জসিম উদ্দিন। ছবি- ঢাকা পোস্ট

১৯৯১ সালে সিলেটে ঘুরতে এসে হলের ডাইনিংয়ে টেবিলবয়ের কাজের মাধ্যমে শুরু বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে পথচলা। টেবিলবয় থেকে সহকারী বাবুর্চি এরপর প্রধান বাবুর্চি। পরে টং দোকান দিয়ে শুরু করেন খাবার বিক্রি। বলছি শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবি) একটি খাবারের দোকানের মালিক জসিম উদ্দিনের কথা। শিক্ষার্থীদের কাছে যিনি ‘জসিম ভাই’ নামেই পরিচিত।

সিলেটে আসার পর থেকে এ পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে কেটে গেছে প্রায় ৩২ বছর। এই ৩২ বছরে তাকে পাড়ি দিতে হয়েছে অনেক চড়াই-উতরাই। একদিকে ছোট ব্যবসা অন্যদিকে ছেলে-মেয়েদের পড়াশোনা আর সংসার। সবকিছু সামলেই পাড়ি দিয়েছেন এ দীর্ঘসময়। লক্ষ্মীপুরের কমলনগর থানার বাসিন্দা জসিম উদ্দিন। চার ছেলে-মেয়ে আর স্ত্রীকে নিয়ে তার সংসার।

ঢাকা পোস্টের বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধিকে গল্প আর আড্ডায় শাবিতে কাটানো ৩২ বছরের গল্পটা শোনালেন ‘জসিম ভাই’।

তিনি বলেন, ১৯৯১ সালে সিলেটে ঘুরতে আসি। তখন আমার ভাই বিশ্ববিদ্যালয়ের হলের ডাইনিংয়ে বাবুর্চি হিসেবে কাজ করতেন। ভাইয়ের কথামতো বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক শাহপরাণ হলের বি ব্লকের ডাইনিংয়ে কাজ শুরু করি। সেসময় হলটিতে ডাইনিং ছিল মোট চারটি। এরপর টেবিলবয় হিসেবে দাপ্তরিকভাবে কাগজে-কলমে ১৯৯২ সালের ১৩ মার্চ হলটিতে কাজ শুরু করি।

টেবিলবয় থেকে হলের ডাইনিংয়ে সহকারী বাবুর্চি এরপর প্রধান বাবুর্চি। এভাবে কেটে যায় প্রায় ১৫ বছর। সময়ের প্রয়োজনে হলটির তিনটি ডাইনিং বন্ধ হয়ে গেলে একসময় কর্মহীন হয়ে পড়েন জসিম উদ্দিন, এভাবে কেটে যায় প্রায় পাঁচ বছর। সে সময়টাতে পরিবার নিয়ে অনেক কষ্টে দিনাতিপাত করতে হয়েছে তাকে।

এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ব্যবস্থাপনায় ২০১১ সালে শাহপরাণ হলের সামনেই বসান টং দোকান। সেই থেকে শুরু হলো ‘জসিম ভাইয়ের টং’ দোকান। দিনরাত শিক্ষার্থীদের আড্ডা আর খাবার। সেই টং দোকানেই কেটে যায় প্রায় ১০ বছর। এই ছোট্ট দোকানের আয় দিয়ে ভালোই চলছিল তার সংসার। চার ছেলে-মেয়ের পড়াশোনার খরচও চালিয়েছেন এই টং দোকান থেকেই।

এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় সমাবর্তনের সময় তুলে দেওয়া হয় হলের সামনে থাকা তার টং দোকানটি। এর মধ্যে করোনা মহামারির সময় বন্ধ হয়ে যায় বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। তখন স্থায়ীভাবে অন্যান্য টং দোকানের সঙ্গে বন্ধ হয়ে যায় তার দোকানটিও। একে করোনা মহামারি তার উপর উপার্জনের সব উপায় বন্ধ। তখন খরচ যোগাতে দ্বারস্থ হতে হয় নানানজনের কাছে। কখনো জুটেছে আবার কখনো ধার করে চালিয়েছেন সংসার। শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের কাছ থেকেও পেয়েছেন সাহায্য। সেসময়টাতে বড় মেয়ের বিয়ের অর্থ যোগাতে করতে হয়েছে মোটা অঙ্কের ঋণ। যার রেশ টানছেন এখনও।

এরপর শিক্ষক আর শিক্ষার্থীদের সহযোগিতায় একসময় সেখানে টং স্থাপনের অনুমতি পেলেও তা স্থায়ী হয়নি বেশিদিন। তুলে দেওয়া হয় দোকানটি। দোকান ফিরে পেতে আবার শুরু হয় দৌড়ঝাঁপ। এরপর আরও কিছুদিন এভাবে কাটার পর ২০২২ সালের নভেম্বর মাসে বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক সৈয়দ মুজতবা আলী হলের সামনে একটি খাবার দোকানের অনুমতি পান তিনি। সেখানে চা, সিঙাড়া, ছোলা, পিঁয়াজু, জিলাপিসহ বিক্রি করেন বিভিন্ন খাবার। এ দোকানের ওপর ভর করেই চলছে তার সংসার। তবে জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় তেমন লাভও হচ্ছে না দোকানে। এতে করে পরিবার চালাতেই হিমশিম খেতে হচ্ছে তাকে।

জসিম উদ্দিন জানান, তার দুই ছেলে-মেয়ে সিলেটের ডিগ্রি কলেজে পড়াশোনা করছেন। আরেক মেয়ে পড়ছেন তৃতীয় শ্রেণিতে। তবে করোনা মহামারির সময়ে ছোট ছেলের পড়াশোনার খরচ যোগাতে পারেননি তিনি। অভাব-অনটনের কারণে পড়াশোনা ছাড়েন ছোট ছেলে। এখন খাবারের দোকানে বাবার কাজে সহযোগিতা করছেন তিনি।

তবে জসিম উদ্দিনের স্বপ্ন তার ছেলে-মেয়েরা চাকরি করে তার মুখ উজ্জ্বল করবে। তার বড় ছেলের পড়াশোনার খরচ এখনও চালাচ্ছেন তিনি। তিনি আশা করছেন বড় ছেলের একটা চাকরির ব্যবস্থা হলে তার কষ্ট কিছুটা হলেও কমে যাবে। ৩২ বছরে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক-শিক্ষার্থী বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন, যারা জসিম উদ্দিনের হাতে খাবার খেয়েছেন। বিভিন্ন সময়ে অনেক সংকটে তার প্রতি সাহায্যের হাতও বাড়িয়ে দিয়েছেন তারা। জসিম উদ্দিনের আশা, তার ছেলের যোগ্যতানুযায়ী তাদের মধ্যে থেকে কেউ একজন একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দেবেন। এতে হয়ত দীর্ঘসময় ধরে চলে আসা এ সংসারের বোঝা কিছুটা হলেও কমবে।

এমজেইউ