জাতীয় নির্বাচনের পর হতে পারে জকসু ভোট!
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় শিক্ষার্থী সংসদ (জকসু) নির্বাচনে একের পর এক আচরণবিধি লঙ্ঘন এবং ভূমিকম্পে আতঙ্কের কারণে ১৪ দিন বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করা হয়। এ কারণে নির্বাচন পিছিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা করছে নির্বাচন কমিশন ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। সর্বশেষ পরিস্থিতি বিবেচনা করে প্রার্থী, শিক্ষার্থী, এমনকি খোদ কমিশনের কেউ কেউ নির্বাচন নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করছেন।
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, ভূমিকম্পে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ থাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারটি ভবনের সংস্কার কার্যক্রম হাতে নিচ্ছে প্রশাসন। এজন্য বুয়েটের বিশেষজ্ঞ দল ভবনগুলোর সর্বশেষ অবস্থা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে আগামী নভেম্বরে রিপোর্ট জমা দেবে। সেই আলোকে ডিসেম্বরের ৩ তারিখ নাগাদ আরেকটি সভা আয়োজন করার পরিকল্পনা নিয়েছে প্রশাসন। এ সভায় এমন সিদ্ধান্ত আসতে পারে যে— ঝুঁকিপূর্ণ ভবন সংস্কারের জন্য আরও এক মাস অনলাইনে ক্লাস কার্যক্রম চলবে।
বিজ্ঞাপন
তবে সব বিভাগের সেমিস্টার পরীক্ষা বিবিএ ভবনে নেওয়ার চিন্তা করছে প্রশাসন, যেন একাডেমিক কার্যক্রমের ওপর তেমন কোনো প্রভাব না পড়ে। এসব কারণে জকসু নির্বাচন পিছিয়ে যেতে পারে।
জকসু প্রার্থীরা বলছেন, হুট করে ভূমিকম্পের দোহাই দিয়ে নির্বাচনের খসড়া প্রার্থী তালিকা প্রকাশের দিনই ১৪ দিনের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করা হয়। এ কারণে নির্বাচন পিছিয়ে যেতে পারে। সর্বশেষ প্রার্থীদের নিয়ে নির্বাচন কমিশনের ডাকা মতবিনিময় সভায়ও নির্বাচনের তারিখ পেছানো কিংবা আগানো নিয়ে আলোচনা হয়। ওই সভায় অধিকাংশ প্যানেল ও স্বতন্ত্র প্রার্থীরা নির্বাচন পেছানোর জন্য মত দেন। তবে, পূর্বনির্ধারিত তারিখে নির্বাচন চায় শিবির সমর্থিত প্যানেল।
বিজ্ঞাপন
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, নির্বাচন পিছিয়ে নেওয়ার পেছনে যেসব যুক্তি দিয়েছেন প্রার্থীরা, তার মধ্যে অন্যতম হলো— পূর্বঘোষিত ২২ ডিসেম্বর নির্বাচন হলে ভোটার উপস্থিতির হার আশানুরূপ হবে না। শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে নির্বাচন যদি জানুয়ারি কিংবা ফেব্রুয়ারির জাতীয় নির্বাচনের পর অনুষ্ঠিত হয়, তাতেও কোনো সমস্যা দেখছেন না কোনো কোনো প্যানেলের প্রার্থীরা।
কমিশনের একাধিক সদস্যের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, চলমান বন্ধ, অনলাইনে ক্লাস নেওয়া ও ডিসেম্বর মাস সার্বিক বিবেচনায় ২২ তারিখে নির্বাচন করা সম্ভব হবে না। আর নির্বাচন যদি পিছিয়ে জানুয়ারি মাসে করা হয়, তাহলে সেটা সম্ভাব্য ফেব্রুয়ারির জাতীয় নির্বাচনের কারণে বাস্তবায়ন কঠিন হয়ে যাবে। এ অবস্থায় যদি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের আয়োজন করতে হয় তাহলে সেটি জাতীয় নির্বাচন পরবর্তী সময় ছাড়া করার সুযোগ থাকবে না।
