‘আমাকে গেস্টরুমে নেওয়া হয়েছে, টর্চার সেলে নেওয়া হয়েছে। খাবার, পানি না দিয়ে লাঠি, স্টাম্প দিয়ে আবরারের মতো নির্যাতন করেছে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। ভোরবেলা একটা সময় মনে হয়েছে আমি মারা যাব। আমাকে মেরে ফেলার হুমকিও দেওয়া হয়েছিল।’

সোমবার (২৩ জুন) রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতির কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলন ডেকে এভাবে নির্যাতনের বর্ণনা দেন ‘শিবির সন্দেহে’ ছাত্রলীগের নির্যাতনের শিকার হওয়া শাহরিয়াদ মিয়া সাগর। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজয় একাত্তর হলের আবাসিক শিক্ষার্থী।

ঘটনার বর্ণনা দিয়ে শাহরিয়াদ বলেন, ‘আমাকে রোববার ডেকে নিয়ে ফোন চেক করে বলে আমি শিবির করি। তারপর আমাকে ধরে পদ্মা ব্লকের ৪০০৮ নং কক্ষে নিয়ে যায়। সেখানে আমাকে মাজেদ রহমান পাইপ দিয়ে জোরে আঘাত করে। এরপর ইউসুফ তুহিন চড় থাপ্পড় দেয়। তারপর সাকিবুল সুজন এসে আমার উরুতে পাইপ দিয়ে চার-পাঁচটা বাড়ি দেয়। এরপর সাংবাদিকরা এলে আলোচনার মাধ্যমে হল থেকে বের করে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। তবে পরে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক তানভীর হাসান সৈকত হল থেকে বের হতে নিষেধ করে। এরপর ছাত্রলীগ নেতারা রাতভর আমাকে মানসিক ও শারীরিকভাবে নির্যাতন করে।’

তিনি আরও বলেন, ‘পরদিন সকাল হইলে আমাকে আবার চড়-থাপ্পড় দেওয়া শুরু করে, কান টেনে, ঘাড় চাপে, চুল টানে। এরপর বলে তুই স্বীকার কর নইলে তোর মারে ফোন দিয়ে তোরে মারমু যেন তোর মা স্ট্রোক করে। একই সময়ে মাহমুদ চড়, থাপ্পড়, ঘুষি মারতে থাকে। এরপর আমাকে বেল্ট দিয়ে মারে। ব্রাজিলের পতাকা ছিল বারান্দায় বাঁশে লাগানো। সেটা খুলেও আমাকে মারে।’

নির্যাতনের অভিযোগ তোলা শাহরিয়াদ

নির্যাতনের সাথে জড়িত সবাই ছাত্রলীগের নেতাকর্মী উল্লেখ করে শাহরিয়াদ বলেন, ‘ছাত্রলীগ নেতা মাজেদ, আহমেদ ফয়সাল, শাহনেওয়াজ বাবু, ইউসুফ তুহিন, শাকিবুল হাসান সুজন সবচেয়ে বেশি নির্যাতন করেছে। এরা সবাই তানভীর হাসান সৈকতের অনুসারী।  বায়েজিদ বোস্তামী, আবুল হাছান সাঈদী এরাও এসময় উপস্থিত ছিল। এছাড়া রাজু, প্রান্ত এবং শুভ এরা ছোট ভাই মাহমুদকে ব্যাপক মারধর করেছে।’

শিবির সম্পৃক্ততার বিষয় স্বীকার করার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি নামাজ কালাম পড়ি, বলতে পারেন প্র্যাক্টিসিং মুসলিম। এসব দেখে আমাকে অনেকে শিবির বলে সন্দেহ করত। কিন্তু এগুলোর সাথে আমার কখনো সম্পৃক্ততা ছিল না। আমাদের কনভারসেশনের মধ্যেও এমন কিছু ছিল না। তারা আমাকে জোরপূর্বক স্বীকারোক্তি আদায় করে। তাদের নির্যাতন থেকে বাঁচার জন্য আমি সেসময় এটা বলেছি। আমি এসবের সাথে কখনো জড়িত ছিলাম না।’

বিচার দাবি করে তিনি বলেন, ‘আমি চাই না আমার মতো এ ধরনের নির্যাতনের স্বীকার আর কেউ হোক। জড়িত ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের সর্বোচ্চ শাস্তি চাই আমি। একইসঙ্গে আমি আইনি পদক্ষেপ নেব।’

এর আগে রোববার (২২ জানুয়ারি) রাত ১১টা থেকে সোমবার (২৩ জানুয়ারি) সকাল পর্যন্ত কয়েক ধাপে ওই শিক্ষার্থীর ওপর নির্যাতন চালানোর অভিযোগ উঠে এসব ছাত্রলীগ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে। নির্যাতনের শিকার শাহরিয়াদ ২০১৯-২০ সেশনের মনোবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী।

এদিকে মারধরের বিষয়টি অস্বীকার করেছেন অভিযুক্তরা। তবে তারা দাবি করেন, শিবিরের সঙ্গে সম্পৃক্ততার কথা স্বীকার করেছেন ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী শাহরিয়াদ। একইসুরে কথা বলতে দেখা যায় ছাত্রলীগ ও হল প্রশাসনকেও।

ঢাবি ছাত্রলীগ শাখার সাধারণ সম্পাদক তানভীর হাসান সৈকত বলেন, ওই শিক্ষার্থী ছাত্রশিবিরের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত বলে আমরা জেনেছি। প্রশাসন এ ব্যাপারে যথাযথ ব্যবস্থা নেবে। তবে ছাত্রলীগ মারধরের রাজনীতি করে না। মারধরের সঙ্গে কেউ জড়িত থাকলে প্রমাণসাপেক্ষে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

বিজয় একাত্তর হলের প্রভোস্ট অধ্যাপক ড. আব্দুল বাছির বলেন, ছাত্রশিবিরের সঙ্গে ওই শিক্ষার্থীর সম্পৃক্ততা আছে বলে জেনেছি। সে নিজেও বিষয়টি স্বীকার করেছে। সে এখন অনুতপ্ত। যেহেতু সে স্বীকার করেছে এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মানুযায়ী বিষয়টি প্রক্টর দেখবেন।

প্রক্টর অধ্যাপক ড. একেএম গোলাম রব্বানী ঢাকা পোস্টকে বলেন, হল প্রশাসন যেভাবে সহযোগিতা চেয়েছে আমরা করেছি। অভিযোগের বিষয়ে কথা হয়েছে। সে (ভুক্তভোগী) লিখিত দিয়েছে যে বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতিবিরোধী কোনো কাজ করবে না। পরে তাকে পরিবারের সদস্যদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে।

এইচআর/এমজে