দশমাস দশদিন গর্ভধারণ করে পৃথিবীর  আলো-বাতাসের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে নিঃস্বার্থ আর নির্ঝঞ্ঝাট ভালোবাসায় আগলে রেখে সন্তানকে বড় করে তোলেন মা। সে ভালোবাসার কোনো সীমা নেই, পরিমাপ নেই, নেই কোন খাদ। মায়েদের এই আত্মত্যাগ আর ভালোবাসার প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে আজ বিশ্বজুড়ে পালন করা হচ্ছে মা দিবস। মা দিবসে মাকে ঘিরে বিভিন্ন স্মৃতি ও মায়ের ভালবাসা কথায় রোমন্থন করেছেন রাজধানীর ঐতিহ্যবাহী ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক মোহাম্মদ ইউসুফ।

তিনি বলেন, মানুষের জীবনে সফলতার জন্য সবচেয়ে বড় প্রেরণার উৎস ও আশীর্বাদ হলো তার মা। বিশ্ব মা দিবস উপলক্ষ্যে পৃথিবীর সব মায়েদের গভীর শ্রদ্ধা ও সম্মান জানাই। আসলে আমার কাছে সারাজীবন অর্থাৎ প্রতিটি দিনই মা দিবস। নির্দিষ্ট একটি দিনে হয়ত আমরা মায়ের প্রতি সম্মান জানিয়ে দিবস হিসেবে পালন করি। তবে মাকে ভালোবাসাতে কোনো দিবসের প্রয়োজন নেই। সারাটি জীবনই মা দিবসের মতো আবেগ-অনুভূতি আর ভালোবাসা ধরে রাখা বাঞ্ছনীয়। কেননা সন্তানের কাছে তার মা হচ্ছেন পৃথিবীর সবচেয়ে আপন ও আশা-ভরসার কেন্দ্রস্থল।

তাছাড়া মা-সন্তানের সম্পর্ক হচ্ছে পৃথিবীতে এমন একটি সম্পর্ক যেটি অবিচ্ছিন্ন। শুধু মানুষ নয় বরং আমরা যদি প্রকৃতির দিকে তাকাই সেখানেও দেখব প্রাণীকুলের মধ্যেও মায়েরা কতটা দায়িত্বশীল। সন্তানকে সবাই ফেলে যায়, কিন্তু মা কখনো ফেলে যেতে পারেন না।

মাকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করে অধ্যক্ষ ইউসুফ বলেন, আমার মা একজন গ্রামের মানুষ। আমিও গ্রামে জন্মেছি ও সেখানেই বড় হয়েছি। আমার বেড়ে ওঠার পেছনে মায়ের অবদান সবচেয়ে বেশি। আমি যখন পড়ালেখা করতাম, অনেক সময় আমার পরীক্ষার ফি থেকে শুরু করে যাবতীয় প্রয়োজনীয় বইপত্রসহ অন্যান্য উপকরণ সব মা জোগাড় করে দিতেন। বিশেষ করে রাত জেগে যখন পড়তাম, তখন মা তার ঘুম বাদ দিয়ে আমার জন্য খাবারের ব্যবস্থা করতেন। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো রাত যতই হোক না কেন সবসময়ই আমাকে গরম খাবার দেওয়ার চেষ্টা করতেন। তবে তাই বলে বাবাদের অবদানও অস্বীকার করার মতো নয়। বাবারাও উপার্জন করে আমাদের ভরণপোষণের দায়িত্ব পালন করেছেন। সে বিষয়েও অবশ্যই কৃতজ্ঞতা স্বীকার করতে হবে। তবে সংগত কারণেই বাবার চেয়ে সন্তান মায়ের কাছেই বেশি সময় থাকার সুযোগ পায়। তাই আবারও বলছি, কোনো একজন মানুষের সাফল্যের পেছনের সবচেয়ে প্রেরণার ও আশীর্বাদ হচ্ছেন তার মা।

মাকে ঘিরে একটি ঘটনা স্মরণ করে তিনি বলেন, একটি ঘটনা যা এখনও আমাকে কষ্ট দেয়। আমি একবার হারিয়ে গিয়েছিলাম। তখন আমার বাবা ঢাকায় চাকরি করতেন। ঢাকা থেকে গিয়ে যখন আমাকে মাকে জিজ্ঞেস করছিলেন আমি কোথায় আছি। মা ভয়ে একেবারে ঘরছাড়া ছিলেন চারদিন। আমি যখন ফিরে এলাম তখন এ ঘটনা শুনেছি। এটি আমাকে এখনও খুব কষ্ট দেয়।

