চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) প্রধান ফটকে তালা লাগানো যেন নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। ট্রেনের শিডিউল বাড়ানো, সিএনজি চালক কর্তৃক শিক্ষার্থীকে মারধর, পূর্ণাঙ্গ কমিটি কিংবা ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলেও তালা লাগে প্রধান ফটকে। সঙ্গে রয়েছে শাটল ট্রেন বন্ধ করে দেওয়ার ঘটনা। এতে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন শিক্ষার্থীরা, ব্যাহত হচ্ছে প্রশাসনিক কার্যক্রম।

সর্বশেষ গতকাল সোমবার (১৯ সেপ্টেম্বর) পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই হঠাৎ করে অবরোধের ডাক দেয় শাখা ছাত্রলীগের পদবঞ্চিত নেতাকর্মীদের একাংশ। প্রধান ফটকে তালা লাগানো ছাড়াও ষোলশহর স্টেশনে শাটল ট্রেন আটকে দেয় আন্দোলনকারীরা। এদিকে ক্লাস-পরীক্ষায় অংশ নিতে আসা শিক্ষার্থীদের ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কোনো বাস ছেড়ে না যাওয়ায় আসতে পারেননি শিক্ষকরাও।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, আজ ১০টির বেশি বিভাগের ইয়ার ফাইনাল এবং সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষা ছিল। তবে অবরোধের জন্য বেশির ভাগ বিভাগ তাৎক্ষণিক বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে পরীক্ষা স্থগিতের ঘোষণা দেয়।

কিছু হলেই প্রধান ফটকে তালা লাগানোর এই মানসিকতার পরিবর্তন চান বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীরা। তাদের অভিযোগ, প্রধান ফটকে তালা লাগানোর জন্য শাখা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা দায়ী। নিজেদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ভোগান্তিতে ফেলা হয়। 

কয়েকজন সাধারণ শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলেন ঢাকা পোস্টের এই প্রতিবেদক। তারা বলেন, বেশির ভাগ সময় আচমকা আন্দোলন শুরু হয়। কী নিয়ে সেটাও ভালো করে জানা যায় না। শুধু তালা লাগানো আর শাটল ট্রেন বন্ধের খবর পাই। অথচ গুরুত্বপূর্ণ ক্লাস এবং পরীক্ষার জন্য ভুগতে হয় সবাইকে। ভয় আর শঙ্কার পরিবেশ তৈরি হয় ক্যাম্পাসে। একজনের বিষয় গোটা বিশ্ববিদ্যালয় অচলের ঘটনা আর কোথাও হয় কিনা সন্দেহ। এজন্য প্রশাসনের দায় কম নয়। ওনারা ঠিকমতো দেখভাল করলে একই ঘটনা বার বার ঘটতো না।

প্রধান ফটকে তালা দেওয়ার ঘটনা শুধু গতকালই নয়, এর আগেও একাধিকবার তালা লাগানোর ঘটনা ঘটেছে। চলতি বছরের ৯ মাসে অন্তত ১০ বারের বেশি তালা লাগানো হয়েছে চবির প্রধান ফটকে।

এ বছরের ২৭ ফেব্রুয়ারি দুপুর দেড়টায় শাটল ট্রেন সংকট এবং নিয়মিত শিডিউলে ট্রেন চালুর দাবিতে প্রধান ফটকে তালা দেন শিক্ষার্থীরা। ৫ মার্চ চবির ৫৩৭তম সিন্ডিকেট সভার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা থেকে
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকে তালা দিয়ে বিক্ষোভ করে শাখা ছাত্রলীগের উপ-গ্রুপ ভার্সিটি এক্সপ্রেস (ভিএক্স)।

২২ মার্চ সিএনজি চালকের সঙ্গে ভাড়া বিতর্কে মারধরের শিকার হন বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের এক শিক্ষার্থী। এ ঘটনার প্রতিবাদে বিশ্ববিদ্যালয়ের ফটকে তালা ও টায়ার জ্বালিয়ে প্রতিবাদ করে সাধারণ শিক্ষার্থীরা। তবে আন্দোলনকারীরা নিজেদের সাধারণ শিক্ষার্থী দাবি করলেও সবাই ছাত্রলীগের উপ-গ্রুপ সিক্সটি নাইনের কর্মী বলে জানা যায়।

একই ঘটনা ঘটে ১১ এপ্রিল। ভাড়া বিতর্কে তিন শিক্ষার্থীকে স্থানীয় সিএনজি চালকরা মারধর করেন। এই তিন শিক্ষার্থী শাখা ছাত্রলীগের বিজয় এবং সিএফসি গ্রুপের কর্মী হিসেবে পরিচিত। ঘটনার প্রতিবাদে প্রধান ফটকে তালা দিয়ে অবরোধ করে ছাত্রলীগের অনুসারীরা।

১৪ এপ্রিল বিকেল ৫টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক নম্বর রেলক্রসিং এলাকায় সমাজতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষার্থী আরাফাত হোসেনের সঙ্গে সিএনজি চালকের কথা কাটাকাটি হয়। এক পর্যায়ে আরাফাতকে মারধর করেন চালক। প্রতিবাদে প্রধান ফটকে তালা দেয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি রেজাউল হক রুবেলের অনুসারীরা। 

