পরিবেশবান্ধব উপায়ে চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব লেদার ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি (আইলেট)।

উদ্ভাবিত এ প্রযুক্তিতে স্বল্প খরচে এনজাইম ব্যবহার করে ৩০ শতাংশ কম রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করে প্রচলিত পদ্ধতির চেয়ে অধিকতর গুণগত মান সম্পন্ন ফিনিশড লেদার উৎপাদন করা সম্ভব বলে দাবি করছেন গবেষকরা। এর মাধ্যমে ২০৩০ সালের মধ্যে সরকার নির্ধারিত ১০ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে বলে প্রত্যাশা করেন গবেষকরা।

বৃহস্পতিবার (৬ জুলাই) বিশ্ববিদ্যালয়ের নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী সিনেট ভবনে আয়োজিত এক সেমিনারে এ গবেষণা-উদ্ভাবন তুলে ধরা হয়। আইলেট ও এশিয়া ফাউন্ডেশন যৌথভাবে এ সেমিনারের আয়োজন করেছে।

আইলেটের পরিচালক অধ্যাপক মোহাম্মদ মিজানুর রহমানের নেতৃত্বে একদল গবেষক নতুন এ প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছেন। এই আবিষ্কার সফলভাবে প্রয়োগ হলে বাংলাদেশে চামড়া শিল্পের চিত্র পাল্টে দেবে বলে মনে করেন তারা।

সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনকালে অধ্যাপক মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রপ্তানি খাত হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশের চামড়া শিল্পে রপ্তানি দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। এ শিল্প খাতে রপ্তানি হ্রাস পাওয়ার মূল কারণ হলো বাংলাদেশের ট্যানারিগুলো আন্তর্জাতিক পরিবেশগত কমপ্লায়েন্স সনদ (এলডব্লিউজি) প্রাপ্ত নয়। এ সনদ প্রাপ্তির পথে মূলবাধা হলো পরিবেশবান্ধব উপায়ে চামড়া প্রক্রিয়াজাত না করা, ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থের ব্যবহার ও সঠিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার অভাব।

‘ট্যানারি শিল্পের বিদ্যমান সমস্যা নিরসনের লক্ষ্যে ২০২১ সাল থেকে আমরা পরিবেশবান্ধব উপায়ে চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণের এক নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবনে কাজ করেছি। উদ্ভাবিত পদ্ধতিতে প্রস্তুতকৃত ফিনিশড লেদার দিয়ে প্রচলিত পদ্ধতির চেয়ে অধিকতর গুণগত মানসম্পন্ন চামড়াজাত পণ্য উৎপাদন করা সম্ভব হয়েছে।’

তিনি বলেন, এ পদ্ধতিটি গবেষণাগারে সফলভাবে সম্পন্ন হওয়ার পর প্রগতি ট্যানারিতে ইন্ডাস্ট্রিয়াল স্কেলেও প্রয়োগ ইতোমধ্যে সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে। 

এছাড়া উদ্ভাবিত প্রযুক্তিটি ইতোমধ্যে শিল্প মন্ত্রণালয়ের পেটেন্ট, ডিজাইন এবং ট্রেডমার্কস অধিদপ্তরে পেটেন্ট অনুমোদনের প্রক্রিয়াধীন রয়েছে বলে জানান তিনি।

‘উদ্ভাবিত প্রক্রিয়ায় লেদারের গুণগত মান উন্নয়ন ছাড়াও ট্যানারির তরল বর্জ্যে পরিবেশ ও মানবদেহের জন্য ক্ষতিকারক ক্রোমিয়ামের পরিমাণ ৯০ শতাংশ হ্রাস পাবে। এ ছাড়াও অন্যান্য ক্ষতিকারক কেমিক্যালের পরিমাণও উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পাবে। এ প্রক্রিয়ায় নির্গত তরল বর্জ্যও বাহ্যিকভাবে অনেকটাই স্বচ্ছ দৃশ্যমান হবে। উদ্ভাবিত পদ্ধতিটি চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণে ৩০ শতাংশ কেমিক্যাল খরচ এবং তরল বর্জ্য পরিশোধন ব্যয় ৫০ শতাংশের বেশি হ্রাস পাবে, যাতে ট্যানারির তরল বর্জ্য পরিশোধন পদ্ধতিও সহজতর হবে।’

চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণে ব্যবহার ছাড়াও আইলেট উদ্ভাবিত এনজাইম ব্যবহার করে আনট্যানড কঠিন বর্জ্য থেকে কম খরচে পরিবেশবান্ধব উপায়ে বায়োডিজেল এবং জৈব সার প্রস্তুত করা সম্ভব হয়েছে বলে জানান অধ্যাপক মিজানুর রহমান।

তিনি বলেন, ক্রোমযুক্ত ট্যানারির কঠিন বর্জ্য (শেডিং ডাস্ট) থেকে ইতোমধ্যে লেদার শেভিং বোর্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল স্কেলে সফলভাবে উৎপাদন করা সম্ভব হয়েছে, যা বাজারে প্রচলিত পার্টিকেল বোর্ডের চেয়ে অধিকতর গুণগত মানসম্পন্ন ও সাশ্রয়ী। এই উদ্ভাবনসমূহ উপযুক্ত বিনিয়োগ ও সরকারি সহায়তায় আইলেটের মাধ্যমে ট্যানারি শিল্পে বাস্তবায়িত হলে পরবর্তী দুই বছরের মধ্যে ট্যানারিগুলোর বহুল প্রত্যাশিত আন্তর্জাতিক পরিবেশগত সনদ অর্জন সম্ভব এবং ২০৩০ সালের মধ্যে সরকার নির্ধারিত ১০ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে।

সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাকে যৌক্তিক পরিণতিতে পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে সহায়তা দিতে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, শিল্প মালিকসহ সংশ্লিষ্ট সবার প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, ইন্ডাস্ট্রি একাডেমিয়া সম্পর্ক আরও জোরদারের মাধ্যমে সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করলে দেশের চামড়া খাতকে অনন্য উচ্চতায় নেওয়া সম্ভব হবে।

উপাচার্য এ উদ্ভাবনের বাণিজ্যিকীকরণের ওপর গুরুত্বারোপ করে বলেন, এক্ষেত্রে আমলাতান্ত্রিক জটিলতাগুলো দূর করতে হবে। স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণ এবং টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে এ উদ্ভাবন ভূমিকা রাখবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন। গবেষণায় অর্থায়ন করার জন্য উপাচার্য শিল্প মালিকদের প্রতি আহ্বান জানান।

সেমিনারে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশনের চেয়ারম্যান মো. মাহবুবুর রহমান, শিল্প মন্ত্রণালয়ের জয়েন্ট সেক্রেটারি মো. নুরুজ্জামান, বাংলাদেশ ট্যানারি অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান মো. শাহীন আহমেদ বক্তব্য রাখেন। স্বাগত বক্তব্য রাখেন এশিয়া ফাউন্ডেশনের কান্ট্রি রিপ্রেজেন্টেটিভ কাজী ফয়সাল বিন সিরাজ।

এইচআর/এসএম