মাসুদ আল মাহাদী অপু

রাজধানীর চানখারপুল থেকে ঝুলন্ত অবস্থায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী মাসুদ আল মাহাদী অপুর মরদেহ উদ্ধার নিয়ে চলছে আলোচনা। অপু বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের ২০১১-১২ সেশনের শিক্ষার্থী ছিলেন।

ঘটনার ২৪ ঘণ্টা অতিবাহিত হলেও অপুর মৃত্যুর কারণ জানাতে পারেনি পুলিশ। এটা হত্যা নাকি আত্মহত্যা সেটাও নিশ্চিত হতে অপেক্ষা করতে হচ্ছে ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন আসা পর্যন্ত। 

সোমবার (২৭ সেপ্টেম্বর) দুপুর ২টার দিকে চানখারপুলের স্বপ্ন বিল্ডিংয়ের ৮ম তলার একটি কক্ষ থেকে তার মরদেহ উদ্ধার করা হয়। অপুর রুমমেটরা প্রাথমিকভাবে এটিকে আত্মহত্যা বলে দাবি করেছিলেন। পরবর্তীতে মরদেহের অবস্থান ও দরজা খোলার একটি ভিডিও জনসম্মুখে আসার পর ঘটনাটি নিয়ে সন্দেহ দেখা দেয়।

একটি ভিডিও ক্লিপে দেখা গেছে, মৃত অপুর হাঁটু মেঝেতে স্পর্শ করা এবং দেহ ঝুলছিল। নিহতের বন্ধু ও স্বজনদের সন্দেহ, তাকে হত্যার পর ফাঁস দেওয়া হয়েছে। পুলিশ বলছে তদন্ত শেষে নিশ্চিত হওয়া যাবে, এটি হত্যা নাকি আত্মহত্যা।

প্রত্যক্ষদর্শীরা কেউ কেউ দাবি করেছেন, অপুকে হত্যার পর আত্মহত্যা বলে চালানোর জন্য ফ্যানের সঙ্গে মরদেহ ঝুলিয়ে রাখা হতে পারে। মৃত্যুর ধরন দেখে আত্মহত্যা মনে হয়নি তাদের।

পুলিশ বলছে, তারা ঘটনাটি গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করছে। ময়নাতদন্ত রিপোর্ট ছাড়াও পারিপার্শ্বিক ঘটনাপ্রবাহ বিশ্লেষণ করা হবে। বাসা থেকে সব ধরনের আলামত সংগ্রহ করা হয়েছে। তবে এটা হত্যা নাকি আত্মহত্যা সেটা জানার জন্য ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন পাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।

অপুর ঘনিষ্ঠ বন্ধু মীর আরশাদুল হক বলেন, সে (অপু) আমাদের ফার্স্ট বয় ছিল। তার কিছুটা আর্থিক সংকট ছিল। কিন্তু চলার জন্য যতটুকু লাগে, তা ছিল। চাকরির পরীক্ষা দিচ্ছিল, এটা তো একটু দীর্ঘ প্রক্রিয়া। সে ক্ষেত্রে হতাশা থাকতেই পারে, কিন্তু এতটা নয় যে তার জন্য সে আত্মহত্যা করবে।

অপুর মৃত্যু নিয়ে ঢাবির গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ড. ফাহমিদুল হক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে এক স্ট্যাটাসে লিখেছেন, ‘মাসুদ আল মাহাদী (অপু) মেধাবী ছাত্র ছিল, সত্যিকারের মেধাবী। ফলাফলও ভালো করত। তবে গতানুগতিক ভালো ফলাফল করাদের মতো সে ক্লাসে খুব নিয়মিত ছিল না। সে প্রশ্ন করত, প্রতিবাদ করত। ষাটের দশক কিংবা নিদেনপক্ষে ৮০র দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যেসব শিক্ষার্থী নিয়ে গর্ব করত, যাদের কারণে ছাত্র আন্দোলন বিষয়টা একটা স্বর্ণালী রোমান্টিসিজম এখন, অপু ছিল সে ধরনের শিক্ষার্থী।’

তিনি আরও লিখেছেন, ‘সে নিশ্চয় শিক্ষক হতে চাইত। কিন্তু সে বা আমি বা অনেকেই জানত, তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে নেওয়া হবে না। এ সময়ে এ ধরনের কাউকে বিশ্ববিদ্যালয় নেওয়া হয় না। বিশ্ববিদ্যালয় চায় অনুগত গাধাদের।সাংবাদিকতার যে অবস্থা, সেখানেও নিশ্চয় সে হতাশ হয়েছে। নিরাপদ চাকরির জন্য সে বিসিএসের প্রস্তুতি নিচ্ছিল, তা অপুর স্বভাববিরোধী। তার স্বভাব ধারণ করার একমাত্র জায়গা হতে পারত বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু সেখানে ঢোকার সুযোগ তার নেই। অপু আত্মহত্যা করেছে শুনছি। সিস্টেম কীভাবে প্রখর এক তরুণকে এদিকে ঠেলে দিতে পারে, তার একটিমাত্র উদাহরণ দিলাম।’

