২০১৪ সালে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ২০১৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের হল কমিটি করতে গেলে দেখা দেয় কর্মী সংকট। কর্মীর অভাবে পূর্ণাঙ্গ কমিটি করতে পারেনি তৎকালীন হল শাখা ছাত্রলীগ। বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৮টি হলের মধ্যে তখন মাত্র ছয়টি হল ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের আগে পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করতে সক্ষম হয়েছিল। সেটিও হয়েছিল মাত্র ৫১ সদস্যবিশিষ্ট। 

সেই কমিটিতে পদ নিতে চাননি অনেকে। তবে ২০২২ সালের কমিটিতে সে চিত্র পুরোপুরি পাল্টে গেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৮টি হলে সর্বমোট পদ পেয়েছে ৩১৬৮ জন শিক্ষার্থী। এর বাইরে পদ প্রত্যাশী ছিলেন আরও হাজার খানেক কর্মী।

সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে স্থান পেয়েছেন ১৬১ জন, বিজয় একাত্তর হলে ১৭১ জন, জসিম উদ্দিন হলে ১৭৯ জন, মাস্টার দা সূর্যসেন হলে ২২১ জন, হাজী মুহাম্মদ মুহসীন হলে ২২১ জন, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলে ২০৭ জন, মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হলে ১১৫ জন, জগন্নাথ হলে ২৩১ জন, স্যার এ এফ রহমান হলে ১৯৩ জন, শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হলে ২২১ জন, অমর একুশে হলে পদ পেয়েছেন ১৬১ জন।   

আরও পড়ুন : ছাত্রলীগের সম্মেলন : মঙ্গলবার বন্ধ থাকবে যেসব সড়ক

এছাড়া শহীদুল্লাহ হলে ২২১ জন, ফজলুল হক হলে ১৮১ জন, শামসুন নাহার হলে ১৪১ জন, রোকেয়া হলে ১৮১ জন, বাংলাদেশ কুয়েত মৈত্রী হলে ১১১ জন, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হলে ১২১ জন এবং কবি সুফিয়া কামাল হলে ১৩১ জন শিক্ষার্থী কমিটিতে জায়গা পেয়েছেন।

ছাত্রলীগের সাবেক নেতারা বলছেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতা হারাবে মনে করে তখন (২০১৩ সালে) কর্মীরা পদ নিতে চাননি, তবে এখন সে ভয় নেই বললেই চলে। বর্তমান নেতারা বলছেন, শিক্ষাবান্ধব সরকার ও ছাত্রলীগকে নিরাপদ আশ্রয়স্থল মনে করে ছাত্রলীগের রাজনীতিতে সক্রিয় হচ্ছেন শিক্ষার্থীরা।

তবে হল কমিটিতে পদ পাওয়া নেতাদের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায় তাদের মধ্যে আছেন শিক্ষার্থী নির্যাতনকারী, ছিনতাইকারী, নারী কেলেঙ্কারির ঘটনায় জড়িত, নানা বিতর্কিত ঘটনায় সংগঠন ও হল থেকে বহিষ্কৃত ও মামলার আসামিরা। অভিযোগ রয়েছে, অনেক ত্যাগী কর্মীকে মূল্যায়ন না করে বিতর্কিত ও অনুপ্রবেশকারীদের পদায়ন করা হয়েছে। তবে দায়িত্বশীল নেতারা বলছেন সব খোঁজ খবর নিয়েই পদায়ন করা হয়েছে। বিতর্কিত কাউকে পদায়ন করা হয়নি। 

তবে অনেকে অভিযোগ করছেন, পদ পাওয়া নেতারা ভবিষ্যতে রাজনীতি করবে কি না, আওয়ামী পরিবারের সাথে সম্পৃক্ত কি না সব কিছু যাচাই-বাছাই করা হয়নি। ভবিষ্যতে ক্ষমতা পাল্টালে এসব নেতারা ভোল পাল্টাতে পারেন। 

হল কমিটিগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, বিজয় একাত্তর হল শাখা ছাত্রলীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে কামরুজ্জামান রাজু নাট্য ও বিতর্ক উপসম্পাদক এবং হৃদয় আহমেদ কাজল সহসম্পাদক পদ পেয়েছেন। এই দুজন চলতি বছরের ২৭ জানুয়ারি ওই হলের শিক্ষার্থী আকতারুল ইসলাম লিটনকে মারধর করেছিলেন।

