সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরে অবস্থিত রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সাধারণ শিক্ষার্থীকে মারধরের অভিযোগে সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী ও বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের সিনিয়র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হৃদয় গাজীকে অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম থেকে সাময়িকভাবে বিরত থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর (ভারপ্রাপ্ত) নজরুল ইসলাম স্বাক্ষরিত এক জরুরি বিজ্ঞপ্তিতে শুক্রবার (৩১ অক্টোবর) এই নির্দেশ দেওয়া হয়।

এ ছাড়া, অন্য এক শিক্ষার্থীকে বহিরাগতদের মারধরের ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের প্রশাসনিক ভবনে তালাবদ্ধ করে রাখার অভিযোগ ওঠে ছাত্রদলের ৪-৫ জন নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে।

ঘটনার সূত্রপাত গত মঙ্গলবার (২৮ অক্টোবর) গভীর রাতে। ওই দিন রাত আনুমানিক ১টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী হাসিন ইকতিদার নিপুণকে শাহজাদপুর উপজেলার হাজিরঘাট এলাকায় মো. বিপ্লব নামে এক ব্যক্তি মারধর করেন। পরে স্থানীয় শিক্ষার্থীরা তাকে উদ্ধার করে স্থানীয় পিপিটি হাসপাতালে ভর্তি করেন। সেখান থেকে তাকে খাজা ইউনূস আলী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। এরপর তাকে সিরাজগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে পাঠানো হয়।

ওই রাতেই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ থানায় গিয়ে বিষয়টি অবহিত করেন। এরপর আহত শিক্ষার্থীকে দেখতে হাসপাতালে যান প্রক্টর (ভারপ্রাপ্ত) নজরুল ইসলাম ও বাংলা বিভাগের শিক্ষক জাবেদ ইকবাল। শাহজাদপুর থানা-পুলিশ পরদিন বুধবার (২৯ অক্টোবর) ভোরে অভিযুক্ত বিপ্লবকে আটক করে।

এদিন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আহত শিক্ষার্থীর নিরাপত্তা ও সামগ্রিক পরিস্থিতি নিয়ে বৈঠক করে। এ সময় প্রক্টোরিয়াল বডির সদস্যরাও উপস্থিত ছিলেন। বিকেলে আহত শিক্ষার্থী হাসপাতাল থেকে ছাত্রাবাসে ফিরে এলে শিক্ষকরা তার খোঁজখবর নিতে যান। সন্ধ্যায় শিক্ষার্থীর বাবা হাসিন আরমান বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করেন এবং ছেলের নিরাপত্তা ও পরবর্তী পদক্ষেপ বিষয়ে মতবিনিময় করেন। পরে তিনি থানায় গিয়ে প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলেন ও বিশ্ববিদ্যালয়ের গেস্টরুমে রাতযাপন করেন।

বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, শিক্ষার্থীকে মারধরের ঘটনাটি ব্যক্তিকেন্দ্রিক হলেও কিছু শিক্ষার্থী কর্তৃপক্ষকে মামলা করার জন্য চাপ দেন। তবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ব্যক্তিগতভাবে মামলা করার পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতার আশ্বাস দেয়। ওইদিন সাধারণ শিক্ষার্থীরা তিন দফা দাবি নিয়ে বিক্ষোভ করেন। দাবিগুলো হলো- আহত শিক্ষার্থীর চিকিৎসার ব্যয়ভার বহন, অভিযুক্তের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি এবং শাহজাদপুর পৌর এলাকায় পুলিশের টহল বৃদ্ধি। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এই দাবিগুলো মেনে নেয়।

এরপর বৃহস্পতিবার (৩০ অক্টোবর) দুপুরে আহত শিক্ষার্থীর বাবা হাসিন আরমান বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের চেয়ারম্যানের কক্ষে যান। সেখানে ছাত্রদলের কয়েকজন নেতাকর্মীও উপস্থিত ছিলেন। তারা আবারও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে মামলা করার জন্য চাপ দেন। কিন্তু প্রশাসন বিষয়টিকে ব্যক্তিগত ঘটনা হিসেবে বিবেচনা করে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মামলা না করার সিদ্ধান্তে অটল থাকে এবং সহায়তার প্রতিশ্রুতি দেয়।

