শিক্ষার্থীর ওপর ক্ষোভ
সাবেক উপাচার্যের ইশারায় শাবিতে ৩ বছর বন্ধ ক্যাফেটেরিয়া
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) এমএ ওয়াজেদ মিয়া আইআইসিটি ভবনে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের জন্য স্থাপিত ক্যাফেটেরিয়া প্রায় তিন বছর বন্ধ রয়েছে। তবে অভিযোগ রয়েছে, সেখানে দায়িত্বরত উপাচার্যবিরোধী আন্দোলনে অংশ নেওয়া বিশ্ববিদ্যালয়েরই সাবেক এক শিক্ষার্থী যেন ওই ক্যাফেটেরিয়ার দায়িত্ব না পান সেজন্য তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদের পরামর্শে বন্ধ করে দেওয়া হয় ক্যাফেটেরিয়া। এ অভিযোগ সাবেক উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমেদের ডানহাত এবং ঘনিষ্ঠজন হিসেবে খ্যাত ইনস্টিটিউট অফ ইনফরমেশন এন্ড কমিউনিকেশন টেকনোলজির (আইআইসিটি) সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. মো. জহিরুল ইসলামের বিরুদ্ধে।
জানা যায়, ২০২২ সালের জানুয়ারি মাসে উপাচার্যবিরোধী আন্দোলনে জড়িত থাকার দায়ে সে সময়ে ক্যাফেটেরিয়ায় দায়িত্বরত শাবির সাবেক শিক্ষার্থী সজল কুন্ডুকে সেখান থেকে সরিয়ে দেন অধ্যাপক জহিরুল ইসলাম। পরবর্তীতে বিভিন্ন অজুহাতে ক্যাফেটেরিয়া তিন বছর বন্ধ রাখেন তিনি।
বিজ্ঞাপন
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০২২ সালে উপাচার্যবিরোধী আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের দাবি দাওয়ার মুখে আইআইসিটি ভবনে অবরুদ্ধ হন শাবি উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমেদ। তাকে উদ্ধার করতে সে সময় নির্বিচারে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করে পুলিশ। আহত শিক্ষার্থীদের উদ্ধার করতে গিয়ে পুলিশের গুলিতে আহত হন সজল কুন্ডু।
এরপর অন্যান্য দাবির পাশাপাশি তার চিকিৎসা ও তাকে পুনর্বাসনের জন্য দাবি দাওয়া জানাতে থাকেন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। উপাচার্যবিরোধী আন্দোলনের এক পর্যায়ে সজল কুন্ডুর চিকিৎসা ও তাকে পুনর্বাসনের দায়িত্ব নেওয়া হবে বললেও তা আশ্বাসের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকে যায়। নেওয়া হয়নি তার চিকিৎসার পুরো দায়িত্ব এবং দেওয়া হয়নি তাকে প্রতিশ্রুত চাকরিও। এমনকি নানান অযুহাতে কেড়ে নেওয়া হয় তার জীবিকার একমাত্র উৎস সেই ক্যাফেটেরিয়াটিও।
বিজ্ঞাপন
সে সময়ে এটি বন্ধের প্রথমদিকে তার বিরুদ্ধে ঠিকমতো ক্যাফেটেরিয়া পরিচালনা করতে না পারার অভিযোগ আনেন অধ্যাপক জহিরুল ইসলাম। কিন্তু এর পক্ষে সঠিক যুক্তি ও তথ্যপ্রমাণ দাঁড় না করাতে পারায় ওই ক্যাফেটেরিয়াটি সংস্কার এবং টেন্ডারের মাধ্যমে পরিচালক নিয়োগ দেওয়ার অযুহাত দাঁড় করানো হয়। এরপর বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হলেও তা বিজ্ঞপ্তিতেই ঝুলে থাকে শেষ পর্যন্ত। এরপর একাধিকবার চালু করার প্রতিশ্রুতি দিলেও উপাচার্যের নির্দেশেই তা চালু করেননি তিনি বলে অভিযোগ রয়েছে।
