নিজ জন্মভূমিতে নিজের নামে প্রতিষ্ঠিত রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়েই রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনকে মূল্যায়ন করা হচ্ছে না। বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠার ১৪ বছরেও ক্যাম্পাসে নির্মাণ করা হয়নি দৃষ্টিনন্দন প্রতিকৃতি বা ম্যুরাল। নেই রোকেয়াবিষয়ক চর্চার কোনো সুব্যবস্থাও। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি বিভাগে আবশ্যিক রোকেয়া স্টাডিজ কোর্স পড়ানোর কথা থাকলেও নেই কোনো কার্যকরি পদক্ষেপ। এমনকি রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন তার নামের পূর্বে বেগম শব্দটি ব্যবহার না করলেও এ বিশ্ববিদ্যালয়ে তার নামের পূর্বে জুড়ে দেওয়া হয় ’বেগম’। 

জানা যায়, ২০০৮ সালে রংপুর বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। এরপর ২০০৯ সালে নাম এটির নাম পরিবর্তন করে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় (বেরোবি) নামকরণ করা হয়। শুধু নামের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকলেও তার আদর্শ চর্চার বিষয়ে এ বিশ্ববিদ্যালয়ে নেই সুব্যবস্থা। কেন্দ্রীয় লাইব্রেরিতে রোকেয়া কর্নার করা হলেও সেখানে রোকেয়া সাখওয়াত হোসেনের লেখা হাতেগোনা কয়েকটি বই ছাড়া তেমন কিছু মেলে না।

বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন থেকে পাওয়া তথ্য মতে, সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. আবদুল জলিল মিয়ার মেয়াদকালে ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ’ ও ‘রোকেয়া স্টাডিজ’ নামে ১০০ নম্বরের দুটি কোর্স প্রতিটি বিভাগের শিক্ষার্থীদের পড়ার জন্য বাধ্যতামূলক করা হয়। ২০১১ সালের ২০ এপ্রিল একাডেমিক কাউন্সিলের পঞ্চম সভার সুপারিশক্রমে এবং ২২ এপ্রিল অনুষ্ঠিত সিন্ডিকেটের ১৭তম সভায় এ বিষয়ে অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তৎকালীন উপাচার্য দুর্নীতির দায়ে অপসারিত হওয়ার পর ওই দুটি বিষয় আর চালুর কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ কে এম নূর-উন-নবীর চার বছরের মেয়াদকালেও ‘রোকেয়া স্টাডিজ’ কোর্সটি চালুর বিষয়ে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। 

চতুর্থ উপাচার্য অধ্যাপক ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহর যোগদানের এক বছরের মাথায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ২১টি বিভাগের সব শিক্ষার্থীর জন্য ননক্রেডিট এবং বাধ্যতামূলক ‘রোকেয়া স্টাডিজ’ কোর্সটি ক্লাসে পড়ানোর সিদ্ধান্ত গৃহীত হলেও বাস্তবায়ন হয়নি। ২০২১ সালের ৯ ডিসেম্বর বিকেলে রোকেয়া দিবস উপলক্ষে ভার্চুয়াল আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে পঞ্চম উপাচার্য ড. হাসিবুর রশীদ রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে অতিদ্রুত রোকেয়ার স্থায়ী ম্যুরাল স্থাপন করার কথা বললেও এক বছর পেরিয়ে গেলেও কোনো পদক্ষেপ লক্ষ্য করা যায়নি।

এদিকে রোকেয়ার নামে প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়ে তার কোনো স্মৃতিচিহ্ন, ম্যুরাল বা প্রতিকৃতি না থাকা এবং রোকেয়াবিষয়ক চর্চার সুব্যবস্থা না থাকায় ক্ষুব্ধ ও হতাশ বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা।

বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী নাজমুল হুদা বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠার ১৫ বছর হলেও এখন পর্যন্ত রোকেয়ার কোনো ম্যুরাল স্থাপন করা হয়নি এবং রোকেয়া স্টাডিজ চালু হয়নি। এটি অত্যন্ত হতাশাজনক।

সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী রোকনুজ্জামান রোকন বলেন, আমরা লেখাপড়া করছি রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে, কিন্তু রোকেয়া সম্পর্কে তেমন কিছুই জানতে পারছি না এ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের এই বিষয়টির দিকে নজর দেওয়া উচিত বলে আমি মনে করি।

রাষ্টবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী সাদিয়া আক্তার বলেন, রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন ভারতীয় উপমহাদেশে নারীদের উন্নয়নে কাজ করে গেছেন। নারীদের সুশিক্ষিত করার জন্য সারাটি জীবন ব্যয় করেছেন। কিন্তু তার প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমরা তার সম্পর্কে কিছুই শিখতে পারছি না। তার রেখে যাওয়া কর্ম, উদ্যোগ, দর্শন সম্পর্কে কিছুই জানতে পারছি না।

অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ওমর ফারুক বলেন, রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন রংপুরে জন্মগ্রহণ করে পৃথিবীব্যাপী নারী জাগরণের অগ্রদূত হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছেন। আমরা রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনকে কতটুকু সম্মান করতে পারছি এটি আসলে ভাবনার বিষয়। রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের নামের আগে বেগম শব্দটি ব্যবহার আসলে তাকে অসম্মান করা হয়েছে। যে বেগম শব্দটির বিরোধিতা করতেন রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন আর আমরা সেই বেগম শব্দটি তার নামে প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যবহার করছি। আমরা দীর্ঘ পনের বছরে এ বিশ্ববিদ্যালয়ে এখনও প্রতিটি বিভাগে রোকেয়া স্টাডিজ চালু করতে পারিনি। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে তার কোনো প্রতিকৃতিও নির্মাণ করতে পারিনি। আমরা চাই রোকেয়াকে যোগ্য সম্মান দিতে। আমরা চাই বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম সংশোধন করা হোক এবং প্রতিটি বিভাগে রোকেয়া স্টাডিজ চালু হোক।

বাংলা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ও কলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. তুহিন ওয়াদুদ বলেন, রোকেয়া স্টাডিজ কোর্সটা অনেক দিন আগে অনুমোদন হয়েছে। এটা বাস্তবায়নের কথা আমরা বলে আসছি। রোকেয়া স্টাডিজ শিক্ষার্থীদের দুটি কারণে জানা দরকার। প্রথমত রোকেয়ার নামে বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ার কারণে এবং দ্বিতীয়ত আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা কর্মক্ষেত্রে যখন বাইরে যাবে তখন রোকেয়া সম্পর্কে সম্যক ধারণা থাকা দরকার। তাই রোকেয়া বিষয়ে লেখাপড়া করা, রোকেয়ার চিন্তা, দর্শন আমাদের জানা জরুরি।

এ বিষয়ে উপাচার্য অধ্যাপক ড. হাসিবুর রশিদ বলেন, আমরা কাজ করে যাচ্ছি আলাদাভাবে রোকেয়া স্টাডিজ নামক কোর্সটি না থাকলেও, বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে বাংলাদেশ স্টাডিজ নামক কোর্সের মাধ্যমে রোকেয়ার জীবনকর্ম, রোকেয়া চর্চা, দর্শন প্রাধান্য থাকবে।

ম্যুরাল স্থাপনের বিষয়ে তিনি বলেন, রোকেয়ার ম্যুরাল নির্মাণের বিষয়ে আমাদের আন্তরিকতা আছে। সরকারের আর্থিক কৃচ্ছতা সাধন নীতির কারণে এ বছর বাজেট সংকুলান হয়নি। এ বছর আমরা মূল ফটক নির্মাণ করছি। পরবর্তীতে যত দ্রুত সম্ভব বেগম রোকেয়ার ম্যুরাল নির্মাণ করা হবে।

শিপন তালুকদার/আরএআর