মুক্তিযুদ্ধের ৭নং সেক্টর কমান্ডার লে. কর্নেল কাজী নূর-উজ্জামান স্মরণে ‘সংস্কৃতি, ঐতিহ্য সংরক্ষণ এবং জনগোষ্ঠীর ক্ষমতায়ন’ শীর্ষক বক্তৃতা অনুষ্ঠিত হয়েছে।

শনিবার (২০ মে) বিকেলে বাংলা একাডেমির কবি শামসুর রাহমান মিলনায়তনে এ বক্তৃতা অনুষ্ঠিত হয়। এ স্মারক বক্তৃতায় সভাপতিত্ব করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম।

‘সংস্কৃতি, ঐতিহ্য সংরক্ষণ এবং জনগোষ্ঠীর ক্ষমতায়ন’ শিরোনামে বক্তৃতা দেন বিশিষ্ট শিল্পী ও গবেষক লুবনা মারিয়াম। বক্তব্যে সংস্কৃতির প্রকল্প ধরে আলোচনায় আর্থ-সামাজিক কর্মকাণ্ডে সংস্কৃতির ভূমিকা নিয়ে আলোচনার সূচনা করেন তিনি।

তিনি জনগণের নিজস্ব ক্ষমতায়নের প্রক্রিয়া নির্ণয় এবং বাস্তবায়নের ওপর জোর দেন। লুবনা মারিয়াম বলেন, এ অঞ্চলে মানব অধিকারের জন্য রাজনৈতিক আন্দোলন এবং গণ-অভ্যুত্থানের সুদীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। সংস্কৃতি উন্নয়নের মধ্যে অবস্থিত নয়, বরং উন্নয়নই সংস্কৃতির মধ্যে অনুবিদ্ধ বলে মনে করেন তিনি।

লুবনা মারিয়াম সংস্কৃতি এবং রাষ্ট্র, বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, ঐতিহ্য সংরক্ষণ, সংরক্ষণের উদ্দেশ্য, ঐতিহ্য সংরক্ষণের প্রক্রিয়া, জনগোষ্ঠীর ক্ষমতায়ন, অভ্যন্তরীণ ক্ষমতায়ন, বাহ্যিক ক্ষমতায়নসহ ইত্যাদি বিষয়ে দীর্ঘ আলোচনা করেন।

লে. কর্নেল (অব.) কাজী নূর-উজ্জামান ১৯২৫ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি কলকাতা সেন্ট-জেভিয়ার্স কলেজের রসায়ন বিভাগের ছাত্র থাকা অবস্থায় ১৯৪৩ সালে নৌবাহিনীতে যুক্ত হন। ব্রিটিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে মতবিরোধ ঘটায় দু-দুবার কোর্ট মার্শাল হয়; উভয়বারই নির্দোষ প্রমাণিত হন তিনি। ইংল্যান্ডের রয়েল আর্টিলারি স্কুল থেকে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ শেষে ১৯৪৯ সালে কাশ্মীর যুদ্ধে যোগদান করেন তিনি। ১৯৬২ সালে তিনি ইপিআইডিসিতে বদলি হয়ে আসেন। সেখানে পশ্চিম পাকিস্তানি আমলাদের ব্যবহারে অসন্তুষ্ট হয়ে ১৯৬৯ সালে চাকরি থেকে স্বেচ্ছায় অবসর নেন এবং ব্যবসায় মনোনিবেশন করেন। ১৯৭১ সালে অবসর থেকে ফিরে মুক্তিযুদ্ধে সেক্টর কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন। যুদ্ধজয়ের কৃতিত্ব সাধারণ যোদ্ধাদের, এ উপলব্ধি থেকে বীর উত্তম খেতাব বর্জন করেন।

বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক লড়াই-সংগ্রামেও তিনি ছিলেন অন্যতম সংগঠক। তিনি জাহানারা ইমামের নেতৃত্বাধীন একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন। এছাড়া তিনি স্বদেশ চিন্তাসংঘে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। কৃষক আন্দোলন, পত্রিকা প্রকাশ, সাংস্কৃতিক সংগ্রামসহ বিচিত্রতর সামাজিক ভূমিকা রেখেছেন তিনি তার কর্মময় জীবনে।

মুক্তিযুদ্ধকে শুধু সশস্ত্র সংগ্রামের মাঝে সীমিত আকারে যারা ভাবেননি, কর্নেল কাজী নূর-উজ্জামান তাদের মাঝে অন্যতম। জাতীয় পুনর্গঠনের জন্য মুক্তিবাহিনীকে ব্যবহার করার স্বপ্ন দেখেছিলেন তিনি, স্বপ্ন দেখেছিলেন ঔপনিবেশিক শোষণ আর আমলাতন্ত্রের ধারাবাহিকতা থেকে মুক্তির। তার সে স্বপ্ন শুধু বাস্তবায়িত হয়নি, বরং লুণ্ঠন আর ব্যক্তিতান্ত্রিকতার যে জোয়ার একাত্তর পরবর্তী বাংলাদেশকে প্লাবিত করেছিল, তা ডেকে এনেছিল দীর্ঘ সামরিক শাসনও। তার সাবেক সহকর্মীদের একটা বড় অংশও হতাশ হয়েছেন, লুণ্ঠনের সহযোগী হয়েছেন, ছত্রভঙ্গ হয়েছেন কিংবা পরিস্থিতির স্রোতে গা ভাসিয়েছেন।

কর্নেল কাজী নূর-উজ্জামানের চেতনায় মুক্তিযুদ্ধের অর্থটা ছিল গভীরতর। প্রত্যক্ষ রাজপথের লড়াইয়ে যুক্ত থাকার পাশাপাশি লিখেছেন অজস্র। সাধারণ ক্ষমার মধ্য দিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের বড় অংশকে মুক্ত করে দেওয়ার বিরুদ্ধেও কথা বলেছেন, সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন। কৃষির পুনর্গঠন, সাম্রাজ্যবাদী শোষণ থেকে মুক্তির জন্য সংগ্রাম করেছেন। তার সেসব রচনায় বিশেষ করে ৭০ ও ৮০র দশকের বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংগ্রামের চিত্রটা গভীরভাবে ফুটে উঠেছে। কাজী নূর-উজ্জামান প্রকাশিত গ্রন্থ- একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, একজন সেক্টর কমান্ডারের স্মৃতিকথা, স্বদেশ চিন্তা, বাংলাদেশের সমাজ ও রাজনীতি, মুক্তিযোদ্ধা ও রাজনীতি। পত্রিকা- সাপ্তাহিক নয়া পদধ্বনি। সাহসী এ যোদ্ধা, সংগঠক ২০১১ সালের ৬ মে বার্ধক্যজনিত কারণে মৃত্যুবরণ করেন।

এইচআর/এফকে