২৮ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী কফিল উদ্দিনের ওপর অতর্কিত হামলা চালায় ৫-৬ জন। হামলাকারীরা শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ইকবাল হোসেন টিপুর অনুসারী বলে জানা যায়। হামলার প্রতিবাদ ও বিচারের দাবিতে প্রধান ফটকে তালা দেয় কফিলের সহপাঠী ও আইন বিভাগের শিক্ষার্থীরা। 

১ আগস্ট পূর্ণাঙ্গ কমিটিকে অবৈধ উল্লেখ করে অনির্দিষ্টকালের জন্য অবরোধের ডাক দেয় শাখা ছাত্রলীগের বিজয় গ্রুপের একাংশ। এক দিনের বেশি সময় তাদের এই অবরোধ চলমান থাকে। পরে শিক্ষা উপমন্ত্রী ব্যারিস্টার মুহিবুল হাসান চৌধুরীর আশ্বাসে অবরোধ স্থগিত করে আন্দোলনকারীরা।

২১ আগস্ট সিএনজি চালক কর্তৃক সুমিত মণ্ডল নামে এক ছাত্রলীগ কর্মীকে মারধরের জের ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ফটকে তালা দেয় ছাত্রলীগের একাংশ। প্রায় আধ ঘণ্টা পরে প্রক্টরিয়াল বডির সদস্যরা উপস্থিত হলে তালা খুলে দেয়।

১১ সেপ্টেম্বর শাখা ছাত্রলীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটি বর্ধিত করে পদবঞ্চিদের মূল্যায়নের দাবিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকে তালা দিয়ে বিক্ষোভ করে শাখা ছাত্রলীগের একাংশ। 

এসব ঘটনায় প্রশাসনের দুর্বলতা আছে বলে মনে করেন সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট চবি শাখার সাধারণ সম্পাদক ঋজু লক্ষ্মী অবরোধ। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রতিবাদ হতে পারে কিন্তু অভ্যন্তরীণ বিষয়ে প্রধান ফটকে তালা লাগানোকে আমরা কখনো ঠিক মনে করি না। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের দায়িত্ব নেওয়ার বিষয় আছে। কিন্তু তারা এখানে ব্যালেন্স করে। অথচ আমরা বা অন্য সাধারণ শিক্ষার্থীর ব্যানারে স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে নামলে প্রশাসনের চাপ প্রয়োগ, হুমকি-ধমকিও দেওয়া হয়। অথচ ছাত্রলীগের ক্ষেত্রে নীরব প্রশাসন। 

কোনো অন্যায়কারীর পক্ষে ছাত্রলীগ কখনো নেই উল্লেখ করে শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি রেজাউল হক রুবেল ঢাকা পোস্টকে বলেন, যারা নিজেদের পদবঞ্চিত মনে করে কিংবা এসব নিয়ে তালা লাগায় এটা কখনো কাম্য নয়। অথচ এগুলো আলোচনা করে সমাধান করার বিষয়। আমাদের এবং তাদের অভিভাবক আছেন, কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ আছেন। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কেন নীরব? যারা এসব করে প্রশাসন তাদের আইনের আওতায় নিয়ে আসুক। বিশ্ববিদ্যালয় সচল রাখতে নিজেদের মতো পদক্ষেপ নেবেন বলে আমরা বিশ্বাস করি। সাধারণ শিক্ষার্থীরা ছাত্রলীগের ভোগান্তির শিকার হোক এটা কখনো কাম্য নয়।

চবি শিক্ষক সমিতি সাবেক সভাপতি ও আইন বিভাগের অধ্যাপক মো. জাকির হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, দুই দিন পর পর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটক তালা দেওয়া হয়। প্রথমত এটা তাদের কোনোভাবেই করা উচিত নয়। আর বঙ্গবন্ধুর ছাত্রলীগের রাজনীতি এমন ছিল না।

তিনি আরও বলেন, এসব ঘটনা থেকে উত্তোরণের জন্য প্রশাসনের দায়িত্ব রয়েছে। আমরা বার বার সমঝোতার কথা শুনে থাকি। কিন্তু বন্ধ তো হচ্ছে না। যেসব গ্রুপ বা যারা জড়িত, প্রয়োজনে শহরে তাদের নেতাদের সঙ্গে আলাপ করা হোক। এগুলোর জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বার্থ যেমন বিঘ্ন হচ্ছে, তেমনি সরকারের ইমেজেরও ক্ষতি হচ্ছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে হলেও উপাচার্য মহোদয়ের উচিত এগুলোর স্থায়ী সমাধান করা।

তবে পুনরায় প্রধান ফটকে তালা দিলে প্রশাসন কঠিন অবস্থানে যাবে বলে জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ড. রবিউল হাসান ভুঁইয়া। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, আজকের ঘটনায় আমরা সেখানে উপস্থিত হয়ে গেটের তালা খুলে দিয়েছি। আর প্রধান ফটকে তালা লাগানোর ঘটনা ঘটলে কঠিন ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হব আমরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ সুন্দর রাখতে যা প্রয়োজন আমরা তাই করব।

এসপি