সাখাওয়াত ফাহাদ নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী লিখেছেন, ‘শেষবার অপুর সঙ্গে উদ্যানের গেটে দেখা হয়েছিল। অনেক তাড়া ছিল তার। ক্যাম্পাসের শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন দাবির মিছিলে অপু ছিল সামনের সারির একজন। হয়ত এইটা আত্মহত্যা বলেই চালিয়ে দেওয়া হবে। কিন্তু শিক্ষার্থীদের জীবনকে কীভাবে রাষ্ট্র, সমাজ সংকটাপন্ন করে প্রতিনিয়ত মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে সেই কাঠামোগত প্রক্রিয়াকে কেউ চিহ্নিত করবে না।’

একই বিল্ডিংয়ের সপ্তম তলায় বসবাস করেন লতিফুল হাসান। মরদেহ উদ্ধার ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী তিনি। ঢাকা পোস্টকে লতিফুল হাসান বলেন, ‘এটি আত্মহত্যা হতে পারে না। দরজাটা খুব সহজে খুলে গেছে, জোরে ধাক্কা দেওয়ারও প্রয়োজন হয়নি। তাছাড়া খোলার সঙ্গে সঙ্গে দেখা গেছে অপুর হাঁটু ফ্লোরে লাগানো ছিল। যে উচ্চতায় অপুর মরদেহ ঝুলছিল তা দেখে আত্মহত্যা বলে মনে হচ্ছে না।’

এটিকে ‘রহস্যজনক মৃত্যু’ উল্লেখ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল টিমের এক সদস্যও বলেন, ‘একটি ভিডিও ফুটেজে দরজা খোলা এবং অপুর ফ্লোরে হাঁটু গেড়ে ঝুলে থাকার দৃশ্য দেখা গেছে। তাই এটাকে আত্মহত্যা মনে হয়নি। এটি রহস্যজনক মৃত্যু, সঠিক তদন্ত করলে হয়ত আসল ঘটনা বেরিয়ে আসবে।’

অপুর রুমমেট জহিরুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমি ২টার দিকে লাঞ্চে এসে রুম বন্ধ পাই। দরজার ছিদ্র দিয়ে শুধুমাত্র হাতটা দেখা যাচ্ছিল। আমি বাড়ির ম্যানেজারসহ কয়েকজনকে বিষয়টি জানাই। পরে সবাই মিলে দরজার লক ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করে দেখি অপু ঝুলন্ত অবস্থায় রয়েছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘অপু গতকাল (রোববার) রাতে একটা চাকরির পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিয়েছে, পড়ালেখাও করেছে রাত ১টা পর্যন্ত। আত্মহত্যা করার পেছনে কোনো কারণ আমি খুঁজে পাচ্ছি না।’

আত্মহত্যা ছাড়া আর কিছুই নয় উল্লেখ করে একই তলার পাশের রুমের খায়রুল আলম ঢাকা পোস্টকে বলেন, এটা যে আত্মহত্যা তাতে কোনো সন্দেহ নেই। যারা আত্মহত্যা নয় বলছে, তাদের এই সম্পর্কে কোনো ধারণাই নেই। তখন তো তিনি (অপু) ছাড়া কেউ রুমে ছিল না, আর রুমও বন্ধ ছিল। কেন প্রশ্ন উঠছে যে এটা আত্মহত্যা কি না সেটা আমি বুঝতে পারছি না।

তিনি আরও বলেন, দরজার খোলার সময় আমরা ৫-৬ জন ছিলাম, দুই-তিন ধাক্কায় দরজা খুলে গেছে। সব দরজা তো আর সমান নয়। এমনিতেই ফাঁক দিয়েই উনার হাত দেখা গিয়েছিল। তাহলে বুঝেন দরজাটা কেমন হতে পারে। তাছাড়া উনার সঙ্গে থাকে দুজন জুনিয়র, তারা চাকরি করে। উনার সঙ্গে ওইরকম কোনো কিছু হওয়ার সম্ভাবনা দেখছি না।

ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন লালবাগ থানার ডিসি জসীম উদ্দীন মোল্লাহ। তিনি বলেন, ‘রুমমেটরা বলছেন আত্মহত্যা। তবে আমরা মরদেহের সুরতহাল করেছি। কিছু ভিডিও ফুটেজও আছে, সবকিছু যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন হাতে পাওয়ার পর আমরা বলতে পারব এটা আত্মহত্যা নাকি অন্যকিছু।’

ঘটনাটির তদন্তের তদারকিতে থাকা চকবাজার থানার এডিসি কুদরত-ই খোদা ঢাকা পোস্টকে বলেন, মাথা থেকে পা পর্যন্ত কোনো ক্ষত আছে কি না, দাগ আছে কি না এবং পারিপার্শ্বিক আলামত এবং ব্যবহারকৃত মোবাইল সবকিছু যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। তারপর ময়নাতদন্তের রিপোর্ট এবং ডাক্তারের মতামত সবমিলে আমরা একটা সিদ্ধান্তে আসব। এর আগে কোনো কিছু বলা যাচ্ছে না।

সহপাঠীরা জানান, অপু অনার্সে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম এবং মাস্টার্সে প্রথম শ্রেণিতে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেন। অনার্স ও মাস্টার্সে ভালো রেজাল্ট করা অপু কিছুদিন সাংবাদিকতাও করেন। চাকরি ছেড়ে গত দুই বছর ধরে প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন বিসিএসের। ৪১তম বিসিএস প্রিলিমিনারিতে উত্তীর্ণ হয়ে লিখিত পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তিনি। তার গ্রামের বাড়ি পিরোজপুরের স্বরূপকাঠিতে। দুই ভাইয়ের মধ্যে তিনি বড়।

এইচআর/এসকেডি