শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) লোকপ্রশাসন বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী বুলবুল আহমেদ গত সোমবার (২৫ জুলাই) ক্যাম্পাসে ছুরিকাঘাতে নিহত হন। এ সময় ঘটনাস্থলে একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে বুলবুলের বান্ধবীই তার সঙ্গে ছিলেন বলে জানায় পুলিশ।

বুলবুলের বান্ধবীর ভাষ্য অনুযায়ী পুলিশ জানায়, তিনজন ছিনতাইকারী ওই সময়ে তাদের ধরলে তাদের সঙ্গে বুলবুলের ধস্তাধস্তি হয়। একপর্যায়ে তারা বুলবুলকে ছুরি দিয়ে আঘাত করলে তিনি মাটিতে পড়েন। এরপর তিনি গিয়ে ওই টিলার কাছাকাছি থাকা লোকজনকে বিষয়টি জানালে তারা এসে বুলবুলকে মাটিতে পড়ে থাকতে দেখে। রক্তাক্ত অবস্থায় বুলবুলকে উদ্ধার করে মেডিকেল সেন্টারে নিয়ে যান তারা।

বুলবুল হত্যাকাণ্ডের পর তিনি শোকে বারবার মূর্ছা গেলে প্রথমে তাকে নগরীর মাউন্ট এডোরা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এর পরদিন দুপুরে হাসপাতাল থেকে তার সঙ্গে থাকা আত্মীয় ও সহপাঠীদের ওয়াশরুমে যাওয়ার কথা বলে কাউকে না বলে হাসপাতাল থেকে পালিয়ে যান।

আরও পড়ুন : ছিনতাই করতেই খুন করা হয় শাবি শিক্ষার্থীকে

হাসপাতালের সিসিটিভি ফুটেজ দেখে তার বের হয়ে আসার প্রমাণ পাওয়া যায়। এরপর পুলিশ প্রযুক্তি ব্যবহার করে ক্যাম্পাসে তার অবস্থান নিশ্চিত করে। এরপর তাকে ক্যাম্পাস থেকে উদ্ধার করে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অফিসে নিয়ে যাওয়া হয়।

এ ঘটনায় বুলবুলের বান্ধবীর কিছু আচরণ সন্দেহের জন্ম দিয়েছে বলে মনে করছে পুলিশ।

বুধবার (২৭ জুলাই) দুপুর ২টায় সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের জালালাবাদ থানায় এক সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন আজবাহার আলী শেখ।

এ ঘটনায় বান্ধবীর কোনো সম্পৃক্ততা থাকতে পারে কি না, সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের উপকমিশনার আজবাহার আলী শেখ বলেন, আমরা তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে প্রাথমিকভাবে এমন এখনো কোনো সম্পৃক্ততা বা সন্দেহজনক কিছু পাইনি। তবে তার আচরণ সন্দেহজনক হওয়ায় তদন্ত চলছে। কিছু পাওয়া গেলে পরবর্তীতে জানানো হবে।

আরও পড়ুন : শাবি শিক্ষার্থী বুলবুল হত্যায় ৩ জন গ্রেপ্তার

তবে পুলিশ বলছে, ছিনতাই করতে গিয়েই খুন করা হয় বুলবুল আহমেদকে। এ ঘটনার সঙ্গে আর কোনো ঘটনার সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়নি, এমনটাও জানিয়েছে পুলিশ।

আজবাহার আলী শেখ আরও বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে ওই টিলায় শিক্ষার্থীরা অবকাশ যাপনের জন্য সময় কাটাতে যায়। ঘটনার দিন সন্ধ্যায় বুলবুল ও তার বান্ধবীও বিশ্ববিদ্যালয়ের গাজিকালুর টিলায় ঘুরতে যান। তারা একটু বেশি নির্জন স্থানে চলে গেলে সেখানে আগে থেকে অবস্থান করা আবুল হোসেন ও মোহাম্মদ হাসান ছিনতাইয়ের উদ্দেশে বুলবুলকে জাপটে ধরেন। এ সময় কামরুল আহমদও এসে তাদের সঙ্গে যোগ দেন। ব্যাপক ধস্তাধস্তির এক পর্যায়ে ঘটনার অন্যতম হোতা কামরুল তার হাতে থাকা ছুরি দিয়ে বুলবুলকে উপর্যুপরি আঘাত করেন। উপর্যুপরি ছুরিকাঘাতে ব্যাপক রক্তক্ষরণ হলে তা দেখে ঘটনাস্থলে থাকা তিনজন তিন দিকে পালিয়ে যায়।

