ছবি : সংগৃহীত

আজ পহেলা জুলাই। আমার জন্য খুবই বিশেষ দিন। আমার জীবনে যাদের বিশাল অবদান তাদের মধ্যে দুইজনের জন্মদিন আজ। একটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আর অন্যজন আমার বড় কন্যা বিয়াংকা।

আজ আমি যা, তা হতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যেমন অবদান আছে, তেমনি আছে আমার বড় কন্যার অবদান। তবে এখানে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়েই লিখব। শুভ জন্মদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

আজকে কেবল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্মদিনই না, জন্মশতবার্ষিকীও। এইরকম এক ঐতিহাসিক মাহেন্দ্র ক্ষণে দাঁড়িয়ে আমাদের উচিত পেছন ফিরে দেখা। বলা উচিত কি হওয়ার কথা ছিল তার কতটা পূরণ হয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে যেহেতু শতবর্ষ পার হয়েছে তার সাফল্য কিছু থাকবেই। কিন্তু যতটা সফল হওয়ার কথা ততটা সফল কি হয়েছে? নাকি আমরা তাকে বনসাই বানিয়ে রেখেছি? বলার সময় সবাই ‘ঢাবিয়ান’ বলে গর্বিত হয়। গর্বের সাথে যে দায়িত্ব থাকে সেটা কি পরিচয় দেওয়ার সময় মনে থাকে?

একটা বিশ্ববিদ্যালয় ভালো মানের হওয়ার পেছনের চালকের আসনে থাকবেন শিক্ষকেরা, আর তাদের প্রভাবে তৈরি হয় ভালো ছাত্র। যেকোনো প্রতিষ্ঠান ভালো হতে হলে সময়ের সাথে বিবর্তিত হতে হয়।

ইন্ডাস্ট্রিয়াল প্রোডাক্টের বিবর্তন ছাড়া কোনো ইন্ডাস্ট্রিও টিকে থাকতে পারে না। সেই জন্যই প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট সেকশন থাকে। সেখানে গবেষণার মাধ্যমে নতুন নতুন ভার্সন আবিষ্কারের মাধ্যমে প্রোডাক্টগুলো আরও ভালো এবং আরও আকর্ষণীয় করা হয়। এই পরিবর্তন বা বিবর্তনই হলো টিকে থাকার সবচেয়ে বড় পদ্ধতি।

১০০ বছরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কতটা পরিবর্তিত হয়েছে? মোটা দাগে বলা যায়, একদম না। আজকের শিক্ষক নিয়োগের বিজ্ঞাপন আর ১০০ বছর আগের শিক্ষক নিয়োগের বিজ্ঞাপন দেখলেই বোঝা যায় শিক্ষক নিয়োগে আমরা একদম বদলায়নি।

বিশ্বের অনেক কলেজের এমনকি বাংলাদেশের কলেজের শিক্ষক নিয়োগের বিজ্ঞাপনের সাথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞাপনের তেমন কোনো পার্থক্য নেই। 

প্রতিবছরই নতুন বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে, পুরাতন বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন বিভাগ ও ইন্সটিটিউট খোলা হচ্ছে, নতুন নতুন শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীর সংখ্যা বাড়ছে, জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে। কিন্তু এর সাথে পাল্লা দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেট বরাদ্দ বাড়ছে না।

শুধুই কি শিক্ষক নিয়োগ? পরীক্ষার প্রশ্নপত্র প্রণয়নে, উত্তরপত্র মূল্যায়নেও তেমন পরিবর্তন আসেনি। শ্রেণিকক্ষে পাঠদানে তেমন পরিবর্তন আসেনি। অথচ এই ১০০ বছরে বিশ্বের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ পদ্ধতিতে আমূল পরিবর্তন এসেছে। 

বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশ্ব র‍্যাঙ্কিং-এ ১ থেকে ৪০০-তে থাকা সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মকানুন দেখলেই বোঝা যাবে শিক্ষক নিয়োগের অনেকগুলো ধাপ। প্রতিটি ধাপে স্ক্রুনিটি বা ফিল্টার হয়।