একাল আর সেকালের মায়েদের আদর স্নেহের মধ্যে কি পার্থক্য রয়েছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, আগের দিনে গ্রামীণ বা শহুরে জীবনে মায়ের সঙ্গে সন্তানের সম্পর্ক অনেক বেশি ছিল। তখন আমরা অনেক ডানপিঠে ছিলাম। সারাদিন ঘুরেছি ও খেলাধুলা করেছি। কিন্তু সবসময়ই আবার মায়ের কাছে ফিরে যাওয়ার একটি আকুলতা ছিল। বিশেষ করে সন্ধ্যায় যখন ঘরে ফিরতাম তখন মায়েরও অন্যরকম আকুলতা খেয়াল করতাম। তাছাড়া মায়ের হাতের পিঠা পায়েসের তো তুলনাই ছিল না। বিভিন্ন পার্বণে মা যেসব খাবার তৈরি করতেন, সেটি হয়ত নাগরিক জীবনে ঘটেও, তবে গ্রামীণ জীবনে যেসব আয়োজনে যে প্রাণ ছিল সেটি এখন আর নেই। দেখা যেত, সামান্য একটি পাটিসাপটা পিঠাও আমাদের অনেক মধুর লাগতো। শীতকালে ভাঁপা পিঠা তৈরি বা আয়োজন অন্যরকম অনুভূতি তৈরি করত। ছোট সময়ে মায়ের হাতে যেসব পিঠা খেয়েছি এখন অনেক মিস করি।

বর্তমান প্রজন্মে মায়ের সঙ্গে সম্পর্কে কিছু ভাটা পড়েছে কি না এমন প্রশ্নের উত্তরে অধ্যক্ষ বলেন, সন্তানের জন্য একমাত্র নির্ভরযোগ্য আশ্রয়স্থল ও সকল আশা ভরসার জায়গা হচ্ছেন মা। তবে এখন বিভিন্ন ইলেকট্রনিক ডিভাইসে আধিপত্য থাকায় মায়েদের সঙ্গে সন্তানের সম্পর্ক অনেকটাই হালকা হয়ে গেছে। যেটা আগে ছিল না। এখন নাগরিক ও গ্রামীণ জীবনে অনেক পরিবর্তন এসেছে। বিশেষ করে আজকাল মায়েরা ও সন্তানরা মোবাইল নিয়ে বেশিরভাগ ব্যস্ত সময় পার করে। মাকে যে সময় দিতে হয় সেটি অনেকে বোঝেই না। মায়ের আঁচলে মুখ মোছার যে আবেদন সেটি এখন শহুরে জীবনে কিংবা গ্রামীণ জীবনে অনেক বিলুপ্ত হয়ে গেছে। প্রযুক্তির দাপটে নির্ভরতার প্রতীক হারিয়ে যাচ্ছে। আমি বলব, মায়ের সঙ্গে সন্তানের যে সান্নিধ্য যত বেশি প্রবল হবে, প্রগাঢ় হবে, ততই একটি শিশু সন্তানের মানসিক-মানবিক দিকটি বিকাশ লাভ করবে। সে আরও বেশি মানবিক হয়ে উঠবে। তাই মাকে সন্তানের সময় দেওয়া ও সন্তানকে মায়ের সময় দেওয়ার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

মাকে রেখে যারা দূরে থাকেন, বিশেষ করে যারা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে থাকেন, তাদের নিয়মিত মা-বাবার সঙ্গে যোগাযোগ করা গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের সময় ফোন ছিল না। তখন একমাত্র ভরসা ছিল চিঠি। এখন চিঠির যুগ উঠে গেছে। কিন্তু বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রার সঙ্গে মায়ের সঙ্গে বন্ধনকে আরও সুদৃঢ় করার পদ্ধতি সহজ হয়ে গেছে। এখন মোবাইলে বা ভিডিও কলে প্রতিদিন কথা বলার সুযোগ হয়েছে। অন্তত প্রতিদিন একবার হলেও টেলিফোনে প্রত্যেক সন্তান মায়ের কাছে কথা বলতে ও খোঁজ-খবর নিতে পারে।

আরএইচটি/কেএ