পরে বিকেল ৩টার দিকে ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীসহ ছাত্রদলের কয়েকজন নেতাকর্মী প্রশাসনিক ভবনে তালা ঝুলিয়ে দেন। উপস্থিত ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের সহসভাপতি ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী হাবিব আদনান, সিনিয়র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হৃদয় গাজী, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক স্বপন মিয়া এবং ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী হাসিন ইকতিদার নিপুণ।

প্রশাসনিক ভবনে তালা দেওয়ার দেড় ঘণ্টা পর বিকেল ৪টা ৩০ মিনিটের দিকে তারা প্রশাসনিক ভবনের বিদ্যুৎ ও পানির সংযোগও বন্ধ করে দেন। এতে ট্রেজারার প্রফেসর ড. ফিরোজ আহমেদসহ নারী ও পুরুষ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা আতঙ্কে পড়ে যান। অভিযোগ রয়েছে, ওই সময় ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা অসৌজন্যমূলক আচরণও করেন।

পরে স্থানীয় প্রশাসনের সহযোগিতায় রাত ৭টার দিকে প্রশাসনিক ভবনের তালা ভেঙে কর্মকর্তাদের উদ্ধার করা হয়। খবর পেয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীরাও ঘটনাস্থলে ছুটে আসে এবং সংশ্লিষ্টদের বিচার দাবি করে। এ সময় ছাত্রদলের কয়েকজন নেতাকর্মী আবারও ঘটনাস্থলে এসে কর্মকর্তাদের সঙ্গে বাকবিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়েন। একপর্যায়ে সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী ও ছাত্রদলের সিনিয়র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হৃদয় গাজী বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যানেজমেন্ট বিভাগের শিক্ষার্থী জাহিদুল ইসলামকে আক্রমণ ও মারধর করেন বলে অভিযোগ ওঠে।

ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী হাসিন ইকতিদার নিপুণের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তার ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। তবে তার বাবা হাসিন আরমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার ছেলে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী৷ ছেলের ভালো ও মন্দ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকগণই ভালো বুঝবে। শিক্ষকদের ব্যবহারেও আমি সন্তুষ্ট৷ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের হাতে আমি ছেড়ে দিয়েছি, তারা যেটা ভালো মনে করবে সেটাই করুক। আমার চাওয়া, ভবিষ্যতে আর কারো সঙ্গে যেন এমন না হয়।

রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের সভাপতি মো. পিয়াস উদ্দীন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী হাসিন ইকতিদার নিপুণ প্রশাসনিক ভবনে একাই গিয়ে তালা দিয়েছিলেন৷ তখন শুধু কয়েকজন শিক্ষার্থী যারা পাশে ছিলেন, তারা গেছেন। আর বাগবিতণ্ডা হয়েছিল তখনই, যখন প্রক্টোরিয়াল টিম না গিয়ে স্থানীয় পুলিশ আসে। এতে উপস্থিতদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়।

শাহজাদপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আসলাম আলী ঢাকা পোস্টকে বলেন, এটা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিষয়, আমাদের কেউ জানায়নি। অভিযুক্ত ছেলেকে আটক করে চালান দেওয়া হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির যেন অবনতি না হয়, সেজন্য শুধু বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় পুলিশ ছিল৷

রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রক্টর নজরুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের শিক্ষার্থী মারধরের শিকার হওয়ার খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে থানা ও হাসপাতলে ছুটে গিয়েছি। আমরা সার্বিক বিষয়ে সহযোগিতা করে যাচ্ছি এখনো। শিক্ষার্থীদের দাবি মেনে নেওয়া হয়েছে। এরপর কিছু শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মামলা করার জন্য চাপ প্রয়োগ করে। তারা আলোচনা না করেই কোনো ঘোষণা ছাড়াই প্রশাসনিক ভবনে তালা দিয়ে বিদ্যুৎ ও পানির সংযোগ বন্ধ করে দেয়। এরপর রাত ৭টার দিকে প্রশাসনের সহায়তায় কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের উদ্ধার করা হয়েছে।

মো. নাজমুল হাসান/এএমকে