শিক্ষাগত যোগ্যতায় পরিবর্তন এসেছে। এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে সহকারী অধ্যাপক হতে হলে ন্যূনতম পিএইচডি তো অবশ্যই লাগে তার সাথে কয়েক বছরের পোস্ট-ডক অভিজ্ঞতাও লাগে। তাছাড়া আবেদনের সময় ন্যূনতম ৩ জন শিক্ষক/গবেষকের সুপারিশ পত্র, শিক্ষাদান ও গবেষণা পত্র ইত্যাদি দিতে হয়।

খোঁজ নিয়ে দেখুন, বিশ্ব র‍্যাঙ্কিং-এ ১ থেকে ৪০০-তে থাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থ বরাদ্দ কেমন, শিক্ষকদের বেতন কেমন, ছাত্রছাত্রীদের থাকা খাওয়ার পরিবেশ কেমন, গবেষণায় বরাদ্দ ও সুযোগ সুবিধা কেমন।

এক সময় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের চেয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের বেতন বেশি ছিল। আর আজ তাদের বেতন আমাদের চেয়ে দ্বিগুণের বেশি। আমাদের পরিবর্তন এসেছে কেবল সংখ্যা বৃদ্ধিতে।

আমাদের ছাত্র সংখ্যা বেড়েছে, বিভাগের সংখ্যা বেড়েছে, শিক্ষকের সংখ্যা বেড়েছে। কিন্তু মান বাড়েনি। এ যেন অল্প চিনি দিয়ে ১০ গ্লাস শরবত বানানোর মতো। কিন্তু আমরা যদি চিনি না বাড়িয়ে অতিথির সংখ্যা বাড়ায়, কেবল পানি মিশিয়ে শরবত বানায় তাতে কি শরবতের মান ঠিক থাকবে? আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মানও তেমনি তরলীকৃত করা হয়েছে।    

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এমন একটি প্রতিষ্ঠান, যেটি দেশের ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধে অনন্য ভূমিকা রেখেছে। পৃথিবীতে এমন আরেকটি একটি বিশ্ববিদ্যালয় খুঁজে পাওয়া যাবে না। অথচ সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা পৃথিবীতে সবচেয়ে মানবেতর জীবনযাপন করে।

একটি দেশের সরকার ও জনগণ কত অকৃতজ্ঞ হলে এমন হতে পারে? ধারণা করা হয়েছিল, দেশ স্বাধীন হলে এটি হবে বিশ্বে অনন্য একটি বিশ্ববিদ্যালয়। রাষ্ট্র তাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে একে বড় থেকে আরও বড় হতে যা করা দরকার তার সবকিছুই করবে। অথচ যা ঘটেছে বা ঘটছে তা ঠিক তার উল্টো।

বড় হতে তো দিচ্ছিই না বরং একে বনসাই বানিয়ে রাখার সকল আয়োজন সব সরকার বেশ সাফল্যের সাথে করেছে। প্রতিবছরই নতুন বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে, পুরাতন বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন বিভাগ ও ইন্সটিটিউট খোলা হচ্ছে, নতুন নতুন শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীর সংখ্যা বাড়ছে, জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে। কিন্তু এর সাথে পাল্লা দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেট বরাদ্দ বাড়ছে না। 

সুন্দর, সভ্য এবং পরিচ্ছন্ন দেশ গড়ার মানুষ তৈরির কারখানা হলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশের সেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর নেতৃত্ব দেয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। বাংলাদেশ ভালো থাকবে যদি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ভালো মানের হয়।

একটি বিশ্ববিদ্যালয় কত ভালো তার একটা প্রধানতম ইনডেক্স হলো এর বরাদ্দ কত তা দিয়ে। যেমন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বরাদ্দ আমাদের বাংলাদেশের মোট রিজার্ভ যত তারচেয়ে বেশি অর্থাৎ ৫৩.২ বিলিয়ন ডলার, ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের বরাদ্দ হলো প্রায় ৪২ বিলিয়ন ডলার, এমআইটির বরাদ্দ হলো ২৭.৪ বিলিয়ন ডলার, ৭ বিলিয়ন ইউকে পাউন্ড, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বরাদ্দ হলো ৫ বিলিয়ন পাউন্ড প্রায়।

