একজন ভালো নির্মাতা কিংবা অভিনয়শিল্পী হওয়ার জন্য সততা এবং নিজস্বতা বেশি প্রয়োজন বলে মনে করেন ‘মহানগর’ ও ‘সাবরিনা’ খ্যাত নির্মাতা আশফাক নিপুণ। 

শুক্রবার (১ ডিসেম্বর) বিকেলে গ্রিন ইউনিভার্সিটির সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম যোগাযোগ বিভাগের সহযোগী সংগঠন জেএমসি মিডিয়া ক্লাব আয়োজিত এক আলোচনা সভায় শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে এ কথা বলেন তিনি।

আশফাক নিপুণ বলেন, ধরেন আপনি একজন লেখক হবেন, গল্প লিখতে চান। কোন গল্প লিখলে পাঠকের কাছে বেশি পৌঁছাবে, সেটা নির্ভর করছে আপনি কতটা সৎভাবে গল্পটা লিখছেনে সেটার ওপরে। ঠিক একইভাবে, যারা নির্মাতা কিংবা অভিনয়শিল্পী হতে চান তাদের ক্ষেত্রেও এই সততা ও নিজস্বতাকেই বেশি প্রাধান্য দিতে হবে।

তিনি বলেন, যারা অভিনয়শিল্পী হতে চান, তাদের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন মানুষকে দেখা। কারণ প্রতিটা মানুষের চেহারায় গল্প আছে। ধরুন, আপনি বাসে করে কোথাও যাচ্ছেন। ওই বাসে আপনার আশপাশে যারা বসে আছেন, দাঁড়িয়ে আছেন প্রত্যেকের মাঝেই একটি করে গল্প বিরাজমান। এই গল্পগুলোই যখন আপনি পর্দায় নিয়ে আসবেন, তখনই দর্শকদের বেশি কানেক্ট করতে পারবেন। কারণ এগুলো তাদেরই দৈনন্দিন জীবনের গল্প।

এসময় মহানগর ওয়েব সিরিজের উদাহরণ টেনে এই নির্মাতা বলেন, বর্তমান সমাজে মানুষের মাঝে পুলিশকে নিয়ে এক ধরনের ভীতি কাজ করে। তাই আমার মনে হয়েছে, তাদেরকে কেন্দ্র করেই একটা গল্প নির্মাণ করা যায়। যদিও কাজটা সহজ ছিল না। কারণ পুলিশকে নিয়ে কনটেন্ট তৈরি করা বেশ চ্যালেঞ্জিং একটি বিষয়। আমি সেই চ্যালেঞ্জটাই নিয়েছিলাম। এমনও হয়েছে, ‘মহানগর’ ওয়েব সিরিজের প্রসঙ্গে বেশ কিছু ওটিটি প্ল্যাটফর্মের সঙ্গে কথা বলার পরে গল্প শুনে তারা আর আগ্রহ দেখায়নি। তাই বলে আমি গল্পে কোনো ছাড় দিতে রাজি হইনি। আমি আমার কাজ সম্পর্কে সৎ ছিলাম। এরপর যখন ওয়েব সিরিজটি নির্মাণ হলো এবং মুক্তি পেল, দুই বাংলার অধিকাংশ দর্শকই বেশ ইতিবাচকভাবে নিয়েছেন। প্রশংসা করেছেন।

আশফাক নিপুণ জানালেন, ‌‌‘মহানগর’ ওয়েব সিরিজ নির্মাণের চিন্তা আসে তারই দৈনন্দিন জীবনের এক ঘটনাকে কেন্দ্র করে।  শিক্ষার্থীদের সঙ্গে নিজের সেই অভিজ্ঞতার কথাও শেয়ার করেছেন তিনি। 

নিপুণ বলেন, আমি প্রতিদিন যখন বাসায় ফিরতাম, তখন একটা চেকপোস্টে নিয়মিত দাঁড় করানো হতো। প্রতিবারই আমাকে সিএনজি থেকে নামিয়ে তল্লাশি করা হতো। এই ঘটনা যখন আমার সঙ্গে টানা কয়েকদিন ঘটল, তখন একদিন সেখানে দায়িত্বরত একজন পুলিশ কর্মকর্তাকে জিজ্ঞেস করলাম– ‘এই চেকপোস্টে তল্লাশি করে আপনারা কখনোই কিছু পেয়েছেন কি না? এই প্রশ্নের কোনো উত্তর না পেলেও, এরপর থেকে আমাকে সেই চেকপোস্টে থামালেও তল্লাশি না করেই দাঁড় করিয়ে রাখা হতো। বলা যায়, এই ঘটনা থেকেই আমার মাথায় ‘মহানগর’ ওয়েব সিরিজ নির্মাণের চিন্তা তৈরি হয়।

