ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শোক দিবস আজ। ১৯৮৫ সালের ১৫ অক্টোবর রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের তৎকালীন অনুদ্বৈপায়ন ভবনের টেলিভিশন কক্ষের ছাদ ধসে ৪০ জন মারা যান। নিহতদের মধ্যে ২৬ জন ছিলেন ছাত্র, ১৩ জন ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারী ও অতিথি। আহত হন শতাধিক। আহতদের অনেকেই পঙ্গু হয়ে যান চিরতরে। আজ সেই ট্র্যাজেডির ৩৭ বছর পূর্ণ হচ্ছে। 

এই দুর্ঘটনায় শোক প্রকাশ করেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি, কেন্দ্রীয় পনেরো ও সাতদলীয় ঐক্য জোটসহ অন্যান্য রাজনৈতিক নেতা। বিদেশি কূটনীতিকরাও শোক জানান। তিন দিন জাতীয় শোক ঘোষণা করে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রেখে ১৬ অক্টোবর সারাদেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়। এ ঘটনার পর থেকেই দিনটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শোক দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে।

১৯২১ সালে নির্মিত জগন্নাথ হলের ওই ভবনটি ভেঙে পড়ার আগে মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। কিন্তু সেখানে কোন সংস্কার না হওয়ায় এমন ঘটনা ঘটেছিল। ভবন ধসের পর পুরো ভবনটিই গুড়িয়ে দেওয়া হয়। পরে ওই একই জায়গায় 'অক্টোবর স্মৃতি ভবন' নামে জগন্নাথ হলের নতুন একটি ছাত্রাবাস তৈরি হয়। এ ছাড়া ভবনটির সামনে নিহতদের স্মরণে তাদের নাম সংবলিত একটি নামফলক স্থাপন করা হয়েছে।

তখন ছাত্র হিসেবে ওই হলেই অবস্থান করেছিলেন জগন্নাথ হলের বর্তমান প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. মিহির লাল সাহা। স্মৃতিচারণ করে ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, আমি তখন মাস্টার্সের ছাত্র। যেদিন ঘটনাটি ঘটল সেদিন মঙ্গলবার ছিল। জনপ্রিয় নাটক 'শুকতারা' দেখার জন্য সবাই আমরা উদগ্রীব থাকতাম। ঝুঁকি আছে জেনেও সবাই ওই টিভি রুমে জড়ো হয়েছিল। কারণ একটা মাত্র রঙ্গিন টিভি ছিল, আর সেটা ওই ভবনে। আমারও ইচ্ছে ছিল কিন্তু হঠাৎ মনে হলো কাল তো আমার পরীক্ষা। তাই নাটক না দেখে পড়তে গেলাম। পড়তে বসলাম একটু পরই বিকট শব্দ, বের হয়ে দেখি এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনা।

তিনি আরও বলেন, তারপর আমরা হলের সবাই নেমে আসলাম, ঢাকা শহরের সকল মানুষ এখানে চলে আসল। এটা একটা মনে রাখার মতো ঘটনা, যেটা আমরা ৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় দেখেছিলাম। জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকলেরই এখানে সাহায্যের হাত বাড়িয়েছিল। প্রচুর রক্তের দরকার ছিল, সকলে লাইন ধরে রক্ত দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। সবাইকে হাসপাতালে নেওয়া হয়েছিল। ওই দিনই ৩৫ জন মারা গিয়েছিল, পরে আরও ৫ জন। যারা নিহত হয়েছে তাদের গোবিন্দ চন্দ্র দেব ভবনের সামনে সারি বেঁধে রাখা হলো। এই দৃশ্যটা আমি কখনোই ভুলতে পারব না। ১৫ অক্টোবর আসলেই আমার মনে এই স্মৃতি ভেসে উঠে। আমরা অনেকদিন, অনেক রাত ঘুমাতে পারিনি। বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম আমরা সবাই।

এর পুনরাবৃত্তি আর না ঘটুক উল্লেখ করে অধ্যাপক মিহির লাল সাহা বলেন, শতবর্ষের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন ট্র্যাজেডি যেন আর না ঘটে সে বিষয়ে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। তৎকালীন সব হল সংস্কার করতে হবে, না হয় এমন দুর্ঘটনার সম্ভাবনা থেকে যাবে। এ বিষয়ে সবার সহযোগিতা প্রয়োজন, যাতে ভবিষ্যতে আর কোনো মায়ের বুক খালি না হয়। ওই দিন যারা নিহত হয়েছিল তাদের আমরা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি এবং তাদের আত্মার শান্তি কামনা করি।

শোক দিবসে ঢাবির কর্মসূচি 

প্রতিবারের ন্যায় এবারও নিহতদের স্মরণে সকাল ৬টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ভবন, সকল হল এবং হোস্টেলে কালো পতাকা উত্তোলনের মধ্য দিয়ে শোক দিবসের সূচনা হবে। এদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের পতাকা অর্ধনমিত থাকবে এবং সকলে কালো ব্যাজ ধারণ করবে। সকাল সাড়ে ৭টায় উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামানের নেতৃত্বে অপরাজেয় বাংলার পাদদেশ থেকে শোক র‍্যালির সহকারে জগন্নাথ হল স্মৃতিসৌধে গমন, পুষ্পস্তবক অর্পণ এবং নীরবতা পালন।

সকাল ৮টায় জগন্নাথ হল প্রশাসনের ব্যবস্থাপনায় অক্টোবর স্মৃতি ভবনস্থ টিভি কক্ষে আলোচনা সভা; ৯টা থেকে ১০টা পর্যন্ত জগন্নাথ হল প্রাঙ্গণে হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের প্রার্থনা সভা এবং বাদ আছর বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদ মসজিদুল জামিআ'সহ সকল হল মসজিদে নিহতদের আত্মার শান্তি কামনা করে মোনাজাত। এছাড়া, হল প্রশাসনের ব্যবস্থাপনায় সকাল ১০টা হতে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত নিহতদের তৈলচিত্র ও তৎসম্পর্কিত দ্রব্যাদি প্রদর্শন করা হবে।

এইচআর/এসকেডি