে বলেন, আগের বছরগুলোর তুলনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নারী শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীর সংখ্যা অনেকাংশে বেড়েছে। বর্তমানে বেশকিছু ডিপার্টমেন্টের চেয়ারম্যান নারী। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আমাদের নারী শিক্ষকদের বেশকিছু অর্জনও রয়েছে। এসব কিছুই ইতিবাচক, তবে এর মধ্যেও কিছু অসমতা চোখে পড়ে। সব অনুষদে এখনও পর্যন্ত ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা এবং নারী-পুরুষ শিক্ষকের সংখ্যায় অসমতা রয়ে গেছে।

তিনি বলেন, করোনার সময় অনেক শিক্ষার্থীকে বাবা-মা জোর করে বিয়ে দিয়েছেন। অনেকে বাধ্য হয়ে সন্তান গ্রহণ করছেন। যার ফলে শিক্ষাজীবন শেষ করতে এক ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছেন। আমাদের পারিবারিক-সামাজিক মনোভাব এখনও সমতার পর্যায়ে পৌঁছেনি। তাদের এগিয়ে যেতে হলে অনেক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়। নারী শিক্ষকদের ক্ষেত্রেও কিছু ক্ষেত্রে গ্যাপ থেকে যায়, যা ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও পূরণ করা সম্ভব হয় না। নেতৃত্বের ক্ষেত্রে সবকিছু সামলে নিয়ে আবার রাজনীতি করাও অনেক সময় নিশ্চিত করা যায় না। এছাড়া নারীদের অর্জনের চেয়ে পুরুষের অর্জনকে আমরা বেশি দেখি। আমাদের সামাজিক মনোভাবটাই এমন। তার একটি প্রতিফলন আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়েও রয়েছে।

ক্রিমিনোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক খন্দকার ফারজানা রহমান বলেন, নারী শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়ছে এটা যেমন ইতিবাচক, তেমনি নেতৃত্বের পর্যায়ে নারীদের না থাকাটাও কাম্য নয়। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের উচ্চতর পদগুলোতে কোনো নারী নেই, কোনো অনুষদের ডিন পদে নারী নেই। এছাড়া শিক্ষক সমিতিরও শীর্ষ পাঁচ জনের মধ্যে একজন মাত্র নারী। বাংলাদেশের শীর্ষ এই বিদ্যাপীঠের উচ্চতর প্রশাসনে নারীদের সংখ্যা একেবারেই কম, এটা আমাকে হতাশ করে।

তিনি বলেন, আমাদের নারী শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীদের নিজ নিজ ক্ষেত্রে ডেডিকেশন অনেক বেশি। আমাদের বিভাগের পাঁচটি বর্ষেই প্রথম হচ্ছে মেয়ে। পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় আমরা আছি, এটা অস্বীকার করার কিছু নেই। সে জায়গা থেকে আমাদের সবসময় প্রমাণ করতে হয় আমি যোগ্য। পুরুষের চেয়ে নারীদের বেশি পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হয়, প্রতিবন্ধকতায় পড়তে হয়।

সংখ্যা বাড়লেও নারীদের নেতৃত্বে আসার পথ সহজ নয় বলে মনে করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বশেষ নারী ডিন অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিম। তিনি বলেন, সংখ্যা বাড়তে পারে, তবে নারীদের নেতৃত্বে আসা খুব কঠিন। শিক্ষক রাজনীতি করেই নারীদের নেতৃত্বে আসতে হয়। যে ধরনের পুরুষতান্ত্রিক পদ্ধতিতে রাজনীতি হয়, সে রাজনীতির মধ্যে নারীদের টিকে থাকা খুব কঠিন। অনেক সময় নারীরাও নারীদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যায়। ১০০ বছরের পুরোনো এই বিশ্ববিদ্যালয়ে নারী নেতৃত্ব উঠে আসা অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং। তবে প্রশাসনিক পদগুলোতে সরকার সিদ্ধান্ত নেয় এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সেহেতু আমি মনে করি প্রশাসনিক পর্যায়ে নারী নেতৃত্ব নিয়ে আসা তেমন কঠিন নয়, প্রয়োজন তাদের সদিচ্ছা।

তবে যোগ্যতা থাকলে পদগুলোতে নারীরা আসতে পারবেন এবং আগামীতে এই সংখ্যা বাড়বে বলে মন্তব্য করেছেন বিশ্ববিদ্যালয় সর্বশেষ নারী উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক ড. নাসরীন আহমাদ।

ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, নারীরা এতকাল পিছিয়ে ছিল, তাদের সংখ্যাও কম ছিল। কিন্তু বর্তমানে ভর্তি পরীক্ষার দিকে তাকালে দেখা যায় ছাত্র-ছাত্রী প্রায় সমান সমান। তারা ফলাফলেও এগিয়ে থাকায় শিক্ষক নিয়োগে নারীরা কোনো অংশে কম নয়। তবে নেতৃত্বে আসার ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের চেয়ে যোগ্যতা বেশি দেখা হয়। যেমন ডিন নির্বাচনে একটি অনুষদের বেশ কয়েকটি বিভাগ আছে, সেখান থেকে সর্বোচ্চ যোগ্যতা সম্পন্ন এবং জনপ্রিয় শিক্ষককে মনোনয়ন দিতে হয়। যার জিতে আসার সম্ভাবনা বেশি তাকেই মনোনয়ন দেওয়া হয়।

তিনি আরও বলেন, বর্তমানে শিক্ষক রাজনীতির সঙ্গে সঙ্গে লবিংয়ের একটি বিষয় আছে, যা আগে ছিল না। কোনো একটি পদে নিয়োগ দেওয়ার সময় অনেক বেশি দৌড়াদৌড়ি করতে দেখা যায়। যোগ্যতার পাশাপাশি এই বিষয়টিও এখন মুখ্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্তমানে নারীদের অগ্রযাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে। আশা করছি, আগামীতে আমরা আরও বেশি নারী নেতৃত্ব বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখতে পাব।

জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক ড. এএসএম মাকসুদ কামাল বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নারী শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। গত দুই বছরে বিশ্ববিদ্যালয়ে ৬০-৬৫ শতাংশ নারী শিক্ষক নিয়োগ পেয়েছেন। সর্বমোট প্রায় ৪০ শতাংশ নারী শিক্ষক রয়েছেন। আমরা লক্ষ্য করছি, বিভিন্ন বিভাগ ও ইনস্টিটিউটে নারী শিক্ষার্থীরা ফলাফলে ভালো করছেন এবং বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় কন্ট্রিবিউশন করছেন।

তিনি বলেন, সে হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ও নারীদের নানা সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টারপ্ল্যানেও তাদের জন্য পরিকল্পনা রয়েছে। বাংলাদেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে নারীরা সব ক্ষেত্রেই এগিয়ে যাচ্ছে। নারীদের এই অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকলে বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে।

উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ সামাদ বলেন, নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধির জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার উদ্যোগ অব্যাহত রেখেছেন। প্রশাসন, বিচার বিভাগ, বিভিন্ন সরকারি বাহিনীসহ সব ক্ষেত্রেই নারীরা এগিয়ে যাচ্ছে। শিক্ষা খাতেও নারীদের অংশগ্রহণ আশাব্যঞ্জক। যাদের আগ্রহ এবং যোগ্যতা-দক্ষতা আছে তারা নেতৃত্বেই আসছে এবং তাদের আসা উচিত।

এইচআর/এসএসএইচ