এর আগে, ২০২১ সালের ডিসেম্বর মাসের মাঝামাঝি সজল কুন্ডুকে ওই ক্যাফেটেরিয়ার দায়িত্ব দেওয়া হয়। যার কাজ শুরু হয় ২০২২ সালের জানুয়ারি মাসের ১ তারিখ থেকে। এরপর একই মাসের ১৬ তারিখ পুলিশি হামলার পর থেকেই কার্যত বন্ধ করে দেওয়া হয় ক্যাফেটেরিয়াটি।
এরপর ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের ২৪ তারিখ থেকে আবার ওই ক্যাফেটেরিয়াটি চালু করলেও এর সপ্তাহখানেক পর থেকেই শুরু হয় বিভিন্ন অজুহাতে ক্যাফেটেরিয়া না চালাতে দেওয়ার হুমকিও। অন্যদিকে শিক্ষার্থীরা তখনও তাদের চিকিৎসাসহ সব দাবি-দাওয়ার ব্যাপারে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছিলেন। যা উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন এবং জহিরুল ইসলামকে আরও ফুসলিয়ে তোলে। এরপর সজল কুন্ডুকে এর দায়িত্ব না দিতে সে বছরের ২৮ মার্চ ওই ক্যাফেটেরিয়াটির পুরাতন নীতিমালা সংশোধন করে নতুন নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়।
এদিকে সে সময় ঈদের ছুটি শুরু হয়ে গেলে তার কাছ থেকে ঈদের বন্ধে নিরাপত্তার কথা বলে সজল কুন্ডুর কাছ থেকে চাবি নিয়ে নেওয়া হয়। ক্যাম্পাস খুললেই চাবি দিয়ে দেওয়া হবে বলে চাবি নিলেও তা আর দেননি জহিরুল ইসলাম। তবে চাবি পেতে হলে জানানো হয় সব কাগজপত্র (ট্রেড লাইসেন্স, টিন সার্টিফিকেট, জামানত) জমা দিয়ে চাবি নিতে পারবেন তিনি। শর্তমতে সব কাগজপত্র জমা দিলেও সজল কুন্ডুকে চাবি দেননি তারা। চাবির ব্যাপারে পুনরায় জিজ্ঞেস করা হলে কর্তৃপক্ষ পুনরায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে আরও আবেদনপত্র জমা নেওয়া হবে এবং সেগুলো যাচাই-বাছাই করে মনোনয়ন দেওয়া হবে বলে জানায় তারা। এরপর লক্ষাধিক টাকা বিনিয়োগ করে গড়ে তোলা ব্যবসায় তাকে আর বসতে দেয়নি অধ্যাপক জহিরুল ইসলাম।
এদিকে অধ্যাপক জহিরুল ইসলামের এমন নাটকের বলি হতে হয় কয়েকশ শিক্ষার্থীর। ক্যাফেটেরিয়ার অভাবে শিক্ষার্থীদের যেতে হতো বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনের দোকানগুলোতে বা আইআইসিটি ভবনের অন্য প্রান্তের টংগুলোতে। তা ছাড়া আইআইসিটি ভবনটি ৪ তলা থেকে ১০ তলায় উন্নীত করা হয়েছে এবং সেখানে নতুন বিভাগের পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের পরিধিও বেড়েছে।
খোঁজ নিয়ে আরও জানা যায়, এ ক্যাফেটেরিয়ায় আইআইসিটির সাবেক পরিচালক জহিরুল ইসলামের তৈরি করা নীতিমালার জন্য নতুন করে কেউ দায়িত্ব নিতে চাইছে না। ওই নীতিমালা অনুযায়ী ওই ক্যাফেটেরিয়ার পরিচালককে তার লভ্যাংশের একটি অংশ ওই আইআইসিটির প্রশাসনকে দিতে হবে। এ ছাড়া কেউ এর দায়িত্ব নিতে চাইলে তাকে অন্তত এক বছর কোনো হোটেল বা রেস্তোরাঁ পরিচালনার অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। যা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যকোনো ক্ষেত্রে দেখা যায় না। নীতিমালার এসব শর্তের জন্য কেউ এ ক্যাফেটেরিয়ার দায়িত্ব নিতে রাজিও হচ্ছে না বলে জানা গেছে।