আরও পড়ুন : শাবি শিক্ষার্থী খুনে ব্যবহৃত চাকু ও মোবাইল উদ্ধার

তিনি আরও বলেন, ঘটনার পর প্রথমে আমরা আবুল হোসেনকে (১৮) গ্রেপ্তার করি। পরে তার স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে কামরুল আহমদ (২৯) ও মোহাম্মদ হাসানকে (১৯) গ্রেপ্তার করা হয়। এ সময় নিহত বুলবুলের মোবাইল ও হত্যায় ব্যবহার করা ছুরি কামরুল ইসলামের টিলাগাঁওয়ের বাড়ি থেকে বুধবার সকালে উদ্ধার করা হয়। বর্তমানে তারা জালালাবাদ থানায় পুলিশের হেফাজতে আছে। তাদের আদালতে হস্তান্তরের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।

তাদের সবার বাড়ি সিলেটের এয়ারপোর্ট থানার অন্তর্ভুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্শ্ববর্তী টিলারগাঁও এলাকায়। তারা সবাই পেশায় রাজমিস্ত্রি বলে জানায় পুলিশ।

গ্রেপ্তার তিনজন আগেও ছিনতাইয়ের সঙ্গে জড়িত ছিল কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে আজবাহার আলী শেখ বলেন, বিষয়টি তদন্তাধীন আছে। গ্রেপ্তারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদ করছি আমরা। জিজ্ঞাসাবাদের পরই জানতে পারব যে তারা আগে এমন ঘটনার সঙ্গে জড়িত ছিল কি না।

তারা মাদকাসক্ত ছিল কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা আদালতের অনুমতি পেলেই তাদের ডোপ টেস্টের জন্য পাঠাব। তারপর আমরা জানতে পারব যে তারা মাদকাসক্ত ছিল কি না।

এদিকে ক্যাম্পাসে সিসিটিভি ক্যামেরার সংখ্যা বাড়ানো, গার্ড সংখ্যা বাড়ানো, নিহতের পরিবারকে ক্ষতিপূরণসহ বিভিন্ন দাবি-দাওয়া তুলে ধরেন বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন, সাংস্কৃতিক সংগঠনসহ সাধারণ শিক্ষার্থীরা। তারা দফায় দফায় এসব দাবিতে ক্যাম্পাসে মিছিল এবং মানববন্ধন করেন।

আরও পড়ুন : শিক্ষার্থী খুনে জড়িতদের আইনের আওতায় আনা হবে : এসএমপি কমিশনার

বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে নিহত বুলবুলের পরিবারকে সব ধরনের সহায়তার আশ্বাস দেন উপাচার্য অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদ। পরবর্তীতে নিহতের পরিবারকে পাঁচ লাখ টাকার আর্থিক সহায়তা দেওয়ার আশ্বাস দেন তিনি। আগামী সপ্তাহে বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিল থেকে এই টাকা বুলবুলের পরিবারের কাছে পৌঁছে দেওয়া হবে বলেও জানান তিনি।

উল্লেখ্য, গত সোমবার (২৫ জুলাই) সন্ধ্যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে গাজীকালুর টিলার পাশে  বুলবুল আহমেদকে ছুরিকাঘাত করেন দুর্বৃত্তরা। পরে শিক্ষার্থীরা তাকে উদ্ধার করে প্রথমে বিশ্ববিদ্যালয়ে মেডিকেল সেন্টারে নেন। সেখান থেকে এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।

আরও পড়ুন : বুলবুল খুনের ঘটনায় জড়িত একজনের স্বীকারোক্তি

ওসমানী মেডিকেলে প্রথম জানাজার পর মঙ্গলবার (২৬ জুলাই) সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে অ্যাম্বুলেন্সে করে বুলবুলের মরদেহ নরসিংদীর সদর উপজেলার চিনিশপুরের নন্দীপাড়া গ্রামের বাড়িতে এসে পৌঁছায়।

মাগরিবের নামাজের পর ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক-সংলগ্ন ভেলানগরের মাইক্রোস্ট্যান্ডে দ্বিতীয় দফা জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় স্থানীয় পাঁচ শতাধিক মানুষ জানাজায় অংশ নেন। পরে তার বাবার কবরের পাশেই চিরনিদ্রায় শায়িত হন বুলবুল।

জুবায়েদুল হক রবিন/এনএ