কী বলছেন ছাত্রনেতারা
নির্বাচনের তারিখ ঘিরে প্যানেলগুলোর মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে। কোনো প্যানেল চায় যথাসময়ে নির্বাচন হোক। কোনো প্যানেল চায় নির্বাচন পেছালেও যেন ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
স্বতন্ত্র ভিপি প্রার্থী চন্দন কুমার দাস বলেন, ‘এই ছুটি নির্বাচনের ওপর প্রভাব ফেলবে। কারণ অনেক প্যানেল অনলাইনসহ জেলা কল্যাণেও প্রচারণা শুরু করেছে। কিন্তু স্বতন্ত্র প্রার্থীর ১৬ হাজার শিক্ষার্থীর কাছে পৌঁছানোর একমাত্র উপায় ক্যাম্পাস। কিন্তু প্রশাসনের দেওয়া সময়ে শিক্ষার্থীদের কাছে পৌঁছানো সম্ভব নয়। সেজন্য নির্বাচন পেছানো যুক্তিযুক্ত। তবে ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হোক।’
ছাত্রদল সমর্থিত ‘ঐক্যবদ্ধ নির্ভীক জবিয়ান’ প্যানেলের জিএস প্রার্থী খাদিজাতুল কুবরা বলেন, ‘আমাদের কাছে সবার আগে জবিয়ানদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা প্রাধান্য পাবে। নির্বাচন আগানো বা পেছানো নিয়ে নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্তকে আমরা সাদরে গ্রহণ করব।’
ছাত্রশিবির সমর্থিত ‘অদম্য জবিয়ান ঐক্য’ প্যানেলের জিএস প্রার্থী আব্দুল আলিম আরিফ বলেন, ‘চলমান ক্যাম্পাস বন্ধ নির্বাচনে খুব একটা প্রভাব ফেলবে না। কারণ, শিডিউল অনুযায়ী ৯ তারিখের আগে যে কাজ আছে তা প্রশাসনের কাজ, প্রার্থীদের নয়। প্রচারণা ৯ তারিখের পর। আমরা চাই ২২ ডিসেম্বরেই নির্বাচনের আয়োজন করা হোক।’
ছাত্রশক্তি সমর্থিত ‘ঐক্যবদ্ধ জবিয়ান’ প্যানেলের এজিএস প্রার্থী শাহিন মিয়া বলেন, ‘এই লম্বা ছুটি অবশ্যই নির্বাচনে প্রভাব ফেলবে। কারণ আমাদের হল নেই, ক্যাম্পাসই শিক্ষার্থীদের সঙ্গে এনগেজমেন্টের একমাত্র সুযোগ। তবে, ভূমিকম্পের আতঙ্কে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তায় যদি নির্বাচন এক সপ্তাহ পেছানো হয়, তাহলে আমাদের কোনো সমস্যা নেই। তবে এর বেশি পেছালে সমস্যা। ডিসেম্বর মাসেই নির্বাচন সম্পন্ন হোক, এটাই প্রত্যাশা।’
বামজোটসহ ৯টি সংগঠনের সমন্বয়ে ‘মাওলানা ভাসানী ব্রিগেড’ প্যানেলের জিএস প্রার্থী ইভান তাহসীব বলেন, ‘অবশ্যই ভূমিকম্পজনিত এই ১৪ দিনের ছুটি জকসু নির্বাচনের ওপর অনেকখানি প্রভাব ফেলবে। শিক্ষার্থীরা ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছিল। এমন সময়ে এই দুর্যোগের ঘটনা সেই প্রস্তুতিতে ব্যাঘাত ঘটাবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘প্রশাসন এমন লম্বা ছুটির পেছনে যথেষ্ট কারণ দর্শাতেও ব্যর্থ হয়েছে। আমরা দাবি করেছিলাম ক্যাম্পাসের সব ভবনের ফিজিবিলিটি টেস্ট ও প্রয়োজনীয় উদ্ধার কার্যক্রমের প্রস্তুতি নিতে যে সময় লাগবে, সেটা শেষ করে আবার একাডেমিক কার্যক্রম শুরু করতে। তবে প্রশাসন তেমন কোনো বক্তব্য স্পষ্ট করেনি।’
নির্বাচন পেছানোর অফিসিয়াল কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি
এ বিষয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার অধ্যাপক ড. মোস্তফা হাসান বলেন, ‘খসড়া প্রার্থীদের সঙ্গে আলোচনা-মিটিং করেছি। সবার পালস বুঝতে চেষ্টা করেছি। কেউ ২২ তারিখে নির্বাচন চেয়েছে, কেউ জানুয়ারিতে নির্বাচন চেয়েছে, কেউ জাতীয় নির্বাচনের পর নির্বাচন চেয়েছে। আর স্বতন্ত্র প্রার্থীরা নির্বাচন পেছানোর কথা বলেছেন। আমরা এক মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত নেব না। তবে খুব বেশি পেছাব না। এতে নির্বাচন অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে যাবে।’
নির্বাচন পেছানোর বিষয়ে তিনি বলেন, ‘নির্বাচন পেছানোর এখনো অফিসিয়াল কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। যে তারিখ ঘোষণা করা হয়েছে, সেটা ছাড়া বিকল্প তারিখ নেই। তবে চলমান ছুটি নির্বাচনে প্রভাব ফেলবে। কিন্তু অভিযোগ জানানো, আপিল করাসহ অন্যান্য কাজ চলমান আছে। তবুও বিশ্ববিদ্যালয় খোলা না থাকলে নির্বাচনী কার্যক্রম চালানো কঠিন। কারণ বিশ্ববিদ্যালয় খোলা না থাকলে তো নির্বাচনই হবে না।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. রেজাউল করিম বলেন, ‘নির্বাচন কমিশনকে বলেছি যেহেতু সময় আছে, একটু সার্বিক পরিস্থিতি অবজারভেশনে রাখতে। যদি ২২ তারিখে নির্বাচন করার সুযোগ থাকে, তাহলে ২২ তারিখেই যেন নির্বাচন আয়োজন করা হয়। আর যদি ওই দিনে নির্বাচন করা না যায়, তাহলে এমন একটি নির্বাচনের তারিখ নির্ধারণ করতে যেন তা আবার পরিবর্তন না করতে হয়।’
নির্বাচনে আচরণবিধি ভঙ্গ করার হিড়িক
জকসু নির্বাচনে প্রার্থীরা মনোনয়নপত্র সংগ্রহের সময় থেকে শুরু করে প্রার্থী তালিকার খসড়া প্রকাশের পরও একের পর এক নির্বাচনী আচরণবিধি স্পষ্টভাবে লঙ্ঘন করে চলেছেন। আচরণবিধি ভঙ্গের সুস্পষ্ট প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও নির্বাচন কমিশন এখনো পর্যন্ত কোনো ধরনের কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেনি। এ অবস্থায় কমিশনের নির্বাচন পরিচালনার সক্ষমতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
মনোনয়নপত্র সংগ্রহের পর ছাত্রদল সমর্থিত জিএস প্রার্থী খাদিজাতুল কুবরা ছাত্রী হলের প্রতিটি কক্ষে গিয়ে পানি রাখার মগ, প্লেট ও স্যানিটাইজার ন্যাপকিন বিতরণ করেছেন, যা আচরণবিধির সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। এছাড়া গত ২৩ নভেম্বর ‘জীবনের জন্য গান’ শিরোনামে আয়োজিত কনসার্টে ওই প্রার্থীসহ আরও দুজন প্রার্থীকে মঞ্চে উঠতে দেখা যায়। অথচ নির্বাচন কমিশন কর্তৃক প্রদানকৃত অনুমতিপত্রের ৩ নম্বর শর্তে স্পষ্টভাবে উল্লেখ ছিল— কোনো প্রার্থী মঞ্চে উঠতে পারবে না। একই সঙ্গে প্রকাশ্যে অর্থ অনুদান ঘোষণা করা আচরণবিধির ৫(গ) ধারারও সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।
গত ২৪ নভেম্বর সকালে প্রকাশ্যে ছাত্রদল সমর্থিত ভিপি প্রার্থী মো. রাকিবকে শিক্ষার্থীদের মধ্যে খাবার বিতরণ করতে দেখা গেছে, যা আচরণবিধির ১১(ঙ) ধারার সরাসরি লঙ্ঘন।
আচরণবিধি লঙ্ঘনের বিষয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার অধ্যাপক ড. মোস্তফা হাসান বলেন, ‘হল থেকে একটা অভিযোগ এসেছে। আমরা কয়েকটি ছবি দেখেছি আচরণবিধি লঙ্ঘনের। কিন্তু কেন্দ্রীয় সংসদে কোনো লিখিত অভিযোগ পাইনি। লিখিত অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। একটা কমিটি রয়েছে, সে কমিটি যাচাই-বাছাই করে শাস্তির ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।’
এমএল/এমজে