বর্তমান সময়ের একজন নির্মাতার জন্য দর্শকের উত্তেজনার বিষয়টি মাথায় রেখে কাজ করা খুব চ্যালেঞ্জিং বলে মনে করেন আশফাক নিপুণ। তার ভাষায়, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের এই সময়ে দশ সেকেন্ডের রিলস ভিডিও বেশ জনপ্রিয়। মানুষ এখন বড় ভিডিও খুব একটা দেখতে চায় না। দর্শক উত্তেজনা চায়। যেটা একটা ড্রাগসের মতো। আমরা যখন কোনো কনটেন্ট নির্মাণ করি, তখন এই বিষয়গুলো মাথায় রেখেই কাজ করতে হয়। প্রায় সবাই চেষ্টা করে, কোনো নাটক, ওয়েব সিরিজ কিংবা সিনেমা নির্মাণের ক্ষেত্রে প্রথম তিন মিনিটেই এমন কিছু রাখা, যেটা দেখে দর্শক পুরো গল্পটা দেখতে আগ্রহ নিয়ে বসবে। আমি এটাই ভাঙতে চেয়েছি। ওয়েব সিরিজ ‘সাবরিনা’র ক্ষেত্রে উত্তেজনার থেকে নীরবতাটাকেই বেশি প্রাধান্য দিয়েছি। কারণ নির্মাণের ক্ষেত্রে আমি সবসময়ই সততাকেই বেশি প্রাধান্য দেই।

এদিন গ্রিন ইউনিভার্সিটির সাংবাদিকতা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মনিরা শরমিনের শুভেচ্ছা বক্তব্যের মাধ্যমে অনুষ্ঠানটি শুরু হয়। যেখানে তিনি বলেন, হুমায়ূন আহমেদের জনপ্রিয় ধারাবাহিক নাটক ‘কোথাও কেউ নেই’-এর বাকের ভাই চরিত্রটি মানুষের কাছে যেমন জনপ্রিয়তা পেয়েছিল, আশফাক নিপুণের ‘মহানগর’ ওয়েব সিরিজের ওসি হারুন চরিত্রটি দুই বাংলায় সমান জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। আমি মনে করি, আশফাক নিপুণের নির্মিত কনটেন্টগুলো নিয়ে অ্যাকাডেমিক আলোচনা করা যায়।

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য প্রফেসর ড. খাজা ইফতেখার উদ্দিন বলেন, ‘বিনোদনকে বিভিন্নভাবে ভাগ করা হলেও অর্থবহ বিনোদনই হলো মূল। কারণ বিনোদনের উদ্দেশ্য, সাধারণ মানুষের কাছে নির্দিষ্ট কোনো বার্তা পৌঁছে দেওয়া। আশফাক নিপুণের মতো নির্মাতাদের জন্যই বর্তমান সময়ে আমরা বেশ কিছু অর্থবহ ও বাস্তববাদী কনটেন্ট পাচ্ছি। আর অর্থবহ বিনোদনই পারে দেশ ও জাতির কল্যাণ বয়ে নিয়ে আসতে।’

গ্রিন ইউনিভার্সিটির সাংবাদিকতা বিভাগের চেয়ারপার্সন ড. অলিউর রহমানের সভাপতিত্বে ও গ্রিন ইউনিভার্সিটির অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোস্তফা মননের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য রাখেন গ্রিন ইউনিভার্সিটি স্টুডেন্ট এফায়ার্সের প্রধান ড. আফজাল হোসাইন খান, সহকারী স্টুডেন্ট অ্যাফেয়ার্স মোহাম্মদ সোলায়মান। 

অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন গ্রিন ইউনিভার্সিটি সাংবাদিক ফোরামের মডারেটর ও ইংরেজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক শামিম মন্ডল, সাংবাদিকতা বিভাগের ফ্যাকাল্টি শরিফ জাহান, ইব্রাহিম আজাদ, জেএমসি মিডিয়া ক্লাবের সভাপতি তাহমিনা ইমু, সেক্রেটারি রবিউল হাসান প্রমুখ।

বক্তারা সকলেই এমন এক আয়োজনের জন্য গ্রিন ইউনিভার্সিটির জেএমসি মিডিয়া ক্লাবকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। পাশাপাশি ভবিষ্যতেও শিক্ষার্থীদের জন্য এমন আলোচনা সভার আহ্বান জানান।

এনএইচ/এমএ