নাম উল্লেখ না করার শর্তে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিএসই বিভাগের ২০১৮-১৯ সেশনের এক শিক্ষার্থী বলেন, শুরুতে ক্লাসের ফাঁকে হালকা খাবার এবং দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা থাকলেও উপাচার্যবিরোধী আন্দোলনের পর আইআইসিটির পরিচালক তা বন্ধ করে রাখেন তিন বছর। এতে করে আমাদের অতিরিক্ত দামে খাবার গ্রহণ করতে হয়েছে। এমনকি ক্লাসের ফাঁকে অনেককে খাবারের জন্য যেতে হয়েছে তাদের বাসায়ও। খাবারের জন্য দুর্ভোগ পোহাতে হলেও এটি চালু করার ব্যাপারে কোনো গুরুত্ব দেননি পরিচালক। চালু করবেন বলে আশা দেখালেও তিনি তা চালু করেননি।
শাবি উপাচার্য এবং আইআইসিটি পরিচালকের ক্রোধের বলি ক্যাফেটেরিয়ায় চাকরি হারানো সজল কুন্ডু বলেন, লোন আর বাসা থেকে টাকা নিয়ে কাজটা শুরু করেছিলাম। মাত্র ১৫ দিনের মাথায় এটি বন্ধ হওয়াতে অনেক বড় একটা আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছি। উপরন্তু প্রতিমাসের কিস্তি যা পুলিশের হামলায় আহত হয়ে হাসপাতালে থাকা অবস্থায়ও দিতে হয়েছে।
তিনি বলেন, আমরা এরপরও আশা নিয়ে অপেক্ষা করছিলাম, অফিসিয়াল কন্ট্রাক্ট করার জন্য। শর্ত অনুযায়ী আমরা সব কাগজপত্র জমা দিলেও কোনো এক অজ্ঞাত কারণে আমাদের কন্ট্রাক্টটি হয়নি। এখানে বিনিয়োগ করা অর্থের ক্ষতি হওয়া ও ঋণের বোঝা আমাকে বয়ে বেড়াতে হচ্ছে দীর্ঘদিন ধরে। এমনকি আমাকে দেওয়া কোনো আশ্বাসই প্রশাসন পূরণ করেনি।
এ বিষয়ে আইআইসিটি পরিচালক অধ্যাপক ড. মো. জহিরুল ইসলাম বলেন, আমরা সংস্কারের জন্য সময় নিয়েছি। এর পেছনে অন্যকোনো কারণ নেই। সংস্কারের জন্য এত বছর সময় প্রয়োজন হয় কিনা—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি।
এ বিষয়ে আইআইসিটির বর্তমান পরিচালক অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ আল মুমিন বলেন, আমরা এটা যত দ্রুত সম্ভব চালু করার চেষ্টা করছি। তবে এই ক্যাফেটেরিয়ার আগের নীতিমালার কিছু শর্তের জন্য এটার দায়িত্ব নিতে কেউ রাজি হচ্ছে না। তবে আমরা চেষ্টা করছি, যত দ্রুত সম্ভব এটি চালু করার, এজন্য দায়িত্বও দেওয়া হয়েছে।
যেহেতু আগের নীতিমালার জন্য এর দায়িত্ব কেউ নিতে চাচ্ছেন না সেখানে শিক্ষার্থীদের সুবিধার কথা চিন্তা করে নীতিমালা সংশোধন করে দ্রুততম সময়ের মধ্যে এটি চালু করা যায় কিনা—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা তাহলে এটি নিয়ে আবার বসবো। যেহেতু শিক্ষার্থীদের জন্যই এ ক্যাফেটেরিয়া সেহেতু আমরা যত দ্রুত সম্ভব বসে এর সমাধান করার চেষ্টা করবো।
জুবায়েদুল হক রবিন/এএমকে