এ ছাড়া গণযোগাযোগ ও উন্নয়ন সম্পাদক নাইমুর রশিদ, কর্মসূচি ও পরিকল্পনা উপসম্পাদক মাশফিউর রহমান, সংস্কৃতি সম্পাদক সফিউল্লাহ সুমন, ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সম্পাদক সাব্বির আল হাসান কাইয়ুম, প্রশিক্ষণ উপসম্পাদক ফিরোজ আলম অপি, ছাত্রবৃত্তি উপসম্পাদক আব্দুল্লাহ আল মারুফ কমিটিতে পদ পেয়েছেন। এরা সবাই হলটির আবাসিক শিক্ষার্থী আখলাকুজ্জামান অনিককে মারধরে অভিযুক্ত। গত ৯ নভেম্বর আরেক শিক্ষার্থী রাসেলকে নির্যাতনকারী মোনাফ প্রান্তও কার্যকরী সদস্য পদ পেয়েছেন। এসব পৃথক ঘটনায় হল প্রশাসন তদন্ত কমিটি গঠন করে অভিযোগের সত্যতা পেয়ে তাদের বিভিন্ন মেয়াদে সাজাও দিয়েছিল। 

আরও পড়ুন : ঢাবি ছাত্রলীগের কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হল শাখা ছাত্রলীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে শেখ শান্ত আলম ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সম্পাদক, ইমদাদুল হক বাঁধন উপসংস্কৃতি সম্পাদক, সাহাবুদ্দিন ইসলাম বিজয় উপদপ্তর সম্পাদক, নাহিদুল ইসলাম ফাগুন আইন উপসম্পাদক, শাহনেওয়াজ আরেফিন পল্লব স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা সম্পাদক এবং আরিফ হোসেন শুভ স্কুলছাত্র সম্পাদক পদ পেয়েছেন। এরা সবাই হলের আবাসিক শিক্ষার্থী আবু তালেবকে নির্যাতন ও মারধর করার ঘটনায় অভিযুক্ত। এদের বিরুদ্ধে হল প্রশাসনের তদন্ত চলমান। আর ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী এখনো রয়েছেন হলের বাইরে।

২০১৮ সালে সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের শিক্ষার্থী এহসান রফিককে নির্যাতনকারী আহসান উল্লাহকে ১ নং সহ-সভাপতি, ফারদিন আহমেদ মুগ্ধকে ৩ নং সহ-সভাপতি, সামিউল ইসলাম সামিকে যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক, রুহুল আমিন বেপারিকে সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবে পদায়ন করা হয়েছে। এছাড়াও কমিটিতে গেস্টরুমে শিক্ষার্থী নির্যাতনের অভিযোগ থাকা আল-ইমরানকে যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক, ইয়াসিন আরাফাত প্লাবনকে সাংগঠনিক সম্পাদক, ইয়াসিন আল শাহিনকেও সাংগঠনিক সম্পাদক পদ দেওয়া হয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদ প্রাঙ্গণে প্রস্রাব করাকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতাকে মারধর করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্যার এ এফ রহমান হল ছাত্রলীগ কর্মী সামিউজ্জামান সামী। পরে এ ঘটনায় সামিউজ্জামান সামীকে ছাত্রলীগ থেকে বহিষ্কার করা হয়। এ ঘটনার পর থেকে সামীর প্রতি ক্ষুদ্ধ ছিলেন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় ও বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা। তবে, হল কমিটি দেওয়ার কয়েকদিন আগে সেই বহিষ্কারাদেশ তুলে তাকে পদায়ন করেছে হল ছাত্রলীগ। এছাড়া, সামিউজ্জামান সামীর বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ও এর আশপাশ এলাকায় ছিনতাইয়ের অভিযোগও রয়েছে। 

বিশ্ববিদ্যালয়ের স্মৃতি চিরন্তন চত্বরে মোটরসাইকেল আরোহী প্রজিত দাস নামে এক ব্যক্তিকে থামিয়ে মারধর এবং তার মোটরসাইকেল, মুঠোফোন ও ১৭ হাজার টাকা ছিনতাইয়ের অভিযোগ ওঠে বিশ্ববিদ্যালয়ের সূর্য সেন হলের ছাত্রলীগ কর্মী তুষার হোসেন ও শামীমুল ইসলামসহ আরও অজ্ঞাতনামা পাঁচ-ছয়জনের বিরুদ্ধে। সূর্যসেন হল ছাত্রলীগের অভিযুক্ত তুষার হোসেনকে সহ-সভাপতি ও শামীমুল ইসলামকে সাংগঠনিক সম্পাদক করা হয়েছে। এছাড়া প্রশ্নফাঁস ও ছিনতাইয়ের ঘটনায় বহিষ্কৃত শেখ মারুফ হোসেন সুজনকে সহ-সভাপতি, শিক্ষার্থী নির্যাতনে বহিষ্কৃত মাহমুদ অর্পন সহ-সভাপতি পদ পেয়েছেন। 