আমেরিকার লিবারেল আর্টস কলেজগুলো ছোট হয় যেখানে শুধু আন্ডারগ্র্যাজুয়েট পড়ানো হয়। সেই কলেজগুলোর মধ্যে ১ নম্বর কলেজ হলো উইলিয়ামস কলেজ যার বরাদ্দ হলো ৪.১৭ বিলিয়ন ডলার। আমার কন্যা বিয়াংকা যেই কলেজে যাচ্ছে সেই ডেভিডসন কলেজের বরাদ্দ হলো ১.৩৪ বিলিয়ন ডলার।  

এইসব বরাদ্দ আসে সাধারণত মানুষের অনুদান এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের উপার্জন থেকে। অনুদানের মূল উৎস হলো অ্যালামনাই। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র এবং সমাজের ধনীরা বিশ্ববিদ্যালয়কে অকাতরে দান করে। কারণ একটি শহরের বিশ্ববিদ্যালয় যত ভালো মানের হবে সেই শহরের জীবন মান তত ভালো এবং সুন্দর হবে।

একটি ভালো মানের বিশ্ববিদ্যালয় মানে সেখানে বড় বড় গবেষক, শিক্ষক এবং শিখতে চাওয়া একটি বিশাল জনগোষ্ঠীর বাস সেখানে। এর প্রভাব শহর তথা দেশের মধ্যে পড়ে। আমাদের অ্যালামনাইদের কি তাদের নিজ নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে বড় অংকের দানের কোনো সংস্কৃতি আছে?

আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যালামনাইদের একটা সমিতি আছে। তারা বছরে একটা করে বিশাল মিটিং করে খাওয়াদাওয়া, আনন্দ-ফূর্তি করে চলে যান। তারা নীলক্ষেতে একটি গেট করেছেন। যেন একটি গেট করাই আমাদের বিশাল অগ্রাধিকার।

এই অ্যালামনাইদের মাঝে বিশাল বিশাল ধনী ব্যবসায়ীসহ সমাজের নানা শ্রেণির অধ্যাপকও আছেন। তারা এই ক্লাব ব্যবহার করেন তাদের ব্যবসাকে প্রসারিত করে কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে দান করতে চান না।

হার্ভার্ড এমআইটিতে একেকটি অ্যালামনাইদের বাৎসরিক মিটিং থেকে শত শত মিলিয়ন ডলার অনুদান আসে। এছাড়া সারা বছর জুড়ে তো অনুদান আসেই। আজ যদি দেশের অবস্থা সম্পন্ন মানুষেরা বিশ্ববিদ্যালয়কে দান করতেন, অ্যালামনাইরা দান করতেন আর সরকার যথেষ্ট বরাদ্দ দিত তাহলেই কেবল প্রশাসনের উপর বিশ্ববিদ্যালয়কে বিশ্বমানের করার একটা চাপ তৈরি হতো। 

একটি দেশ সুন্দর, সভ্য এবং পরিচ্ছন্ন হয় তার মানুষ দ্বারা। সুন্দর, সভ্য এবং পরিচ্ছন্ন দেশ গড়ার মানুষ তৈরির কারখানা হলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশের সেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর নেতৃত্ব দেয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। বাংলাদেশ ভালো থাকবে যদি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ভালো মানের হয়।

আমেরিকা বিশ্বে এত ক্ষমতাবান হয়েছে এমআইটি, হার্ভার্ড, স্ট্যানফোর্ড, ইয়েল প্রভৃতি বিশ্বসেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের কারণে। ইংল্যান্ড দ্বিতীয় ক্ষমতাধর হয়েছে কারণ সেখানে আছে কেমব্রিজ, অক্সফোর্ড, ইউসিএল, ইম্পেরিয়াল কলেজের মতো বিশ্বসেরা প্রতিষ্ঠান।

এমন ছোট একটি দেশ সিঙ্গাপুরকে সবাই এত সমীহ করে কারণ সেখানে আছে সিঙ্গাপুর ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির মতো বিশ্ববিদ্যালয়। চীন এত দ্রুত ক্ষমতাবান হচ্ছে কারণ সেখানকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দ্রুত বিশ্বসেরাদের কাতারে যাচ্ছে। আরও প্রমাণ লাগবে? এরপরও যদি সরকার না বোঝে তাহলে বলার কিছুই নেই।

ড. কামরুল হাসান মামুন ।। অধ্যাপক, পদার্থবিজ্ঞান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়