অভিযুক্তদের বিষয়ে যা বলছেন নেতারা 
বিজয় একাত্তর হলের সাজাপ্রাপ্তদের বিষয়ে হল শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি সজিবুর রহমান সজিব ঢাকা পোস্টকে বলেন, হল কর্তৃপক্ষ তাদের হল থেকে বের করে দেয়নি, শুধু তাদের সিট বাতিল হয়েছে। ইতোমধ্যে অভিযুক্তরা হল প্রভোস্টের সাথে যোগাযোগ করেছেন। আশা করছি পরবর্তী আসন বণ্টনে তাদের হলে আসন দেওয়া হবে। যারা দীর্ঘদিন পরিশ্রম করেছে আমরা তাদের মূল্যায়ন করেছি।

সূর্যসেন হলের সভাপতি মারিয়াম জামান খান সোহান বলেন, বিতর্কিতদের আমরা পদায়ন করিনি। যারা ছাত্রলীগের রাজনীতিতে সক্রিয় ছিল, দীর্ঘদিন পরিশ্রম করেছে তাদেরই আমরা পদায়ন করেছি। 

আরও পড়ুন : আমরা ধরি ধরি ধরি না, ধরলে কিন্তু ছাড়ি না

স্যার এ এফ রহমান হল ছাত্রলীগের সভাপতি রিয়াজুল ইসলাম বলেন, আমরা সময় নিয়ে খোঁজ-খবর নিয়ে কর্মীদের পদায়ন করেছি। সামিউজ্জামান দীর্ঘদিন ছাত্রলীগের রাজনীতি করেছে। কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ তার কাজে সন্তুষ্ট হয়ে তার বহিষ্কারাদেশ তুলে নেওয়ার পর আমরা তাকে পদায়ন করেছি।

কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি ও বঙ্গবন্ধু হল শাখার সাবেক সাধারণ সম্পাদক ইয়াজ আল রিয়াদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের সময় হল কমিটি পূর্ণাঙ্গ করতে গিয়ে দেখা গেছে অনেকেই ভয়ে ভোল পাল্টে ছিল। অনেকেই পদ নিতে চায়নি। তবে এখন সময় পরিবর্তন হয়েছে, সুসময়ে অনেকেই ছাত্রলীগ করছে। তবে সর্বোচ্চ যাচাই-বাছাই করে পদ দেওয়া উচিত। যাতে আগের পরিস্থিতি তৈরি হলেও কর্মী সংকট না হয় ছাত্রলীগে।

এসব বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সদ্য বিদায়ী সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, দীর্ঘদিন পর হল কমিটি হওয়ার কারণে কর্মীরা দীর্ঘদিন রাজনীতি করেও পদ-পদবি পাননি। সে কারণে পদ সংখ্যার সমন্বয় করতে হয়েছে। আমরা চেষ্টা করেছি যাদের সুনাম রয়েছে, সবার কাছে গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে, একাডেমিক এবং পলিটিক্যাল ব্যাকগ্রাউন্ড ভালো, তাদের নিয়ে আসার চেষ্টা করা হয়েছে। আমরা বলব না একদমই ব্যত্যয় ঘটেনি, যেগুলোতে ব্যত্যয় ঘটেছে সেগুলোতে সংশ্লিষ্ট নেতাদের সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছি আমরা। 

আরও পড়ুন : প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ জয়-লেখক!

হল কমিটিতে অনেকের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগের বিষয়ে সদ্য বিদায়ী সভাপতি সনজিত চন্দ্র দাস ঢাকা পোস্টকে বলেন, হল কমিটিতে যারা স্থান পেয়েছেন, তারা ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। ছাত্র রাজনীতিতে দোষারোপ করার একটি রীতি রয়েছে। কারও বিরুদ্ধে মামলা হতেও পারে, পরিবারে অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সদস্য থাকতেই পারে। এই হিসেব করতে গেলে কাউকে পদায়ন করা সম্ভব না। কে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বাস্তবায়ন করে, বঙ্গবন্ধুর প্রতি ডেডিকেটেড কি না, তার কার্যক্রম কী, তার রাজনৈতিক পরিচয় কী আমরা সেগুলো গোয়েন্দা সংস্থা এবং স্থানীয় আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগের সঙ্গে যোগাযোগ করে খোঁজ-খবর নিয়েই তাদের কমিটিতে পদায়ন করেছি।

এইচআর/এনএফ